• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিয়ের দিন আমি গণধর্ষণের শিকার হয়েছি


ফিচার ডেস্ক জুলাই ৩, ২০১৭, ০১:০৯ পিএম
বিয়ের দিন আমি গণধর্ষণের শিকার হয়েছি

ঢাকা: ‘সেই দিনটি হয়তো আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন হতে পরতো। কারণ, পছন্দের পুরুষটির সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু, দিনটিই হলো আমার জীবনের কাল। হবু স্বামী কিছু পোশাক ছিলো আমার কাছে; তাকে পোশকগুলো দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম রাস্তায় একটি লোক গাড়ির বনেটের ওপর বসে আছে। হঠাৎ পেছন থেকে সে আমাকে জাপটে ধরে। জোর করে গাড়ির পেছনের সিটে তুলে নেয়। গাড়ির ভেতরে আরও দুজন ছিল। আমাকে তুলে নিয়েই গাড়ি ছেড়ে দিল তারা। মনে হয় এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটি। আমার মুখের ভেতরে কাপড়ের টুকরো ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমি ক্রমাগত হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করার চেষ্টা করছিলাম। কাপড়টা কোনোক্রমে মুখ থেকে বের করেই চিৎকার করে বললাম, আজ আমার বিয়ের দিন। কিন্তু তারা কোনো কথা শুনল না। উল্টো আমাকে বলল, মেনে নাও নয়তো মারা যাবে। এরপর তারা একে একে আমাকে ধর্ষণ করে। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে মারাই যাব। তবে বাঁচার চেষ্টাও করছিলাম। বাঁচার জন্য একজনকে খুব জোরে লাথি মারি। সে যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে এবং আমার পেটে ছুরি মারে। এরপর তারা দরজা খুলে চলন্ত গাড়ি থেকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেয় আমাকে।’

এভাবেই তার জীবনের ট্রাজেডি বর্ণনা করছিলেন টেরি অপুদো। বর্তমান নাম টেরি গোবাঙ্গা। নাইরোবির এই তরুণী যাজকের জীবনে আছে দুটি ভয়ানক ট্রাজেডি। তবে তাকে জীবনের সেই দুর্বিষহ ঘটনাগুলো কিছুতেই দমাতে পারেনি। বরং প্রেরণা জুগিয়েছে।

মৃত স্বামী হ্যারির সঙ্গে বিয়ের দিন টরি।

বর্তমানে ধর্ষণের শিকার নারীদের নিয়ে কাজ করেন টেরি গোবাঙ্গা। এজন্য একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। ধর্ষণের শিকার নারীদের নতুন করে বাঁচতে শেখান টেরি। তাদের শেখানো হয়- ধর্ষণের জন্য তিনি দায়ী নন। তিনি ঘটনার শিকার একজন ভুক্তভোগী। নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘ক্রলিং আউট অব ডার্কনেস’ নামের একটি বইও লিখেছেন এই নারী। সেখানে তার মতো নির্যাতিত নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প তুলে ধরেছেন।

টরির জীবনে প্রথম ট্রাজেডি তার ভাষায়, ‘সেদিন ছিল আমার বিয়ে। আমি যাজক হওয়ায় গির্জার সব সদস্য এবং আমার আত্মীয়রা বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিল। আমার হবু স্বামী হ্যারি ও আমি বিয়ে নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত ছিলাম। নাইরোবির ‘অল সেইন্টস গির্জায়’ বিয়ে হতে যাচ্ছিল আমাদের। বিয়ের জন্য একটি সুন্দর পোশাকও ভাড়া নিয়েছিলাম।’

কিন্তু বিয়ের আগের রাতে হঠাৎ টেরির মনে পড়ে, হবু স্বামী হ্যারির কিছু পোশাক তার কাছে আছে। এর মধ্যে ছিল একটি টাইও। টেরির ভাষায়, ‘বিয়ের দিন ভোরে হ্যারিকে পোশাকগুলো দিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার এক বন্ধুও এতে রাজি হলো। বলল, সে নিজেই পোশাকগুলো নিয়ে যাবে। সূর্য ওঠার পর আমরা বেরিয়ে পড়ি। বন্ধুটিকে কাছের বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিই আমি।’

এরপরের ঘটনা ওরা আমাকে ধর্ষণের পর দরজা খুলে চলন্ত গাড়ি থেকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেয় আমাকে। নাইরোবির বাড়ি থেকে কয়েক মাইল দূরের রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলেন টেরি। অপহরণের প্রায় ছয় ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছিল। এরইমধ্যে একটি শিশু তাকে দেখতে পায়। শিশুটি নিজের দাদিকে ডেকে আনে। এরপর আরও অনেক মানুষ জড়ো হয় সেখানে। পুলিশে খবর দেয়া হয়। মৃত মনে করে পুলিশ টেরিকে একটি কম্বলে জড়িয়ে মর্গে নেয়ার প্রস্তুতি শুরু করে। কিন্তু নেয়ার পথে হঠাৎ কাশতে শুরু করেন টেরি। তখনই গাড়ি ঘুরিয়ে কেনিয়ার সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতালে নেয়া হয়।

স্বামী টনির সঙ্গে টরি।

টেরি বলেন, ‘আমি প্রায় অর্ধনগ্ন ও রক্তাক্ত ছিলাম তখন। বিড়বিড় করে কী যেন বলছিলাম। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক কোনও কারণে বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি কনে। তখনই বিভিন্ন গির্জায় খোঁজ নেয়া শুরু হয়। ঘটনাক্রমে প্রথমেই তারা ফোন করেন অল সেইন্টস গির্জায়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা মা-বাবা ও হ্যারিসহ সবাই হাসপাতালে ছুটে আসে।’

তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদকেরাও হাসপাতালে ভিড় করেছিলেন। এ কারণে টেরিকে সরিয়ে নেয়া হয় পাশের আরেকটি হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকেরা তাকে শোনান আরেক ভয়ংকর সংবাদ। ছুরির আঘাতে গর্ভাশয় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আর মা হতে পারবেন না টেরি। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে যা করা হয়েছে, তা মেনে নিতে পারছিলাম না। এইচআইভি বা এইডস রোগ থেকে বাঁচার জন্য নিয়মিত ওষুধ খেতে হচ্ছিল। হ্যারি বারবার বলছিল, সে আমাকেই বিয়ে করতে চায়।’ তিন মাস পর চিকিৎসকরা জানান, টেরির এইডস হওয়ার ঝুঁকি নেই।

তবে পুলিশ ধর্ষকদের গ্রেফতার করতে পারেনি। টেরি বলেন, ‘আমি দিনের পর দিন সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করতে থানায় গিয়েছি। কিন্তু কাউকেই চিনতে পারিনি। বারবারই মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হতাম। এতে আমার পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও পিছিয়ে যায়। শেষে একদিন থানায় গিয়ে পুলিশকে বললাম, আমি আর পারছি না। আমি এই ঘটনা ভুলে যেতে চাই।’

ধর্ষণের সাত মাস পর, ২০০৫ সালের জুলাই মাসে হ্যারির সঙ্গেই বিয়ে হয় টেরির। কিন্তু বিয়ের ২৯ দিনের মাথায় মারা যান হ্যারি। শুরু হয় টেরির জীবনের আরেক দুঃসহ অধ্যায়। এই নারী বলেন, ‘আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। মাত্র এক মাস আগেই সাদা গাউন পরে যে গির্জায় আমার বিয়ে হয়, সেখানেই আমি হাজির হয়েছিলাম কালো রঙের পোশাক পরে। আশপাশের মানুষ আমাকে অভিশপ্ত মনে করছিল। কেউ তাদের সন্তানকে আমার কাছে আসতে দিতো না। এক পর্যায়ে আমিও নিজেকে অভিশপ্ত বলেই ভাবতে শুরু করলাম।’ অথচ ময়নাতদন্তে দেখা গেছে, ঘরের ফায়ার প্লেসে কয়লা পুড়ে বেশি কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হওয়ায় শ্বাসকষ্টে মারা গিয়েছিল হ্যারি। ওই সময় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন টেরিও।

হ্যারির মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন টেরি। আর বিয়ে করবেন না বলেও মনস্থির করে ফেলেন। কিন্তু হঠাৎ তার জীবনে আসে আরেক পুরুষ টনি গোবাঙ্গা। টেরিকে তিনি জীবনের ভালো ঘটনাগুলো মনে করার পরামর্শ দেন। একসময় বিয়ের প্রস্তাব দেন টনি। কিন্তু এ নিয়ে টনিকে আরও ভেবে দেখার জন্য বলেন টেরি। তিনি যে সন্তানের জন্ম দিতে পারবেন না, সেটিও জানান টনিকে। টনির মা-বাবাও টেরির অতীত জেনে বিয়েতে রাজি ছিলেন না। অবশ্য শেষ পর্যন্ত টনি সবাইকে রাজি করাতে পেরেছিলেন। টেরি জুটিবদ্ধ হন টনির সঙ্গে।

দুই মেয়ের সঙ্গে টরি।

এরপর আসে আরও একটি খুশির সংবাদ। এক বছর পর একদিন চিকিৎসক টেরিকে জানান, তিনি মা হতে চলেছেন। একটি কন্যাসন্তান হয় টেরির। নাম রাখেন তেহিলে। চার বছর পর আরেকটি কন্যাসন্তান হয় টনি-টেরি দম্পতির। এখন এই দুই সন্তানকে নিয়েই তাদের সুখের সংসার।

টেরি বলেন, ‘আমাকে যারা আক্রমণ করেছিল, তাদের আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। এটি সহজ ছিল না। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এমন মানুষদের জন্য আমি নিজেই কষ্ট পাচ্ছিলাম। অথচ তাদের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই! আমার বিশ্বাস আমাকে ক্ষমা করতে অনুপ্রাণিত করেছে। খারাপের প্রতিরোধ খারাপ দিয়ে হয় না; ভালো কাজ দিয়ে করতে হয়।’ সূত্র: বিবিসি

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এআই

Wordbridge School
Link copied!