• ঢাকা
  • সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
SonaliNews

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত নিউজ পোর্টাল

স্বাস্থ্যের দুর্নীতি বন্ধে ধরতে হবে রাঘববোয়ালদের


নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ২, ২০২০, ০৭:৫৩ পিএম
স্বাস্থ্যের দুর্নীতি বন্ধে ধরতে হবে রাঘববোয়ালদের

ঢাকা : দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে সব সময়। বিভিন্ন সময় দুর্নীতির ঘটনায় আলোচনায় এসেছে এ মন্ত্রণালয়। তবে করোনাকালে দুর্নীতির ঘটনা আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এত দুর্নীতি নিয়ে একটা মন্ত্রণালয় কী করে টিকে আছে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। বিশিষ্টজনদের মতে, দুর্নীতি বন্ধ করতে পেছনে থাকা রাঘববোয়ালদের ধরতে হবে। তাদের যদি না ধরা যায়, তাহলে ড্রাইভার মালেকের মতো চুনোপুঁটিদের ধরে লাভ নেই।

দুর্নীতির পেছনে থাকা লোকরা অজস্র মালেক তৈরি করবে। ড্রাইভার মালেক এমনি এমনি মালেক সাহেব হয়ে ওঠেননি। তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে মালেক সাহেব বানানো হয়েছে। দুর্নীতির মূল উৎপাটন করতে না পারলে ভবিষ্যতে আরো মালেক তৈরি হবে। সিন্ডিকেটের কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি শাখায় এখন দুর্নীতি। স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান জানান, শুধু একজন মালেকই নয়, আরো অনেক মালেক হয়তো এখানে আছে। আমরা তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছি। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতিকে যে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে তার দৃষ্টান্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক মালেক।  সত্যিকার অর্থেই যদি বিচার করতে হয় তাহলে এর গভীরে যেতে হবে। যাদের সুরক্ষায় থেকে মালেক ড্রাইভার মালেক সাহেব হয়েছেন তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। করোনার শুরুতে চিকিৎসকদের জন্য নকল এন-৯৫ মাস্ক, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী নিয়ে কেলেঙ্কারির কথা সবার জানা। একে একে সে তালিকায় যোগ হয়েছে ছয় বছর ধরে লাইসেন্সবিহীন রিজেন্ট হাসপাতালের করোনা সার্টিফিকেট বাণিজ্য, জেকেজির নমুনা পরীক্ষার নামে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার মতো ঘটনা। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নেয়। চলে যেতে হয় স্বাস্থ্য সচিবকে। পদত্যাগ করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সরিয়ে দেওয়া হয় অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক, বদলি করা হয় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবসহ অনেককেই।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে টিআইবির করা জরিপে স্বাস্থ্যখাতকে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেখানে অংশ নেওয়া ৪২ দশমিক পাঁচ শতাংশ মানুষ জানান, সেবা নিতে গিয়ে তারা ঘুষ দিয়েছেন। চলতি বছরে করোনার শুরুতে এক গবেষণা প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, সংক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে অসহায় বা দরিদ্র মানুষকে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রভাব পড়ছে। মানহীন মাস্ক-পিপিই পাঁচ থেকে ১০ গুণ দামে সরবরাহ করা হয়েছে। তবে সব দুর্নীতি ছাড়িয়ে যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অবদুুল মালেকের শত কোটি টাকার দুর্নীতি সামনে আসায়। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এএইচএম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক অবদুুল মালককে গত ২০ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করে র্যাব।

১৯৮৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলে ড্রাইভার হিসেবে চাকরি শুরু করেন মালেক। তার প্রথম স্ত্রী নার্গিস আক্তারের নামে তুরাগ থানাধীন দক্ষিণ কামারপাড়া রমজান মার্কেটের উত্তরপাশে ছয় কাঠা জায়গার ওপর সাততলার (হাজী কমপ্লেক্স) দুটি আবাসিক বিল্ডিং রয়েছে। দুই ভবনে মোট ২৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়া আনুমানিক আরো ১০/১২ কাঠার প্লট রয়েছে। ধানমন্ডির হাতিরপুল এলাকায় ৪.৫ কাঠা জমিতে একটি নির্মাণাধীন ১০তলা ভবন আছে। মেয়ে বেবির নামে দক্ষিণ কামারপাড়া, ৭০, রাজাবাড়ী হোল্ডিংয়ে প্রায় ১৫ কাঠা জায়গার ওপর ‘ইমন ডেইরি ফার্ম’ নামে একটি গরুর খামার রয়েছে। সেখানে প্রায় ৫০টি বাছুরসহ গাভি রয়েছে।

এদিকে, গত এক বছর ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৪৫ জনের অবৈধ সম্পদের উৎস খুঁজছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এই তালিকাতে অধিদপ্তরের ১২ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্য রয়েছেন ২০ জন। টিআইবির পরিচালক স্বাস্থ্যখাতের বীভৎস দুর্নীতির উদাহরণ ড্রাইভার মালেক ও আবজাল, উল্লেখ করে বলেন, আমি মোটেই অবাক হইনি। কারণ, এসব দুর্নীতি ঘটতে দেওয়া হয়েছে, তৈরি করা হয়েছে। আর এটা করা হয়েছে প্রভাবশালী মহলের সুরক্ষায়, যোগসাজশে, আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে ও অংশগ্রহণে।

যাদের প্রভাবে কিংবা অংশগ্রহণে এসব ড্রাইভার দুর্নীতি করে তাদের ‘বড়জোর’ বদলি করা হয় অথবা পদত্যাগ করে। এর বাইরে তাদের কিছুই হয় না। কিন্তু এর ফলে রাঘববোয়াল বা রুই-কাতলারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে আর ড্রাইভার মালেকের মতো লোকদের টানাহেঁচড়া করা হয়। কারণ সত্যিকার অর্থেই যদি বিচার করতে হয় তাহলে এর গভীরে যেতে হবে।

দুর্নীতিকে যে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে তার দৃষ্টান্ত মালেক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতিতে শূন্য সহনশীলতার কথা বলেছেন। একে রাজনৈতিক সদিচ্ছার দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখি, তাহলে সেটা আমরা পেয়েছি। কিন্তু যারা একে বাস্তবায়ন করবেন তাদের একাংশ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, দুর্নীতিতে লাভবান, তাদের একাংশ সিন্ডিকেটের অংশীদার। আর যারা দুর্নীতিতে জড়িত, তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে, মালেকের মতো চুনোপুঁটিকে নয়। এর জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কার্যকর করতে হবে। স্বাধীন নিরপেক্ষ হিসেবে কাজ করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

এত এত দুর্নীতির দায় কোনোভাবেই মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন চিকিৎসক নেতা অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান। দুর্নীতির লাগাম টানার জন্য রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় আনতে হবে। স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি আগেও ছিল, এখন করোনার সময়ে বিভিন্ন বিষয় সামনে আসাতে সেসব সবাই জানতে পারছে। স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি একটা ইনস্টিটিউশনালাইজড হয়ে গেছে। এজন্য সিস্টেমকে পরিবর্তন করতে হয়, আপডেট করতে হয়−যেটা এখানে হয়নি, হচ্ছে না। স্বাস্থ্যখাতের মতো মৌলিক অধিকারে সাধারণ মানুষ যেন সাফার না করে সেটা মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। অথচ সেটা হয়নি। মালেকের মতো লোকেরা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতায়িত হয়ে যায় ক্ষমতাবানদের দ্বারা। কারণ দুর্নীতির মূল জায়গা হচ্ছে ক্ষমতা। যদি ক্ষমতা না থাকে তাহলে দুর্নীতি করা যায় না। মালেকের মতো লোকেরা কোনো না কোনো ফার্মে সেই পাওয়ার বা ক্ষমতার সঙ্গে থাকা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক করে নেয়। একইসঙ্গে এদের মোবিলিটি অনেক বেশি যার ফলে তারা একটি চক্র তৈরি করতে পারে। যখন একটি চক্র তৈরি হয়ে যায় তখন তাদের জন্য দুর্নীতি খুব সহজ হয়ে যায়।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন সেগুলো প্রশংসনীয়। কিন্তু দুর্নীতিতে যারা সামনে রয়েছে, যেমন- সাবরিনা, মালেক, সাহেদ−তারা সম্মুখভাগের দুর্নীতিবাজ। কিন্তু এদের পেছনে যারা মাস্টারমাইন্ড, তাদেরকে যদি না ধরা যায় কিংবা তাদেরকে যদি ট্রেস না করা হয়, তাহলে এই দুর্নীতি নির্মূল হবে না। এই মালেক-সাহেদরাই সবসময় ধরা খাবে, পরে আবার এরকম মালেক-সাহেদ-সাবরিনা তৈরি হবে। কিন্তু এদেরকে যারা তৈরি করে, কাজ করায়, তাদের ধরতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!