• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মানবিকতা হারিয়ে ফেলছি কেন?


রায়হান উল্লাহ জুন ৩০, ২০১৯, ১০:৫৪ পিএম
মানবিকতা হারিয়ে ফেলছি কেন?

ঢাকা : বরগুনার রিফাত হত্যার পর জোরেশোরেই উচ্চারিত হচ্ছে সামাজিকতা কোন পথে যাচ্ছে? প্রকাশ্যে এমন জিঘাংসা কেন? আমরা মানবিকতা হারিয়ে ফেলছি কেন? এতসব প্রশ্নের ভিড়ে ওই হত্যার ভিডিও ক্লিপ দেখলে যে কেউ শিউরে উঠবেন। এ যেন সিনেমার কোনো দৃশ্য। প্রকাশ্য দিবালোকে শত মানুষের ভিড়ে কোপানো হচ্ছে এক তরুণকে। বুক ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে। রক্তে ভিজে যাচ্ছে তার পোশাক। কণ্ঠে বাঁচার আকুতি। তবু কারো কোনো বিকার নেই! এর মাঝে একজন নারী জীবনপ্রাণ চেষ্টা করছেন তাকে বাঁচাতে। তাকে নিয়েও উঠেছে বিতর্ক। যদিও তিনি বীর নারী। কিন্তু পারেননি স্বামীকে বাঁচাতে। এমন উন্মত্ততায় তারও জীবন হরণ হওয়ার কথা।

এর মাঝেই বীরদর্পে পালায় সন্ত্রাসীরা। সিসিটিভির ক্যামেরায় ধারণ হওয়া এই দৃশ্য ছড়িয়ে পড়ে তোলপাড় হয় সারা দেশ।

গত ২৬ জুন বুধবার বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে সংঘটিত নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড নাড়া দেয় সবার বিবেককে। প্রশ্ন একটাই, মানুষ এমন পাশবিক হলো কেমনে?

অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সময় ক্রমশ অস্থিরতা ছড়াচ্ছে। এর মাঝে ক্ষমতার দম্ভও আছে। আছে নেশার কুফল। তারা আরো বলছেন, সমাজে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু রয়েছে। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা বা অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়ার প্রবণতা- এসব নানা কারণে অপরাধ বাড়ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের মধ্যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ বেড়েছে। অহেতুক ঝামেলা এড়াতে চোখের সামনে নৃশংস ঘটনা ঘটলেও তাদের বোধ কাজ করছে না। আধুনিক সমাজব্যবস্থার কারণেও মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে।

অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরনের নৃশংসতা সময়ে সময়ে অহরহ ঘটছে। একটা সময়ে জমি দখল বা চর দখলের জন্য প্রকাশ্যে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের ওপর এমন নৃশংসতা চালাত। সমাজব্যবস্থাও একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক কারণে সমাজে অস্থিরতা বেড়েছে। সেই সঙ্গে অপরাধের ধরনও পাল্টাচ্ছে। সমাজে নানারকম ঋণাত্মক উপকরণ ঢুকে পড়েছে। এ কারণে নৃশংস অপরাধের মাত্রাও বাড়ছে।

তাদের দাবি, প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংস এমন ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক যোগসাজশ থাকেই। ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে অনেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে সহজে। একের পর এক ক্ষমতার অপব্যবহার করে পার পেয়ে যায়। এতে একটা সময় ভয়ংকর হয়ে ওঠে তারা। এসবের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিচার প্রক্রিয়া ও সব ক্ষেত্রেই রাজনীতিকরণ সবচেয়ে বেশি দায়ী।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার কারণে মানুষের মাঝে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ বেড়েছে। আগের মতো ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’ নীতিবাক্য মেনে চলার প্রবণতা আর নেই। কারণ হিসেবে অপরাধবিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করছেন, নগরায়ণ বাড়ছে। মানুষের কাছে অঢেল অর্থ আসছে। প্রতিযোগিতা বাড়ছে। মানুষ নিজেকে বেশি ভালোবাসছে। এছাড়া কারো বিপদে এগিয়ে যাওয়ার পর পুলিশি বা আদালতে গিয়ে হয়রানি হওয়ার উদাহরণও রয়েছে। কিংবা কেউ একটা ভালো কাজ করলে তাকে যথাযথ মূল্যায়ন না করার কারণেও কেউ কারো বিপদে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করছে না। এমনকি অপরাধের পথ খুঁজতে গবেষণা নেই। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যারা কাজ করেন তাদের সঙ্গে একাডেমিক ব্যক্তিবর্গের কোনো যোগাযোগ নেই।

অপরাধবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের প্রধান ড. জিয়া রহমান বলেন, মানুষের মধ্যে দুই ধরনের প্রবৃত্তি থাকে, তার একটি পশুপ্রবৃত্তি। আমাদের মতো সমাজে মানুষের মধ্যে এই ধরনের পশুপ্রবৃত্তি বেশি কার্যকর। যদিও ফ্রয়েডিয়ান থিওরি মতে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই সেটা রয়েছে। এখন এই পশুপ্রবৃত্তি সিভিলাইজড করা বা নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, ওয়েস্টার্ন সোসাইটিতে কিছুটা হয়েছে। তাদের রাষ্ট্রে নীতি এবং রাষ্ট্রের যে আইন তা পরিবর্তন সাপেক্ষে কার্যকর করা এবং একই সঙ্গে সোসাইটির ভেতরের অনুশাসনগুলো ধরে রাখায় তারা মোটামুটি একটা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। আমাদের মতো ট্র্যাডিশনাল সোসাইটিতে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণের অভাব থাকায় সবসময় মানুষের মধ্যে পশুপ্রবৃত্তির রিফ্লেকশনটা বেশি দেখা যায়। অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, এখন সোসাইটির ডাইমেনশন চেঞ্জ হচ্ছে। সোসাইটি ট্রান্সফরমেশনের দিকে যাচ্ছে বা আমরা এখন ট্রানজিশনাল ফেসের মধ্যে আছি। ফলে ধরনটা চেঞ্জ হয়েছে। এখন যে অস্থিরতা, কারণ সমাজের মধ্যে এত বেশি নেগেটিভ এলিমেন্ট ঢুকে গেছে; রাষ্ট্রের ভেতর থেকে এসব নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক যদি না তৈরি করা হয় তাহলে সমাজে তা থাকবেই। এসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে ফ্রম দ্য স্টেট লেভেল ও সোসাইটি লেভেল থেকে।

এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, আগে যদিও এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পেরেছিলাম, এখন তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যাচ্ছে না। বিকজ অব ট্র্যাডিশনাল ল, বিকজ অব ট্র্যাডিশনাল পুলিশ, বিকজ অব ট্র্যাডিশনাল কোর্ট, বিকজ অব ট্র্যাডিশনাল প্রিজন সিস্টেম এবং বিকজ অব ট্র্যাডিশনাল কারেকশন সিস্টেম। আমরা তো আমাদের ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে যে অস্থিরতা দেখছি, সেই অনুযায়ী কিশোর অপরাধ সেন্টার কি বেড়েছে? কিশোর অপরাধীদের কাউন্সেলিং করতে কতটুকু মেকানিজম আমরা তৈরি করতে পেরেছি?

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এবং গণতন্ত্র সংকুচিত হওয়ায় মানুষের যে নৈতিক প্রতিবাদ করার সাহস, সেটি কিন্তু ভোঁতা হয়ে গেছে। সমাজে দুর্বৃত্তরা অনেক অপরাধ সংঘটিত করে, সেটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এটির মাত্রা এবং প্রকাশ্য দিবালোকে যখন প্রতিবাদহীনতা থাকে, অর্থাৎ কোনো প্রতিবাদ হয় না, প্রতিরোধ হয় না, সেটি হচ্ছে ভয়াবহ। দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক চর্চার অনুপস্থিতি, প্রতিবাদ ও যৌক্তিক সমালোচনার অগ্রহণযোগ্যতা সমাজে বা রাষ্ট্রে এ ধরনের অবস্থা তৈরি করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক রাশেদা ইরশাদ নাসির বলেন, সমাজে হিংস্রতা বেড়েছে। হিংস্রতা মানুষের তখনই বাড়ে যখন মানুষের মধ্যে ইমোশন বা ভ্যালুজ কমতে থাকে। মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখতে পাচ্ছি। আমাদের এখন মায়া-মমতা কমে গেছে, আবেগ কমে গেছে। সমাজে অসুস্থ প্রতিযোগিতা বেড়েছে। মানুষের মধ্যে সামাজিক কোনো শিক্ষা নেই মন্তব্য করে এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, মডার্ন সোসাইটিতে মানুষের ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার প্রবণতা বাড়ে। আমাদের এখানে সমাজ পুরোপুরি আধুনিক হওয়ার আগেই আত্মকেন্দ্রিকতার চরমে গিয়ে ঠেকেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, এখন আর মানুষের আত্মশুদ্ধির বিষয় নেই। জীবনযাত্রা ক্রমেই জটিল হয়ে পড়ছে। মানুষের রুচি, স্বভাব ও জীবনযাত্রায় বিকৃতি বাড়ছে। তাদের কোমল অনুভূতি চলে যাচ্ছে, তারা ক্রমেই পাশবিক হয়ে আপন মানুষকে হত্যা করছে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, অনৈতিক লোভ, প্রতিযোগিতা, পরচর্চা ও পরকীয়ার কারণেই পারিবারিক এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, সামাজিক অপরাধ বাড়ার পেছনে হতাশা, পরকীয়া, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যাওয়া, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি দায়ী। একই সঙ্গে প্রযুক্তির কারণে নর-নারীর মধ্যে এখন এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা কাজ করছে। আকাশ সংস্কৃতির কারণে মানহীন অনুষ্ঠান দেখে সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। মানুষের আচরণ ক্রমেই সহিংস হয়ে পড়ছে। আর এ পরিস্থিতিতে অনেকেই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ছে।

বিশিষ্ট গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ব্যক্তি সুবিচার পাবে না মনে করে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। জনতা পথের মধ্যেই শাস্তি দিয়ে দেয় অপরাধীকে, পুলিশের ওপর আস্থা না থাকার কারণে। মানুষকে দেবতা বলা অন্যায়। মানুষের মধ্যে একটি ইতর প্রাণী আছে। সেই প্রাণীটি বড়ই স্বার্থপর, সে অন্যেরটা ছিনিয়ে নিতে চায়, হিংসা করে, কাতর হয় ঈর্ষায়। পীড়ন করে দুর্বলকে। অপরাধের বীজ রয়েছে ওই স্বভাবের ভেতরেই। সেটা ঠিক। কিন্তু ঠিক এটাও যে মানুষের মধ্যে মহত্ত্বও রয়েছে। সেই মহত্ত্বকে বিকশিত করার জন্যই সমাজ। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে আইন, আছে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা। সমাজ যদি মানুষকে মানুষ করে না তোলে তবে সে অপরাধী, রাষ্ট্রও অপরাধী সেই সঙ্গে।

সমাজে যদি অন্যায় থাকে এবং অন্যায়ের যদি শাস্তি না হয়, তাহলে মানুষের মানুষ হওয়া কঠিন হয়। সহজ হয় অপরাধী হওয়া। তিনি আরো বলেন, জেলখানা সংশোধনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে না। বরঞ্চ উল্টো দায়িত্ব পালন করে। কয়েদির গায়ে এমন দুরপনেয় ছাপ মেরে দেয় যে সে যখন বেরিয়ে আসে তখন উন্নত নয়, অবনত হয়েই বের হয়। সমাজে সে সম্মান পাবে আশা করে না। কেউ তাকে বিশ্বাস করতে চায় না। কাজ দেয় না। ফলে আবার সে অপরাধ করে। আবার জেলে যায়। আর নিবারণ? কারাভোগীর সংখ্যা তো শুধু বাড়ছেই, তাতে তো প্রমাণিত হচ্ছে না যে দণ্ড পেয়ে কয়েদি ভীত হচ্ছে কিংবা অন্যরা অপরাধ করতে ভয় পাচ্ছে।

কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, সন্তানকে সময় ও সঙ্গ দিতে হবে, বয়ঃসন্ধিকালে তাদের চলাফেরা, সঙ্গীদল, আচরণ, কথাবার্তার দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে। স্কুলে তাদের আনন্দময় সৃজনশীল চর্চার অবকাশ দিতে হবে। সমবয়সীদের সঙ্গে সুস্থ বিনোদন, নির্মল আনন্দ ও সৃজনশীল দলীয় কাজে উৎসাহ দিতে হবে। সরকারকে পরীক্ষামুখী মুখস্থবিদ্যার শিক্ষা থেকে সরে এসে সত্যিকারের পঠনপাঠনের জগৎ খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। অভিভাবককে অভিভাবকত্বের যথার্থ সমসাময়িক পাঠ নিতে হবে। পুলিশ বা বিচারক, বিধান বা উপদেশ, আইন বা ধমক, জেল বা বেতের বাড়ি বর্তমান সংকট থেকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে না বলে মত তার।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!