• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বৃদ্ধাশ্রমে নয়, পিতা-মাতার ঠাঁই হোক সন্তানের হৃদয়ে 


সিনথিয়া সুমি এপ্রিল ১১, ২০২১, ০৩:৩৩ পিএম
বৃদ্ধাশ্রমে নয়, পিতা-মাতার ঠাঁই হোক সন্তানের হৃদয়ে 

ঢাকা : বৃদ্ধাশ্রম বলতে বৃদ্ধ নারী-পুরুষের আবাসস্থলকেই বোঝায়। পৃথিবীতে মা-বাবা এমন এক আশ্রয়স্থল, যার তুলনা পৃথিবীর কোনো বাটখারায় পরিমাপ করা যায় না। যায় না সেই পরম স্নেহের ওজন দেওয়া কোনো মেশিনে। সুতরাং এই মা এবং বাবা শেষ বয়সে কেন বৃদ্ধাশ্রমে?  মা-বাবা না থাকলে আমরা পৃথিবীর আলোই দেখতে পেতাম না। যে মা পরম স্নেহে শত অবর্ণনীয় কষ্ট, আঘাত, যন্ত্রণা সহ্য করে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করল, আবার জন্মের পর থেকে লালনপালন করল এবং পড়ালেখা শেখানো থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ধাপে সন্তানদের হাসিখুশি রাখতে কত না ত্যাগ স্বীকার করল; তারা চায় সন্তান বড় বা উচ্চশিক্ষিত হয়ে মানুষের মতো মানুষ হোক, সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, হোক সম্মানিত, চিনুক সবাই। সন্তানের সাফল্যের সাথে বাবা-মার সাফল্যও যেন একই সূত্রে গাঁথা। তাদের সাফল্যে নিজেকে সফল ভাবেন, হন খুশি আর পান মানসিক পরিতৃপ্তি। বাবা-মার নেই কোনো জাত, নেই কোনো অঞ্চল, নেই ভৌগোলিক সীমারেখা, নেই দেশ। পৃথিবীর সব বাবা-মার ধর্ম ও পরিচয় শুধুই বাবা-মা। যাদের স্নেহ-ভালোবাসায় নেই কোনো খাদ, নেই কৃত্রিমতা। প্রতিটি বাবা-মাই তার সন্তানকে সেই জন্মলগ্ন থেকে মায়া-মমতা আর স্নেহের পরশ বুলিয়ে তিল তিল করে বড় করে তোলেন। সেই বাবা-মায়েদেরই বৃদ্ধ বয়সে থাকতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। বর্তমান প্রেক্ষাপট লক্ষ করলে দেখা যায়, বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য পরিবার ও স্বজনদের থেকে আলাদা আবাস বা আশ্রয়ের নাম বৃদ্ধাশ্রম। মূলত অসহায় ও গরিব বৃদ্ধদের প্রতি করুণা বোধ থেকেই বৃদ্ধাশ্রমের সৃষ্টি, যেখানে বৃদ্ধদের প্রয়োজনীয় সেবা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের সেই ছবি এখন আর নেই। ছোটবেলায় যে মা-বাবা ছিলেন সন্তানের সবচেয়ে বেশি আপন, যাদের ছাড়া সন্তান কিছুই করতে পারত না, যারা নিজেদের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে মানুষ করেছেন, সব দুঃখ-কষ্ট বুকে চেপে রেখে সন্তানের হাসিমাখা মুখ দেখার জন্য যে মা ব্যাকুল থাকতেন, সন্তান না খেলে যিনি খেতেন না, সন্তান না ঘুমালে যিনি ঘুমাতেন না, অসুস্থ হলে যিনি বসে থাকতেন সন্তানের পাশে। আজ সেই মা-বাবার শেষ বয়সের ঠিকানা হয় এখনকার বৃদ্ধাশ্রমগুলো। জাতিসংঘ ৬০ বছর বয়সকে বার্ধক্য বা প্রবীণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবীণ পরিবারের সঙ্গে বসবাস করেন এবং তাদের ভরণপোষণ, চিকিৎসা প্রভৃতির ভার সন্তানের ওপর বর্তায়। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের কারণে যৌথ পরিবারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। একান্নবর্তী পরিবার বা যৌথ পরিবার ব্যবস্থা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এতে প্রবীণরা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার অর্থাৎ আশ্রয় ও বাসস্থান হারাচ্ছে। মানবতার প্রতি এ এক চরম উপহাস। দুই দশক আগেও দেশে বৃদ্ধাশ্রম তেমন একটা ছিল না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এর সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আজ আমরা চাকরি করি, ব্যবসা করি, বা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছি, সুনাম কুড়াচ্ছি। তারপর বিয়ে করে নতুন সংসার নিয়ে আলাদাভাবে থাকছি। অন্যদিকে বৃদ্ধ পিতা-মাতা কি খাচ্ছে, কি পরছে, কোনো জটিল ও কঠিন রোগে ভুগছে কি না সেদিকে বিন্দুমাত্র কোনো খেয়াল নেই আমাদের। যে বাবা-মা একসময় নিজে না খেয়েও সন্তানকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, তারা আজ কোথায় কেমন আছেন? সেই খবর নেওয়ার সময় যার নেই তার নিজের সন্তানও হয়তো একদিন তার সাথে এমন আচরণই করবে। বিভিন্ন উৎসবে, যেমন ঈদের দিনেও যখন তারা তাদের সন্তানদের কাছে পান না, সন্তানের কাছ থেকে একটি ফোনও পান না, তখন অনেকেই নীরবে অশ্রুপাত করেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।

নিজে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একটু ভালো থাকার জন্য বাবা-মার ঠাঁই করে দিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে। আবার এমনো দেখা যায়, সন্তানের টাকাপয়সার অভাব নেই, কিন্তু পিতা-মাতাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ করছেন না বা বোঝা মনে করছেন। হয় নিজেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে, নয়তো অবহেলা দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করছেন যেন তাদের পিতা-মাতা নিজেরাই সরে যান তার সাধের পরিবার থেকে। তবে এমন সন্তানের সংখ্যা অসংখ্য নয়।  একবার বৃদ্ধনিবাসে পাঠাতে পারলেই যেন সব দায়মুক্তি। এভাবে নানা অজুহাতে পিতা-মাতাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক নামি-দামি বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, চাকরিজীবী যারা এক সময় খুব বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন, তারাই আজ বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজের সন্তানের দ্বারাই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে। আমাদের মনে রাখতে হবে আজ যে সন্তান তার পিতা-মাতাকে জোর করে কিংবা এমনভাবে অবহেলা করছে যাতে, তার পিতা-মাতা নিজেই যেনও বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য হয় সেই সন্তানকেই যখন তার সন্তান এভাবেই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে তখন তার কেমন লাগবে? সন্তান যখন বেশি সুখ ভোগ করার আশায় তার অসহায় বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায় তখন তার বিবেক ঘুমিয়ে থাকে কেমনে? সময় বড় বেরসিক। আবর্তিত হয়ে বদলা নেবেই। মা-বাবা সর্বোত্তম, তাদের দোয়া ছাড়া পার হতে পারবে না পরপারের বাধা, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।

আমরা যারা বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে অবহেলা করছি, তাদের বোঝা মনে করছি, বৃদ্ধাশ্রমে তাদের ফেলে রাখছি, আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি আজ তারা বৃদ্ধ হতে পারেন, কিন্তু তারা তো বৃদ্ধ হয়ে পৃথিবীতে আসেননি। তারা তো পরিবারের বোঝা ছিলেন না, বরং সন্তানরাই তো তাদের কাছে বোঝা ছিল। তারা তো কখনো সন্তানদের বোঝা মনে করেননি। সন্তানদের বড় করে তোলার জন্য তারা বিন্দু পরিমাণ ত্রুটি রাখেননি। কত যত্ন করে বুকে আগলিয়ে সন্তান লালনপালন করেছেন। মা প্রতিটি সন্তানের জন্য কতই না কষ্ট করেছেন। গর্ভধারণ থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক পর্যন্ত মা সন্তানদের জন্য যে কষ্ট করেছেন, তার ঋণ কোনোদিনই শোধ হওয়ার নয়।

আমাদের মনে রাখা উচিত, আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামী দিনের বাবা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা-বাবারা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যান, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য।

আর যেন কখনো কোনো বাবা-মার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের তাদের জন্য তৈরি করতে হবে একটা নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী।

করোনার সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছেন সবাই। এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে মনের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়। আতঙ্ক, অহেতুক রাগ বা অবসাদের লক্ষণও দেখা দিতে পারে। এ সময় পরিবারে প্রবীণদের প্রতি বেশি যত্ন নিতে হবে। বৃদ্ধাশ্রম কোনো মা-বাবার কাছেই কাম্য নয়। যারা সন্তানের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের সঙ্গে সন্তানের উচিত সহমর্মিতাপূর্ণ আচরণ করা। শেষ বয়সটা যেন তারা পরিবারের সঙ্গে আনন্দে কাটাতে পারেন, তা নিশ্চিত করা প্রত্যেক সন্তানের কর্তব্য। আমরা যেন ভুলে না যাই তাদের জন্যই আমরা পৃথিবীতে এসেছি। তাদের কাছে আমাদের ঋণ অপরিশোধযোগ্য। এ ক্ষেত্রে সরকারকেও আইনের মাধ্যমে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাতে করে একটা সময় আর কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে না। কোনো পিতা-মাতার ঠিকানা যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আর মা-বাবা থাকবে সন্তানের হূদয়ে, কোনো বৃদ্ধাশ্রমে নয়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!