• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আখ চাষের মাঠ থেকে কিউবা বিপ্লবের নায়ক কাস্ত্রো


রাশেদ শাওন নভেম্বর ২৬, ২০১৬, ০১:০৮ পিএম
আখ চাষের মাঠ থেকে কিউবা বিপ্লবের নায়ক কাস্ত্রো

পুরো নাম ফিদেল আলেসান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ। বিশ্বব্যাপী তিনি পরিচিত ফিদেল কাস্ত্রো নামে। ১৯৫৯ সালে লাতিন আমেরিকার দেশ কিউবাতে সফল বিপ্লবের মাধ্যমে মার্কিন-সমর্থিত স্বৈরশাসক ফালজেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করে দেশটিতে সমাজতান্ত্রিক শাসনের সূচনা করেন। সমর্থকরা কাস্ত্রোকে বলেন, ‘গরীবের ত্রাণকর্তা’। যদিও সমালোচনা আছে তার বিরুদ্ধে। ক্ষমতায় থাকার সময়ে বিরোধীদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছেন বলে অভিযোগ তাদের।

১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট কিউবার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় অরিয়েন্তে প্রদেশে এক স্পেনীয় বংশোদ্ভূত অসচ্ছল অভিবাসী পরিবারে জন্ম ফিদেল কাস্ত্রোর। স্নায়ুযুদ্ধকালীন বিশ্বব্যাপী মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সর্বব্যাপী প্রভাবের মধ্যেও সমাজতান্ত্রিক কিউবাকে টিকিয়ে রেখে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রবাদ পুরুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন তিনি।

কিউবা বিপ্লবের পর থেকে ১১ জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট কাস্ত্রোকে হত্যা কিংবা উৎখাতের পরিকল্পনা করলেও কেউই সফল হতে পারেননি। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) তাকে হত্যার জন্য ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করেছে। তবে প্রতিবারই অক্ষত থেকেছেন কিউবার এই নেতা। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে কিউবাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ফিদেল কাস্ত্রো। পুরো আমেরিকা মহাদেশে তিনি আধিপত্যবাদবিরোধী একটি বলয় গড়ে তুলতে সফল হয়েছেন।

কাস্ত্রোর প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু একটি জেসুইট বোর্ডিং স্কুলে। এরপর মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন তিনি। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও কাস্ত্রো ছিলেন তুখোড়। ১৯৪৪ সালে কিউবার সেরা অলরাউন্ডার স্কুল অ্যাথলেট পুরস্কার পান। আইনের স্নাতক হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করেন।

ফিদেল কাস্ত্রো রাজনীতি বুঝেছেন হাইতির আখ চাষীদের দেখে। এসব চাষী তার বাবার জমিদারিতে চাষাবাদ করত। কিউবার পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা বিরানে বসতি গড়েছিলেন তার বাবা আঙ্গেল কাস্ত্রো। উপনিবেশ কিউবায় দখলদার স্প্যানিশ বাহিনীর অংশ হিসেবে পা রেখেছিলেন আঙ্গেল। ঔপনিবেশিক শক্তি বলে কথা। আঙ্গেল কাস্ত্রো বিরাট জমিদারির মালিক হয়েছিলেন।

কিশোর কাস্ত্রোর একটি ঘোড়া ছিল। নাম কারেতো। ঘোড়ায় চড়ে তিনি রাইফেল নিয়ে শিকারে যেতেন। শিকার ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। আরেকটি শখ ছিল। প্রায়ই তিনি হাইতিয়ান কৃষকদের বাড়ি যেতেন। নিজের বাবার স্টোর থেকে নেয়া ভাউচার কৃষকদের মধ্যে বিলি করতেন। ফিদেলের এসব কর্মকাণ্ডে তার বাবা বিরক্ত হন। ছেলেকে তিনি এলাকা থেকে দূরে সরানোর উদ্যোগ নেন। প্রথমে সান্তিয়াগোর একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি করেন। এর পর আরো দূরের স্কুলে নিয়ে যান। এবার ফিদেলের ঠিকানা হয় বেলেন। ঠিক কিউবার রাজধানীতে।

বেলেন স্কুলে ছিলেন ফাদার লরেন্তে। ফিদেলকে তিনি প্রভাবিত করেছেন। স্প্যানিশ, ইংরেজি ও ইতিহাস ছিল তার পছন্দের বিষয়। কৃতিত্বের সঙ্গে তিনি ১৯৪৪ সালে সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যদিও ফিদেল নিজে বলেছেন, তিনি কখনো ভালো ছাত্র যাকে বলে, তা ছিলেন না।

১৯৮১ সালে কিউবার রাজধানী হাভানায় বক্তব্যদানকালে কাস্ত্রো

বেলেন স্কুল থেকে পাসের পর ফিদেল ইউনিভার্সিটি অব হাভানার আইন বিভাগে ভর্তি হন। চল্লিশের দশকে কিউবা ছিল ছাত্র রাজনীতির উত্তাল অঙ্গন। ফিদেলকে তা দারুণভাবে আকর্ষণ করে। ১৯৪৭ সালে এক ছাত্র সমাবেশে তিনি বলেন, ‘একটি নবীন জাতি কখনো আত্মসমর্পণ করতে পারে না।’ পরের বছর লাতিন আমেরিকান স্টুডেন্ট কংগ্রেসে যোগ দিতে তিনি কলম্বিয়া যান। বোগোতায় তার অবস্থানকালে নিহত হন উদারপন্থী রাজনীতিক হোর্হে গেইতান। গরিবের বন্ধু হিসেবে পরিচিত এ রাজনীতিককে হত্যার ঘটনায় বোগোতা শহরের রাস্তায় রাস্তায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ফিদেল ওই দাঙ্গায় আটকা পড়েন এবং প্রভাবিত হন। জীবনীকার টেড সুলকের ভাষায়, ‘দাঙ্গার ঘটনাটি ছিল ফিদেলের শিক্ষানবিশী। কলম্বিয়ায় তিনি একটি বিপ্লবের উন্মোচন প্রত্যক্ষ করেছিলেন।’

দেশে ফিরে ফিদেল আইনে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু ছোট বয়সেই মনে রাজনীতি গেঁথে নেয়া মানুষটির অন্য পথে চলার সুযোগ ছিল না। ১৯৫২ সালে তিনি কিউবান কংগ্রেস নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঘোষণা করেন। কিন্তু ওই নির্বাচন হয়নি। তার আগেই কিউবায় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে যায়। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ফালজেনসিও বাতিস্তা ওই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পেরে ফিদেল কাস্ত্রো সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেন।

১৯৫৩ সালের জুলাইয়ে তিনি সান্তিয়াগোর গ্যারিসনে হামলা চালিয়ে বাতিস্তাকে উচ্ছেদের চেষ্টা চালান। কিন্তু তার সে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। তিনি গ্রেপ্তার হন। ছাড়া পাওয়ার পর ফিদেল মেক্সিকো চলে যান। সেখানে কিউবার অন্যান্য বিপ্লবীর সঙ্গে তিনি মিলিত হন। পরিচয় হয় আরেকজনের সঙ্গে। আর্জেন্টিনার বিপ্লবী। নাম আরনেস্তো গুয়েভারা বা চে গুয়েভোরা। সবাই মিলে কিউবায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।

বিপ্লব পরিকল্পনায় কাস্ত্রোর প্রথম পদক্ষেপ ছিল মেক্সিকো হতে কিউবায় আক্রমণ চালানো। ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর তারা কিউবার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। পৌছানোর সাথে সাথেই বাতিস্তার সেনাবাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ করে। কাস্ত্রোর ৮২ জন সহযোদ্ধা মারা যান অথবা কারাবন্দী হন। সিয়েরা মস্ত্রা পর্বতমালায় বিদ্রোহীদের ছোট্ট একটা অংশ পুনরায় সংঘবদ্ধ হতে পেরেছিল। সেখানে তারা ২৬ জুলাই আন্দোলনে গেরিলা এবং স্থানীয় লোকদের সহযোগিতা লাভ করেন।

ফিদেলের সেনারা চারদিক দিয়ে রাজধানী হাভানাকে ঘিরে ফেলা শুরু করলে ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি কিউবা ছেড়ে পালিয়ে যান জেনারেল বাতিস্তা। পরে ৯ জানুয়ারি রাজধানী হাভানায় ঢুকে দেশের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহন বরেন ফিদেল কাস্ত্রোর গেরিলারা। আর এরই মধ্যো দিয়ে কিউবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ফিদেল। অবশেষে স্বাস্থ্যগত কারণে স্বেচ্ছায় কিউবার প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে ২০০৮ সালে ভাই রাউলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি।

এরপর থেকে অনেকটা চুপিসারেই ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো। চলতি বছরের এপ্রিলে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে বিরল বক্তব্য দেন তিনি। বক্তব্যে নিজের বার্ধক্যের কথা স্বীকার করে কাস্ত্রো বলেন, তার কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শ এখনো অখণ্ডনীয় এবং কিউবার জনগণই বিজয়ী। শেষ পর্যন্ত বৈচিত্রময় এক জীবনের অবসন ঘটিয়ে শনিবার (২৬ নভেম্বর) পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন কিউবার বিজয়ী জনগণের এই নেতা।

সোনালীনিউজ/ ঢাকা/ আরএস

Wordbridge School
Link copied!