• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
তুরস্ক-ফ্রান্স

একটি ঐতিহাসিক সম্পর্কের পর্যালোচনা


ফরহাদ আহমেদ সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২০, ০১:০০ পিএম
একটি ঐতিহাসিক সম্পর্কের পর্যালোচনা

ঢাকা : তুরস্কের সঙ্গে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর বাগ্যুদ্ধের ফলে আঙ্কারা এবং প্যারিসের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে তা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ম্যাখোঁর ব্যক্তিগত ক্ষোভ বলেই ভাবছেন তুর্কি ইতিহাসবিদদের একাংশ। কেননা আঙ্কারার নীতিনির্ধারকদের বেশিরভাগই মনে করেন, তুরস্কের সঙ্গে সমস্যা আছে কেবল ম্যাখোঁরই, ফ্রান্সের জনগণের নেই।

তুরস্কের সঙ্গে ফ্রান্সের জনগণের যে সমস্যা নেই, এই মনোভাব মূলত তুরস্কের পূর্বসূরীয় অটোমান সাম্রাজ্য এবং ফরাসি রাজতন্ত্রের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক জোটের জন্মের কারণে। যেটি হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে যখন সুলতান সুলাইমান ১৫২৬ সালে মোহাক্স যুদ্ধে হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যকে পরাস্ত করেছিলেন, যা অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের হাবসবার্গের শক্তিশালী মিত্র ছিল। সুলতান সুলাইমানের হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত সেই সময়ের ফরাসি রাজতন্ত্রকে বড় রকমের সহায়তা করেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, যুদ্ধের এক বছর আগে প্রথম ফ্রান্সিসের মা সুলতান সুলাইমানকে একটি চিঠি লিখেছিলেন এবং তার ছেলেকে হাবসবার্গের কারাগার থেকে বের করে এনে দেওয়ার জন্য তার সহায়তা চেয়েছিলেন।

হাবসবার্গের সর্বাধিক মিত্র হিসেবে হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য অটোমানদের হাতে সেবার চরম পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছিল এবং জাগিলোনিয়ান রাজবংশের সমাপ্তি চিহ্নিত করেছিল। হাবসবার্গের রাজা পঞ্চম চার্লস প্রথম ফ্রান্সিসকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই বিষয়টিই বহু শতাব্দী ধরে টিকে থাকা ফ্রাঙ্কো-অটোমান জোটের একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছিল। যদিও একজন মুসলিম সম্রাটের সঙ্গে জোট গঠনের বিষয়টি একজন খ্রিস্টান রাজার পক্ষে বিতর্কিত পদক্ষেপ ছিল, কিন্তু এটি প্রথম ফ্রান্সিসকে তার সাম্রাজ্যের দীর্ঘায়ু বৃদ্ধিতে ভীষণ রকম সহায়তা করেছিল।

ফ্রান্স হাবসবার্গের বিরুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে যেমন সাহায্য চেয়েছিল, তেমনি স্প্যানিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় অটোমান সাম্রাজ্যের সমর্থন থেকে দেশটি উপকৃতও হয়েছিল। এভাবেই অটোমানরাও ইউরোপীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সুযোগ পেয়েছিল। মোহাক্স যুদ্ধের সময় যদি অটোমানরা মধ্য ইউরোপে প্রবেশ না করত, তবে ফ্রান্স হাবসবার্গের আধিপত্যের অধীনে আসতে পারার একটা সমূহ সম্ভাবনা ছিল।

প্রথম ফ্রান্সিসকে বাঁচানোর মাধ্যমে ফ্রাঙ্কো-অটোমান সু-সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল। ১৫২৮ সালে পুনরায় অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের রাজা চার্লস পঞ্চম ফ্রান্সের রাজাকে নতুন করে হুমকি দিতে থাকেন। তারা মনে করেছিলেন এই সময় অটোমানরা আর ফ্রান্স সাম্রাজ্যকে সাহায্য করবে না। ফ্রান্সিস প্রথম আবার সুলতান সুলাইমানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে সুলতান এবারো তাকে সাহায্য করেন। ১৫৩৩ সালে সুলতান সুলাইমান প্রথম ফ্রান্সিসের কাছে এক লাখ স্বর্ণমুদ্রাও প্রেরণ করেছিলেন। এই অর্থের সাহায্যে ফরাসি রাজা ইংরেজ ও জার্মান রাজকুমারদের সঙ্গে কৌশলগত জোট গড়ে তোলেন।

আধুনিক হাঙ্গেরীয় রাজধানী বুদাপেস্টের পশ্চিমাঞ্চল বুদাদের যুদ্ধে অস্ট্রিয়ানরা অটোমানদের হাতে একটি বড় পরাজয়ের মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধে জয়ের ফলে অটোমানরা প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে মধ্য ইউরোপের গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যকে পরাজিত করার পরে সুলতান সুলায়মানের পরবর্তী টার্গেট ছিল ভিয়েনা। ১৫২৯ সালে অটোমানরা ভিয়েনা অবরোধ করে। এর এক দশকেরও কিছু পরে, অটোমানরা আবার ১৫৪৩ সালে ফ্রান্সিসের উদ্ধারে আসে। সুলতান সুলায়মান কিংবদন্তি বার্বারোস হায়রেদ্দিন পাশার নেতৃত্বে নৌবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, বার্বারোস হায়রেদ্দিন পাশাকে পঞ্চম চার্লস নিজের নৌবাহিনীর চিফ অ্যাডমিরাল পদ এবং স্পেনের শাসনকর্তা হওয়ার প্রস্তাব দিয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন।

প্রথম ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পরে, ১৫৫০-এর দিকে, অটোমান সাম্রাজ্য এবং ফ্রান্স স্পেনের বিরুদ্ধে একটি যৌথ সামরিক অভিযান চালিয়েছিল। এজন্য ফ্রান্স তার একটি বন্দরকে অটোমান নৌবাহিনীর কাছে ছেড়েও দেয়। এভাবে স্পেনের বিরুদ্ধে অটোমান নৌবাহিনীর শক্তি থেকে ফ্রান্স উপকৃত হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীজুড়ে অটোমান সাম্রাজ্য কেবল ফ্রান্সকে নিবিড়ভাবে সহায়তাই করেনি বরং হাবসবার্গ সাম্রাজ্যের আক্রমণ প্রতিহত করতে তাদের সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনী প্রেরণ অব্যাহত রেখেছে। ফরাসি রাজা দ্বিতীয় হেনরি সর্বদা অটোমানদের এবং সুলতান সুলায়মানের প্রশংসা করতেন। তিনি সুলতানকে ‘সম্মানিত বন্ধু, মুসলমানদের দুর্দান্ত রাজা, অপরাজিত সম্রাট’ বলে অভিহিত করতেন।

ফ্রাঙ্কো-অটোমান জোটটি নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী ছিল। খ্রিস্টান ও মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে প্রথম অ-আদর্শিক একটি জোট ছিল এটি যা আড়াই শতাব্দীরও বেশি সময় স্থায়ী হয়েছিল এবং এই ফ্রাঙ্কো-অটোমান জোটটির কারণে অস্থির ফরাসি রাজার ওপর অটোমানরা রহমতের প্রতীক হয়ে এসেছিল, যা কার্যকর ছিল নেপোলিয়নের (১৭৯৮-১৮০১) অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত মিশরে অভিযান না হওয়া অবধি।

ফ্রান্স বর্তমানে এথেন্সকে সমর্থন করে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্ক ও গ্রিসের দ্বিপক্ষীয় সামুদ্রিক বিরোধে নিজেকে টেনে এনেছে। ফলে ন্যাটোর মিত্র তুরস্কের বিরুদ্ধে ম্যাখোঁর আগ্রাসী পদক্ষেপ এবং সামরিক হুমকি জোটের পক্ষে বিপর্যয়কর হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। ফরাসি জনগণ এবং নীতিনির্ধারকদের কি উচিত হবে গ্রিসের কাছে অস্ত্র বিক্রির প্রয়োজনে ফ্রান্স এবং তুরস্কের মধ্যে শতাব্দী প্রাচীন সম্পর্ককে শত্রুতায় পরিণত করার অনুমতি দেয়া? এই বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীকালে তুরস্ক ও ফ্রান্সের ঐতিহাসিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেয় তা এখন দেখার বিষয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!