• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নীরবে হাঁটছে বিএনপি


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ২৩, ২০১৯, ০২:৪৪ পিএম
নীরবে হাঁটছে বিএনপি

ঢাকা : নীরব অভিভাবকহীন বিএনপি। ১৭ মাসেও মুক্তি মেলেনি দলীয় চেয়ারপারসনের। দলে নেই সমন্বয়, জোটে নেই বিশ্বাস। ‘মঞ্চ’ থাকলেও তাতেও নিস্তেজতা।

বহু স্বপ্নে ড. কামালের ইশারায় নির্বাচনে গিয়ে বিরোধী দলও হতে পারেনি দলটি। ঘটে রাজনীতির মাঠে লজ্জার পরাজয়।

শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করে নির্বাচনে যাওয়া এবং ভরাডুবির পরও আন্দোলনের ঘোষণা না দেয়ায় নির্বাচনের পর থেকে দলের হাইকমান্ড ও তৃণমূলের সঙ্গে ঘটে বড় দূরত্ব।

তৃণমূলের অভিযোগ ছিলো— নির্বাচনের পর আন্দোলন দিলে দল ঘুরে দাঁড়াতে জনগণকে সম্পৃক্ত করা যেত।

প্রশাসনের মাধ্যমে নির্বাচনে ভোট ডাকাতির যে অভিযোগ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে, আন্দোলন করলে সাধারণ মানুষকে পাওয়া যেত।

ফলাফল ঘোষণার পর আন্দোলনের ডাক দিলে বিএনপির ইমেজ শক্ত থাকতো। আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনে অনেক কষ্ট হতো। যারা ভোট দিতে পারেনি তারাও বিএনপিকে সমর্থন দিতো।

এছাড়াও নির্বাচনে পর্যবেক্ষকরা যেসব অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেছিলেন সেগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালোভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেতো। সবমিলিয়ে কার্যত আন্দোলনের ফলে খালেদা জিয়ার মুক্তির দুয়ার খুলতো।

তাৎক্ষণিক তৃণমূলের এ চাওয়া বিএনপি পূরণ করতে না পারলেও এখন নীরবে রাজকৌশল বেছে নিয়ে হাঁটছে দলটি।

রাজনীতিতে টিকে থাকতে কর্মীদের চাঙ্গা রাখা, দলীয় সম্পদ রক্ষা, নেতাকর্মীদের হামলা-মামলা নির্যাতন থেকে রক্ষায় সমঝোতার পথও বেছে নিয়ে টিকে থাকার কৌশলেই চলছে।

যদিও খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে চলছে দলটির বিভাগীয় সমাবেশ। ১৮ জুলাই বরিশালে, ২০ জুলাই চট্টগ্রামে সমাবেশ শেষ হয়েছে, আগামী ২৫ জুলাই হবে খুলনায়।

বরিশালে প্রথম সমাবেশে ফখরুল ব্যতিত দলের দুই স্থায়ী কমিটির সদস্য ছাড়া অন্য সিনিয়র নেতাদের দেখা যায়নি।

ওই সমাবেশের পর জরুরি স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডাকেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া। প্রথম সমাবেশে সিনিয়র নেতারা কেন অনুপস্থিত ছিলেন তারেক জিয়া জানতে চাইলে অসুস্থ ছিলেন বলে জানান দলের এক স্থায়ী কমিটির সদস্য।

পরে ২০ জুলাই চট্টগ্রামে সবাইকে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেন যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত এই নেতা। সেই প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, মোশাররফ হোসেনসহ সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

চট্টগ্রাম সমাবেশে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলনের দাবি করলেও দলের মহাসচিব ও মোশাররফ হোসেন ছিলেন নীরব। তারা দুজনেই কৌশলে খালেদা জিয়ার অতীত রাজনীতির জীবনী আলোচনা করেছেন।

এ নিয়ে দলের মহাসচিবের ওপর তৃণমূল নেতারাও ক্ষিপ্ত। তারা মনে করছেন, লাখ লাখ লোকের সমাবেশে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সরকারকে কঠিন হুঁশিয়ারি না দিয়ে পুরনো রাজজীবনী আলোচনা করা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।

সমাবেশ হচ্ছে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য, সরকারকে বার্তা দেয়ার জন্য, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই সমাবেশ থেকে সরকারের চরিত্র উপস্থাপনের জন্য। খালেদা জিয়ার জীবনী আলোচনার জন্য নয়। খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়েই তারা বিএনপিতে এসেছেন।

সমাবেশ থেকে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা রাখতে খালেদা জিয়ার মুক্তিতে অন্তত জোশময় ইঙ্গিত চান স্থানীয় শীর্ষনেতারা।

তবে এ নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, সরকার ক্ষমতায় টিকে গেছে, আগামী পাঁচ বছর আওয়ামী লীগ সরকারকে নাড়া দেয়ার ক্ষমতা বিএনপির নেই।

তাই কৌশলে মাঠের কর্মসূচি, দলের কর্মসূচি, জোটের কর্মসূচি, মঞ্চের কর্মসূচি দিয়ে বিএনপির অস্তিত্বকে টিকে রাখাই বিএনপির মূল লক্ষ্য। আর আওয়ামী লীগ সরকারও চলমান পাঁচ বছর শান্ত সময়ে পার করতে চাচ্ছেন।

বিরোধী দলের কেউ আক্রোশে না গেলে সরকারও কোনো রাজনৈতিক দলকে আর হয়রানি করতে চাচ্ছে না। তাই বিএনপি আগামী পাঁচ বছর দল পুনর্গঠনে মনোযোগী হয়েছে। ভবিষ্যৎ ক্ষমতার ছক তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন লন্ডন নেতারা।

বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচনে পরাজয়ের পর পুরনো ছকে আন্দোলনে যেতে চেয়েছিলো বিএনপি।

নির্বাচন বয়কট করে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে রাজধানীসহ দেশব্যাপী বিক্ষোভ, অবস্থান ও গণসংযোগের মতো কর্মসূচি নিয়ে একটি তালিকা তৈরি করেছিলো বিএনপি।

এছাড়া রাজধানীতে বৃহৎ অবস্থান ও কয়েক লাখ লোক নিয়ে নির্বাচনের পরদিনই ঘেরাও কর্মসূচিতে যেতে চেয়েছিলো দলটি।

এ নিয়ে ওইদিনই বিএনপি ও ২০ দলের সিদ্ধান্তের আলোকে আন্দোলনের রূপরেখা ড. কামালকে জানান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

কিন্তু বৃদ্ধ কামাল হোসেন বিএনপিকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন কোনো আন্দোলন কর্মসূচিতে গণফোরাম ও তার পক্ষ থেকে সম্মতি দেয়া সম্ভব নয়।

জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের কোনো অপবাদ মাথায় নেবেন না বঙ্গবন্ধুর এই ঘনিষ্ঠচর। তাই তাৎক্ষণিক মির্জা ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনের সার্বিক বিষয়টি আপাতত পর্যবেক্ষণ করবে ঐক্যফ্রন্ট।

সেই থেকে দীর্ঘ ৭ মাস নীরব থেকে কোনো আন্দোলনে যায়নি দলটি।

বরং ভবিষ্যৎ ক্ষমতার ছকের আলোকে বিএনপির যে কয়েকজন নির্বাচিত হয়েছেন তাদেরকে সংসদে পাঠিয়ে সরকারকে বৈধতা দেয়া হয়।

সেই আলোকেই দলের, জোটের, মঞ্চের সবাইকে নীরব রেখেছেন লন্ডন বুদ্ধিজীবীরা।

সে আলোকেই ২০ দলীয় জোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও জাতীয় মুক্তিমঞ্চ মিলে ২৬টি রাজনৈতিক দলের সব নেতাই নীরব রয়েছেন।

২০ দলীয় জোটের বিএনপি, মকবুল আহমাদ নেতৃত্বাধীন জামায়াত, মাওলানা আব্দুর রকিব নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট, মাওলানা ইসহাক নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস, শায়খ আব্দুল মমিন ও মুফতি ওয়াক্কাস নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের দুটি অংশ, কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বীর বিক্রমের এলডিপি, সৈয়দ মোহম্মদ ইব্রাহিমের বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, মোস্তফা জামাল হায়দার নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), এএইচএম কামরুজ্জামান নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, অ্যাডভোকেট গরীবে নেওয়াজ নেতৃত্বাধীন পিপলস লীগ, ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নেতৃত্বাধীন এনপিপি, ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ লেবার পার্টি।

অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলাম নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ভাসানী, কারি আবু তাহেরের এনডিপি, শাওন সাদেকী নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাপ, সাইফুদ্দিন মণির ডেমোক্রেটিক লীগ, সাঈদ আহমেদ নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, এহসানুল হুদার জাতীয় দল, বাংলাদেশ মাইনরিটি পার্টি, রিতা রহমান নেতৃত্বাধীন পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশ (পিপিবি) এবং আবু তাহের চৌধুরীর ইসলামিক পার্টি।

এদের অনেকেই অতীতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অনুসারী হওয়ায় দীর্ঘ সময় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন, কিন্তু হঠাৎ কোনো এক ইশারায় এরাও নীরব হয়ে যেতে বাধ্য হন।

জামায়াতসহ চারটি দল নিয়ে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বীর বিক্রম গড়ে তুলেছেন ‘জাতীয় মুক্তিমঞ্চ’ নামে আলাদা একটি প্ল্যাটফর্ম। গত ২৭ জুন জাতীয় মুক্তিমঞ্চ আত্মপ্রকাশের সময় জোটের প্রধান উদ্যোক্তা অলি আহমদ বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র এবং খালেদা জিয়ার মুক্তি-ই জাতীয় মুক্তিমঞ্চের প্রধান লক্ষ্য।’

জাতীয় মুক্তিমঞ্চ গঠনের ২৭ দিন পেরিয়ে গেলেও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এখনো পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেননি অলি আহমদ বীর বিক্রম। জোশ নিয়ে ঘোষণা দেয়া কর্নেল (অব.) ড. অলিও কেন নীরব হয়ে গেলেন তা অজানা অনেকেরই।

যদিও এর আগে খালেদাপন্থি এক নেতা প্রকাশ্যে বলেছিলেন, গোঁজামিল দিয়ে চলবে না এখানে, গোঁজামিল বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে ডাকুন মহাসচিব, স্বেচ্ছায় কারাবরণ করবো আমরা। রাজপথে নামুন, কর্মসূচি দিন। দলের স্থায়ী কমিটির দুই নেতাও প্রশ্ন তুলেছিলেন। এখন তারাও নীরব।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দলীয় ফোরামে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে লন্ডনে পলায়নরত তারেক জিয়া এখন সিদ্ধান্তের মালিক।

তারেক জিয়ার নির্দেশেই বিএনপি চলছে। দলে এ নিয়ে অনেক ঝড়ও বইছে। খালেদার মুক্তিতে যাকেই ভূমিকা পালন করতে বলা হয়, তখন সবাই সবকিছু তারেক জিয়ার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন।

অনেক নেতা এভাবেই বলছেন, তারেক জিয়ার সঙ্গে আমার এ বিষয়ে কথা হয়েছে, এ মুহূর্তে দলে আমার কি ভূমিকা থাকা দরকার তারেক জিয়া আমাকে নির্দেশনা দিয়েছেন, আমি সেই মতেই কাজ করছি।

খালেদা জিয়ার মুক্তিতে ভূমিকা পালনের জবাবদিহির জায়গায় এলে স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা ও নির্বাহী সদস্যসহ সবাই এমন উত্তর দিয়ে পাশ কাটছেন।

দলটির নেতাকর্মীদের ভাষ্য, আসলে তারেক জিয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কয়জন নেতার সঙ্গে কথা বলেন এটি নিয়ে সন্দেহের জায়গা তৈরি হয়েছে।

পল্টন অফিসের রিজভীর ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি আমার সংবাদকে এমন তথ্যও দিয়েছেন, মাঝে মধ্যে অনেক জেলা সভাপতিও রিজভী ভাইয়ের কাছে এসে বলেন তারেক জিয়া তার সঙ্গে কথা বলেছেন, কিছু দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছেন।

কিন্তু তারেক জিয়া কী আদৌ এমন নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন কিনা, কিংবা ফখরুলকে এক নির্দেশনা, স্থায়ী কমিটির অন্য সদস্যদের আরেক ধরনের নির্দেশনা, ভাইস চেয়ারম্যানদের সাথে কী আদৌ তারেক জিয়ার কথা হয় কিনা, যখন জেলা সভাপতিও এসে বলেন, তারেক জিয়া তাকে দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছেন এসব কথার সত্যতা কী?

জানেন না কেউ। তবে বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, বিএনপিতে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে এতদিন যাদের আক্রশ ছিলো, তারেক রহমান আগামীর রাজনীতির ভবিষ্যৎ প্ল্যান তাদের জানিয়ে দিয়েছেন। সে জন্যই সবাই আপাতত নীরব আছেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!