• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভূগর্ভে মহাসাগর, অথচ পানি নেই তৃষ্ণার্ত ফিলিস্তিনিদের


আন্তর্জাতিক ডেস্ক আগস্ট ৩, ২০১৬, ১১:৫৫ এএম
ভূগর্ভে মহাসাগর, অথচ পানি নেই তৃষ্ণার্ত ফিলিস্তিনিদের

ফিলিস্তিনের সালফিত এলাকার বাসিন্দা ওয়ালিদ হাবিব। বাড়ির ছাদে থাকা পানির ট্যাংকটি পূর্ণ করতে প্রতি সপ্তাহে তাকে ৩০০ শ্যাকেল বা ৭৫ ডলার গুণতে হয়। যে পশ্চিম তীরের মানুষের মাসে গড় মজুরি মাত্র ৫০০ ডলার, সেখানে পানির জন্য এ পরিমাণ খরচ বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। কিন্তু চারদিকে যখন পানির জন্য হাহাকার, তখন অন্য উপায়ও নেই তাদের সামনে।

বেশ কিছুদিন ধরেই এমন পানিশূন্য পরিস্থিতিতে দিন কাটাচ্ছে ফিলিস্তিনের সালফিত ও আশেপাশের এলাকার মানুষ। রমজান মাসের ছুটি শুরু হওয়ার আগে থেকেই সংকটের শুরু। তখন থেকেই কলের পানির বেগ কমতে থাকে। শীতকালীন বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত তা চলতে থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। গ্রীষ্মকালে ফিলিস্তিনের সালফিত কিংবা আশেপাশের এলাকায় খরা পরিস্থিতি নতুন কিছু নয়। তবে এবারের মৌসুমে খরার চিত্র ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। গত জুনে ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় পানি সরবরাহকারী কোম্পানি দখলকৃত পশ্চিম তীরে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার পর এ সংকট ঘনীভূত হয়।

পানির জন্য ফিলিস্তিনের মানুষের হাহাকার ও সংগ্রাম এবং বিপরীতে ইসরায়েলিদের শোষণ-বঞ্চনাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট। ফিলিস্তিনের ভূগর্ভে সমুদ্র সমান পানি থাকার পরও যথাযথ প্রযুক্তির ব্যবহার না থাকা এবং দেশটির প্রতি ইসরায়েলের বঞ্চনা ও শোষণের মনোভাবকেই এ সংকটের জন্য দায়ী করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

যে প্রক্রিয়ায় পানিকে ব্যবহার উপযোগী করে ইসরায়েল : একসময় ইসরায়েলিরা তাদের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক সংরক্ষণাগার দ্য সী অব গ্যালিলির পানিসীমার ওপর নিজেদের প্রভাব জারি রাখতো। দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনটি প্রকাশের আগ পর্যন্ত এ সংরক্ষণাগারের পানি ‘রেড লাইন’ থেকে মাত্র ১১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। রেড লাইন হলো সে পয়েন্ট যেখানে ইসরায়েল বাস্তুসংস্থানগত ক্ষতি এড়াতে পানি শোধনের কাজ বন্ধ করে দেয়। ইসরায়েলের বেশিরভাগ পানি কৃত্রিম উপায়ে উৎপাদিত হওয়ার কারণে তা এখনও জন-উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠতে পারেনি। ইসরায়েলের এক তৃতীয়াংশ পানি আসে ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্টস বা নির্লবণীকরণ প্রক্রিয়া থেকে। আর এ প্রযুক্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তিগুলোর একটি। কৃষকরা সেচের জন্য শোধনকৃত পানির ওপর নির্ভর করে। নষ্ট হয়ে যাওয়া পানির ৮৬ শতাংশকে আবারও ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে সক্ষম হয় ইসরায়েল। যা বিশ্বের যে কোনও জায়গা থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ। আর স্পেন ২০ শতাংশ পানি পুনর্ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে পারে। সেদিক থেকে স্পেনের অবস্থান দ্বিতীয়।

পানি নিয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলি বঞ্চনা : ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীর এবং গাজা দখল করার পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের খাবার পানির জন্য ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে উপরে উল্লিখিত উচ্চ প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাগুলো ফিলিস্তিনিদের জন্য কোনও কাজে আসে না। কেননা তারা ইসরায়েলের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত নয়। আর তাই তারা তথাকথিত ‘মাউন্টেন অ্যাকুইফার’ ব্যবস্থা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের দখলে যাওয়া ফিলিস্তিনি এলাকাগুলোর ভূগর্ভে এ ‘মাউন্টেন অ্যাকুইফার’ ব্যবস্থা রাখা আছে। ১৯৯৫ সালে অসলো চুক্তি অনুযায়ী, ওই অ্যাকুইফার থেকে উৎপন্ন পানির ৮০ ভাগ ইসরায়েলের, আর বাকি পানি ফিলিস্তিনিদের বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলা হয়। ৫ বছরের অন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ওই চুক্তি করা হলেও শিগগিরই তা ২১ বছর পূর্ণ করবে। এ সময়ের মধ্যে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে প্রায় ৩০ লাখে দাঁড়িয়েছে। অথচ জনসংখ্যার গতির সঙ্গে মিলিয়ে পানির বরাদ্দ বাড়েনি। দিনে দিনে ফিলিস্তিনে অবৈধভাবে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যাও দ্বিগুণ হয়েছে। সেদিক থেকে ইসরায়েলিরা নিজেরাই পানির সংকটে পড়েছে। যেসব এলাকা জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত নয়, সেখানে বসবাসরত ইসরায়েলিদেরকেও দীর্ঘ খরা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। অবশ্য, ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তির মাত্রাটা অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশে ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১০০ লিটার পানি সরবরাহের কথা বলা হলেও তারা প্রতিদিন গড়ে ৭৩ লিটার পানি পান।

ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি : ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের খনন করা কূপ থেকে প্রতিদিন সকালে ট্রাকে করে পার্বত্য এলাকা সালফিত ও আশেপাশের গ্রামে পানি নিয়ে আসা হয়। এ পানি সরবরাহের পরিমাণ খুব সীমিত এবং সবসময় লোকজন তাদের নূন্যতম সাপ্তাহিক বরাদ্দটুকুও পায় না। এ ব্যাপারে আক্ষেপ করে সালফিতের বাসিন্দা ওয়ালিদ হাবিব বলেন, ‘সালফিতের নিচে পানির সাগর, অথচ আমরা গোসলের পানিও পাই না। এটা খুবই কষ্টের।’ পাহাড়ের নিচে একটি ট্যাক্সি কোম্পানির অবস্থান। সেখানকার শ্রমিকদের জন্য চা ফুটানোর পানি নেই। তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো অফিসের বাথরুম নিয়ে। পানির অভাবে টয়লেটগুলো শুষ্ক অবস্থাতেই রাখতে হয়, ফ্লাশ করার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে একজন মজা করে বলেন, ‘আমাদেরকে বোধহয় এ গ্রীষ্মে গ্যাসের চেয়ে ডেটলের পেছনেই বেশি খরচ করতে হবে।’ গাজার পরিস্থিতিও ভয়াবহ বলা চলে। উপকূলীয় অ্যাকুইফারটির (ভূগর্ভস্থ পানি) প্রায় গোটাটার ওপরই গাজার অবস্থান। সঠিক নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব ও কৃষিজনিত দূষণ প্রতিরোধ না করতে পারার কারণে কয়েক বছর ধরেই এ এলাকা দূষণ মোকাবেলা করছে। গাজার পানির কল থেকে যে ধরনের উপাদান বের হয়ে আসে সেগুলো লবণাক্ত। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ২০২০ সাল নাগাদ অ্যাকুইফারটি এমন ক্ষতির শিকার হবে যা থেকে উত্তোরণের সুযোগ থাকবে না।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন আলোচনায় ব্যর্থতা : ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর ফিলিস্তিনিদের কাছে ৬৪০ লাখ ঘনমিটার পানি বিক্রি করে। ইসরায়েলের দাবি, এমনটা করতে গিয়ে তাদের নিজেদেরকেই পানির স্বল্পতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। পানিবিষয়ক একটি যৌথ কমিটির বৈঠকের মধ্য দিয়ে এ সংকটের সমাধান করার কথা থাকলেও পাঁচ বছরে তারা একবারও মিলিত হতে পারেনি। এর জন্য এক পক্ষ আরেক পক্ষকেই দোষ দিয়ে থাকে। তাছাড়া ফিলিস্তিনিদের কেউ কেউ পানি সংকটের জন্য নিজেদের সরকারকেই দায়ী করে থাকেন। তাদের অভিযোগ, প্রশাসনিক রাজধানী রামাল্লায় পানি সরবরাহ ঠিক রেখে বাকি এলাকার সমস্যাগুলো এড়িয়ে চলে সরকার। সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!