ঢাকা : হাজারো স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার শুরুতেই হোঁচট খেতেন শিক্ষার্থীরা। দূর-দূরান্ত থেকে এসে হলে উঠতে ধরতে হতো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের।
সংগঠনগুলোও তাদের দলে যোগ দেওয়ার শর্তে নবীন শিক্ষার্থীদের প্রথমে তুলত গণরুমে। নিয়মিত সংগঠনের মিছিল-সমাবেশে অংশ নিতে হতো তাদের। রাতে হাজিরা দিতে হয় গেস্টরুমে। রাতভর ম্যানার শেখানোর নামে চলত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। আবার কোনো নেতা নাখোশ হলে অসহায়ের মতো বেরিয়ে যেতে হতো হল থেকে। বলার বা করার কিছুই থাকত না।
দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিকতার এমন চিত্র অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পরও নিয়মবহির্ভূতভাবে কক্ষ দখল করে আয়েশে দিনাতিপাত করতেন নেতারা। বিশেষ করে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরেই এটি বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের চিত্র।
অবশ্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পরিস্থিতি বদলে গেছে। সিটবাণিজ্য বা সিটের জন্য শিক্ষার্থীদের জিম্মি করার অপসংস্কৃতিও দূর হয়েছে। এখন সিট বরাদ্দ হচ্ছে মেধার ভিত্তিতে। আবাসিক হলে ফিরেছে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণও। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরেছে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ।
ক্যাম্পাসে নেই ছাত্রলীগের অস্ত্রের ঝনঝনানি, মারধর, হানাহানি, হুমকি-ধমকি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি বা নারী শিক্ষার্থীকে লাঞ্ছনার মতো ঘটনা। সব মিলিয়ে নতুন এক বিশ্ববিদ্যালয় দেখছেন শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের মধ্যে ৫টি মেয়েদের, ১৩টি ছেলেদের। মেয়েদের হলগুলোয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও ছেলেদের হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ কার্যত ছিল ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের হাতে। তাদের হাত ধরে হলে ওঠার সুযোগ পাওয়ার পর স্থান হতো গণরুমে। গণরুমে প্রথম বর্ষের অনেক শিক্ষার্থীকে গাদাগাদি করে থাকতে হতো। কোনো কোনো গণরুমে ৪০ থেকে ৫০ জন শিক্ষার্থী থাকতেন। এরপর শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে হতো। এর ব্যত্যয় ঘটলেই নির্যাতন এবং হল থেকে বের হয়ে যেতে হতো। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
তবে অভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে সুবাতাস বইছে। আবাসিক হলগুলোয় ফিরেছে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ। হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রভোস্টরাই বণ্টন করছেন সিট। আবাসিক হলে বিলুপ্তি ঘটেছে গণরুম ও গেস্টরুমের। হলগুলোয় প্রথম বর্ষ থেকেই মেধার ভিত্তিতে সিট পেতে শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন কার্যকর সিদ্ধান্তে খুশির আমেজ বইছে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে। সাবেক শিক্ষার্থীরাও বলছেন, ঠিক এমন ক্যাম্পাসই তারা দেখতে চেয়েছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, আমরা চেষ্টা করছি বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থীবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থ বিবেচনায় সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। হলগুলোয় স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরেছে। হলে কোনো পক্ষের কোনো আধিপত্য থাকবে না আর। এ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য আমরা কাজ করছি।
আবাসিক হলের গণরুমে থাকা ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ও বীভৎসকর এক অধ্যায়। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের প্রভাব খাটিয়ে চারজনের কক্ষ একজন বা দুজনের দখলে রাখা, আসন বণ্টনে তাদের কর্র্তৃত্ব এবং নিয়মবহির্ভূতভাবে শিক্ষাজীবন শেষ হওয়া শিক্ষার্থীদের অবস্থানের ফলে সৃষ্টি হতো কৃত্রিম আসনসংকট। নথিপত্রে শতভাগ আবাসিক লিপিবদ্ধ থাকলেও গণরুম সংস্কৃতি ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান সমস্যা।
গণরুমে গাদাগাদি করে চারজনের কক্ষে ৮ থেকে ২০ জন, দুজনের কক্ষে ৪ থেকে ১০ জন করে থাকতে হতো। কক্ষের মেঝেতে তোশক বিছিয়ে নোংরা ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন থেকেই নিজের নামে বরাদ্দ করা আবাসিক হলে একটি বৈধ আসন পাওয়ার অধিকার থাকলেও প্রথম বর্ষের পুরো সময় কাটাতে হতো গণরুমে। এমনকি দ্বিতীয় বর্ষেও থাকতে হতো মিনি গণরুমে। একক আসন পেতে অপেক্ষা করতে হতো তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত। সমর্থ না থাকা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে অনেকে বাইরে বাসাভাড়া করে থাকতে বাধ্য হতেন। সঙ্গে ছিল মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেল একাই দখল করে রেখেছিলে মওলানা ভাসানী হলের চার আসনের দুটি কক্ষ।
অন্যদিকে পোষ্য কোটায় ভর্তি করা শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলে থাকার নিয়ম না থাকলেও, ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন পোষ্য কোটায় ভর্তি হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের চার আসনের দুটি কক্ষ রেখেছিলেন নিজের দখলে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে হলের কক্ষ দখলদারির অনৈতিক চর্চায় জড়িত ছিলেন শাখা ছাত্রলীগের ৫ শতাধিক নেতাকর্মী।
ছাত্রলীগ ছাড়াও আবাসন সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী ছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী স্নাতকোত্তর পর্বের (মাস্টার্স) চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আবাসিক হল ত্যাগ করার কথা থাকলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী আসন ছাড়তেন না। চাকরির পড়াশোনাসহ বিভিন্ন অজুহাতে হলে অবস্থান করতেন তারা। এ রকম শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও বেশি।
এসব অনিয়মে একরকম নির্বিকার ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অছাত্রদের হল ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে নোটিস জারি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাদের আবাসন সংকট নিরসনের তোড়জোড়।
১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস ছাড়ার সঙ্গে ছাত্রলীগসহ অবৈধ শিক্ষার্থী কর্র্তৃক সৃষ্টি এসব অপসংস্কৃতিও দূর হয়েছে। চিত্র পাল্টেছে আবাসিক হলগুলোর। গত ২০ অক্টোবর থেকে স্নাতক প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে। প্রথম দিন থেকেই আবাসিক হলে আসন পেয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ২১টি হল থেকে বিলুপ্ত হয়েছে গণরুম প্রথা। গণরুমে থাকা পূর্ববর্তী বর্ষের শিক্ষার্থীরা বুঝে পেয়েছেন তাদের সিট। এর বাইরে যারা শিক্ষাজীবন শেষে অবৈধভাবে অবস্থান করছিলে, তাদেরও হল ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রাধ্যক্ষ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, আবাসিক হলগুলোয় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী ব্লক তৈরি করে অতিরিক্ত আসন দখল করে রাখতেন। দেখা যেত ৫০টি আসনে দখল করে ১০ জন থাকছেন। অভ্যুত্থানের পর অনেক অছাত্র নিজে থেকেই চলে গেছেন। বাকি যারা ছিলেন, আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ও অনুরোধ করে তাদের হল ছাড়তে বাধ্য করেছি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন, বিগত বছরগুলোয় আবাসিক হলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য ছিল। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকত, তখন সেই দলের ছাত্র সংগঠন হলে আসন দখল করে ব্লক তৈরি করে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করত। রাজনৈতিক দলের প্রভাবসহ বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক চাপে হল প্রশাসন বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেও সমস্যা নিরসনে কাজ করতে পারত না। বর্তমানে আমাদের ওপর সরকারের পক্ষ থেকে সে রকম কোনো বিধিনিষেধ নেই। আমরা মুক্তভাবে কাজ করতে পারছি।
দীর্ঘ সাত বছরেরও বেশি সময় পর বৈধভাবে আবাসিক হলে আসন বরাদ্দ পেয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে বাড়তি উচ্ছ্বাস রয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। আগে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নাম লেখালেই মিলত আবাসিক হলে সিট। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক হল ছাড়া করে। পরে হাসিনা সরকারের পতনে হল ছেড়ে পালান ছাত্রলীগের কর্মীরা। নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নিয়ে আসন বরাদ্দ দেয়। সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই