• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর, ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১
সাভার আশুলিয়ায় ১১১ কারখানা, গাজীপুরে বন্ধ ৩৬টি

বন্ধ কারখানায় বাড়ছে শঙ্কা


বিশেষ প্রতিনিধি সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৪, ০১:৫৯ পিএম
বন্ধ কারখানায় বাড়ছে শঙ্কা

ঢাকা : বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের ১৪৭ পোশাক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর)। এর মধ্যে ৫৪টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে মালিকপক্ষ আর বাকিগুলো শ্রমিকরা উপস্থিত হয়েও কাজ না করায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

সূত্রটি জানিয়েছে, বন্ধ থাকা কারখানার মধ্যে ১১১টি সাভার, আশুলিয়া ও জিরানী এলাকার। বাকি ৩৬টি কারখানা গাজীপুরের।

এদিকে বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) গাজীপুরে একটি তৈরি পোশাক কারখানার গোডাউনে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আগুন দিয়েছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে।

বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে নগরীর কাশিমপুর থানার চক্রবর্তী এলাকায় ‘বেক্সিমকো কারখানার’ শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে বিক্ষোভের একপর্যায়ে ‘বিগবস করপোরেশন লিমিটেড কারখানার’ ওয়্যার হাউজে অগ্নিসংযোগ করেন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গেলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা তাদের গাড়ি ভাঙচুর করেন। পরে বিকেল ৫টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। ওই ঘটনায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও জানা যায়নি। তবে পোশাক কারখানায় আগুনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা।

বৃহস্পতিবারের মধ্যে পোশাক শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা হবে বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) আমাদের সাভার প্রতিনিধি জানান, সাভারের আশুলিয়ায় বিভিন্ন দাবিতে কয়েক দিনের চলমান শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে ৪১ তৈরি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল এই ঘোষণা দেয় সংশ্লিষ্ট কারখানা কর্র্তৃপক্ষ।

এ ছাড়া আরও অর্ধশত কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। কোথাও কোনো ধরনের সড়ক অবরোধ বা বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়নি। তবে শিল্পাঞ্চলের অন্যান্য কারখানাসহ ঢাকা ইপিজেডের কারখানাগুলো চালু রয়েছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশুলিয়ার কাঠগড়া থেকে জিরাবো এলাকায় অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানার মূল ফটকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার নোটিস টানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে আশুলিয়ার নরসিংহপুর, ইউনিক, জামগড়া, বেরন এলাকার হা-মীম গ্রুপ, শারমিন গ্রুপ, এনভয় কমপ্লেক্স, হলিউড গার্মেন্টস প্রাইভেট লিমিটেড, স্টারলিং অ্যাপারেলস লিমিটেড, ভার্চুয়াল বটয়ম, ম-ল নিটওয়্যারস লিমিটেড, সিগমা ফ্যাশনস লিমিটেড, ক্রশওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিস লিমিডেট, জিনস প্রোডিউসার লিমিটেড, অরুণিমা গ্রুপের অরুণিমা স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেড, ডিএমসি অ্যাপারেলস লিমিটেড, এসএম নিটওয়্যারস লিমিটেড, আজমত গ্রুপের আজমত অ্যাপারেলস লিমিটেড, জেড-থ্রি কম্পোজিট নিটওয়্যার লিমিটেড ও জি-থ্রি ওয়াশিং প্যান্ট লিমিটেড, এনভয় কমপ্লেক্স, আগামী অ্যাপারেলস লিমিটেড, মানতা অ্যাপারেলস লিমিটেডসহ বেশ কিছু কারখানার সামনের ফটকে একই নোটিস টানানো হয়েছে।

নোটিসে বলা হয়েছে, ‘গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পোশাকশ্রমিকদের বিভিন্ন দাবিকে কেন্দ্র করে গার্মেন্টস কারখানায় ভাঙচুরসহ হট্টগোল চলছে। বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে আমাদের কারখানায় ভাঙচুর চালানোর চেষ্টা করেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় গতকাল থেকে শ্রম আইন-২০০৬-এর ১৩(১) ধারা অনুসারে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হলো।

কয়েকটি কারখানায় শ্রমিকরা নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হলেও বন্ধ থাকায় বাড়ি ফিরে যান। শ্রমিকরা বলেন, ‘সকালে আসছি কাজ করতে। হা-মীম, শারমিন গার্মেন্টস বন্ধ করে দিছে দেখে অনেকে কাজ করে নাই। তাই আমাদের কারখানাও ছুটি দিছে।’

এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে এসব সড়কে টহল দিচ্ছেন যৌথবাহিনীর সদস্যরা। বিভিন্ন কারখানার সামনে মোতায়েন রয়েছে অতিরিক্ত সেনা, পুলিশ ও এপিবিএন সদস্য।

শিল্প-পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম জানান, সকাল থেকে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের কোথাও কোনো সড়ক অবরোধ, কারখানায় হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। শিল্পাঞ্চলে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কারখানাগুলোর সামনে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য। পাশাপাশি শিল্পাঞ্চলে যৌথবাহিনীর টহলও অব্যাহত রয়েছে।

গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরে শ্রমিক অসন্তোষে বিক্ষোভের কারণে অন্তত ৩০টি কারখানায় ছুটি ও ৬টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শ্রমিকদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন আট শ্রমিক।

এ ছাড়া শ্রমিকদের আন্দোলনে শরিক না হওয়ায় একটি বিগবস নামে পোশাক কারখানায় আগুন দিয়েছেন বেক্সিমকো কারখানার শ্রমিকরা। শ্রমিকদের আন্দোলন থামাতে গিয়ে থানা-পুলিশ, শিল্প-পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো পদক্ষেপই শ্রমিকদের থামাতে পারছে না।

বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটে।

শ্রমিক ও শিল্প-পুলিশ সূত্র জানায়, গাজীপুর মহানগরীর কাশিমপুর থানাধীন সারাবো এলাকায় সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে বেশ কিছু শিল্প-কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় প্রায় ৪৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। কয়েক দিন ধরে শ্রমিকরা আগস্ট মাসের বেতনের দাবি করে আসছেন।

বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকালে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের কয়েক হাজার উত্তেজিত কালিয়াকৈরের চন্দ্রা-নবীনগর সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে সড়কের উভয় দিকে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার বেতন দেওয়ার কথা জানায় কারখানা কর্র্তৃপক্ষ। ওইদিন কিছু শ্রমিককে বেতন দেওয়া হলেও বেশিরভাগ শ্রমিকের অ্যাকাউন্টে বেতন যায়নি।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন শ্রমিকরা, যা রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। একই দাবিতে গতকাল সকালে শ্রমিকরা কালিয়াকৈর-নবীনগর সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে ওই সড়কের উভয় দিকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তখন যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন।

শ্রমিক আন্দোলনের জেরে ইতিমধ্যে জেলার ছয়টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্র্তৃপক্ষ। এগুলো হলো গাজীপুর গিলারচালা এলাকার ফমকম ফ্যাশন, অ্যাপারেল-২১ লিমিটেড, ফমকম প্রিন্টিং ও এমব্রয়ডারি, কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা এলাকার নায়াগ্রা টেক্সটাইল ও সদর উপজেলার শিরিরচালা এলাকার এসএম নিটওয়্যার লিমিটেড কারখানা ও পারটেক্স বেভারেজ।

এদিকে গতকাল আগুন দেওয়া বিগবস করপোরেশন লিমিটেড কারখানার কর্মকর্তা ওয়াহেদ খান বলেন, ‘বেক্সিমকো কারখানার শ্রমিকরা বেতন পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে শ্রমিকরা আমাদের কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর চালান। পরে শ্রমিকরা আমাদের কারখানার ওয়্যার হাউজে অগ্নিসংযোগ করেন। সেখানে মূল্যবান ফেব্রিকস রয়েছে। এ ছাড়া এর আশপাশে বসতবাড়ির দোকানপাটও রয়েছে।’

গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন বলেন, ‘বিগবস করপোরেশন নামে একটি কারখানায় আগুন লাগার সংবাদ পেয়ে দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলের দিকে যায়। পরে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আমাদের একটি গাড়ি ভাঙচুর করলে কর্মীরা চলে আসেন। ফের কাশিমপুর ও ডিবিএল ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট তিন ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।’

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, ‘বেক্সিমকো কর্র্তৃপক্ষ বলছে, তারা বেতন দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু শ্রমিকরা তাদের সময়ই দিচ্ছেন না। শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন। আড়ং কারখানা কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। কিন্তু শ্রমিকরা সময় দিচ্ছেন না। তারা বিক্ষোভ করছেন। বিক্ষোভের কারণে জেলায় প্রায় ৩০টির মতো কারখানা গতকালের জন্য ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। আর কয়েকটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।’

আজ শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ : আজ বৃহস্পতিবারের মধ্যে পোশাক শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা হবে বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। একই সঙ্গে পোশাকঘন এলাকা ঢাকার সাভার ও গাজীপুরে চলা শ্রম অসন্তোষের পেছনের প্রকৃত ঘটনা জানতে সরকারের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠনের কথাও জানিয়েছেন তিনি।

বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে জরুরি বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘সাভারের আশুলিয়ায় পোশাক কারখানাগুলোতে যে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, বুধবার রাত কিংবা বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) সকালের মধ্যে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে।’

এজন্য কারখানাগুলোর আবেদনে ব্যাংকগুলোকে দ্রুত অর্থ ছাড়ের নির্দেশনা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকেও সরকারের পক্ষ থেকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন শ্রম উপদেষ্টা।

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!