• ঢাকা
  • সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১
সামন্ত লাল সেন

কখনও দুর্নীতি করিনি, সহ্যও করব না


নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৪, ১২:৩৪ পিএম
কখনও দুর্নীতি করিনি, সহ্যও করব না

ঢাকা : চিকিৎসক হিসেবে প্রায় ৫০ বছর ধরে সেবা দিয়ে আসা সামন্ত লাল সেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে তার কাজ বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে এ খাতের সমস্যাগুলো তার অজানা নয়, তবে কাজের ধারা বুঝে ওঠার পর সেগুলো সমাধানে এগোতে চান।

নতুন ভূমিকায় এক মাসেরও কম সময় পেয়েছেন। তবে চিকিৎসক হিসেবে ভূমিকা পাল্টায়নি সামন্ত লালের। সকালে তার কার্যক্রম শুরু হয় বার্ন ইনস্টিটিউটে। সেখানে দায়িত্ব পালন শেষে যান সচিবালয়ে। দুটি কাজই সমান্তরালে এগিয়ে নিচ্ছেন তিনি, মনের কোণে স্বপ্ন ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে এই খাতের দুর্নীতি দূর করা।

একটি অনলাইন গণমাধ্যমের সাপ্তাহিক আয়োজন ইনসাইড আউটে অংশ নিয়ে নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন তিনি কী করতে চান, এ জন্য তার পদক্ষেপগুলো কী হবে, কোথায় থাকবে জোর, কী পরিবর্তন আসবে চিকিৎসা প্রশাসনে।

সামন্ত লাল সেন পোড়ার রোগীর চিকিৎসায় সুনামের সঙ্গে কাজ করে আসছেন। রাজনীতি থেকে দূরে থাকা এই চিকিৎসক মন্ত্রিসভায় ডাক পেয়ে নিজেই হয়েছেন বিস্মিত।

এক প্রশ্নে তিনি বলেন, একটা জিনিস আমি আপনাকে বলতে পারি, পুরো জীবনে আমি কোনো দুর্নীতি করিনি। সুতরাং আমি কোনো দুর্নীতি সহ্য করব না। নিশ্চিতভাবে আমি দুর্নীতি বন্ধের চেষ্টা করব।

অন্য এক প্রশ্নে তিনি বলেন, অভিযোগ (দুর্নীতির) কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে নয়, সব মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধেই রয়েছে। কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সব জায়গায় দুর্নীতি রয়েছে।

আমার মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে বলতে পারি, আমি কেবল যোগ দিয়েছি, এখন সবকিছু অনুসন্ধান করা হয়নি। কোথায় কোথায় দুর্নীতি হয় আমি সেটা দেখব। আমি ধীরগতিতে আগাব এবং দেখব কীভাবে দুর্নীতি বন্ধ করা যায়।

দুর্নীতি কমানোর জন্য সবপক্ষের সহযোগিতা দরকার বলে মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, আমি জানি এটা কেবল আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রশাসন, চিকিৎসক ও সবপক্ষের সহযোগিতা আমার দরকার। সবাই যদি আমাকে সহযোগিতা দেয়, আমি মনে করি এটা সম্ভব।

আপনি দুর্নীতি পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবেন না। আমরা দুর্নীতির পরিমাণ কমাতে পারি। কেননা, দুর্নীতি পৃথিবীর সব জায়গায় রয়েছে।

লক্ষ্য গ্রামীণ এলাকার স্বাস্থ্যসেবা : সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্য নিয়ে গ্রামীণ এলাকার চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোকে কার্যকর করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার কথা বলছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

তিনি বলেন, চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আমি বিকেন্দ্রীকরণ করতে চাই এবং আমার লক্ষ্য হলো গ্রামীণ চিকিৎসা খাত।… গ্রাম ও জেলা পর্যায়ে রোগীদের চিকিৎসার ভালো পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে পারলে রোগীরা আস্থা পাবেন। তাহলে তারা আর রাজধানীমুখী হয়ে যাবে না।

সামন্ত লাল বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা ঢাকার অন্য হাসপাতালে যদি যান দেখবেন, রোগীরা মেঝেতে শুয়ে আছে। কেন? একই চিকিৎসা জেলা হাসপাতালে হচ্ছে। যে চিকিৎসকরা ঢাকায় চিকিৎসা দিচ্ছে তারাই চট্টগ্রাম বা রাঙামাটি অন্যান্য জায়গায় চিকিৎসা দিচ্ছে।

একই যোগ্যতার চিকিৎসকরা গ্রামীণ এলাকায় সেবা দিলেও রোগীদের ঢাকামুখী হওয়ার পেছনে সেবার পরিবেশ ও যন্ত্রপাতির অভাবসহ বিভিন্ন কিছুকে কারণ হিসাবে তুলে ধরেন তিনি। বলেন, আমি যদি ওই স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোকে কার্যকর ও সেবার পরিবেশ দিতে পারি তাহলে মানুষ কেন ঢাকায় আসবে? এটা অনেক কারণে হচ্ছে বলে আমি জানি।

অনেক জায়গায় যথাযথ অপারেশন থিয়েটার নাই, আলোর ব্যবস্থা প্রভৃতি নাই। আমি যদি এগুলোর ব্যবস্থা করতে পারি, তাহলে মানুষ আর ঢাকার দিকে ছুটবে না।

স্বাস্থ্য খাতের বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে উদ্যোগের বিষয়ে এক প্রশ্নে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমার প্রধান বিষয় হচ্ছে, সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা। আমি গ্রামীণ পর্যায়ে, সাধারণ মানুষের কাছে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে চাই।

যে সেবা ঢাকায় আছে, সেই সেবা তেঁতুলিয়া কিংবা টেকনাফে দিতে চাই। সুতরাং সব জায়গাতে যথাযথ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।

চিকিৎসকের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে : গ্রাম ও উপজেলা পর্যায়ে যেতে চিকিৎসকের অনাগ্রহের বিষয়ে এক প্রশ্নে তাদের উপর হঠাৎ আক্রমণকেও এর কারণ হিসেবে দেখান সামন্ত লাল সেন।

চিকিৎসক হিসাবে প্রথম জীবনে হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, আপনার প্রশ্ন হচ্ছে চিকিৎসকরা কেন উপজেলায় যাচ্ছেন না? দেখুন, আমাদের দুদিক থেকেই দেখতে হবে, কেবল একদিক নয়। আমার চিকিৎসক যারা তাদেরকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা আমার দিতে হবে।

মন্ত্রী হওয়ার পর এক মাসের মধ্যে তিনটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সিলেটের জৈন্তাপুরে মানুষ হাসপাতালে হামলা করেছে, শরীয়তপুরে একজন নারী চিকিৎসক দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছেন এবং অন্য আরেকজন তরুণ চিকিৎসক।

চিকিৎসকরা তার রোগীকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। তবে, রোগী যে কোনো সময় মারা যেতে পারেন। কিন্তু অপ্রয়োজনে, হঠাৎ করে মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসকদের উপর হামলা করে। আমাকে এসব বিষয়ও দেখতে হবে।

তিনি বলেন, আমি যদি চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি, আমি নিশ্চিত তারা সেখানে যাবে। শরীয়তপুরের মতো এ ধরনের ঘটনা যদি ঘটতে থাকে, আমি নিশ্চিত আমাদের নারী চিকিৎসকরা উপজেলা পর্যায়ে যাবে না।

আমি তো আমার মেয়েকে উপজেলা পর্যায়ে পাঠাব না, যদি নিরাপত্তা না থাকে। সুতরাং আমাকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে।

স্বাস্থ্য বীমা ও রেফারেল প্রসঙ্গে : সবার জন্য সমান সুযোগ রেখে সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পাশাপাশি মানুষের জন্য সরকারিভাবে স্বাস্থ্যবীমা চালুর প্রতিশ্রুতি এবার নির্বাচনী ইশতেহারে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

স্বাস্থ্য বীমা চালুর বিষয়ে এক প্রশ্নে এ নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে কাজ এগিয়ে নিয়ে নেওয়ার কথা বলেন সামন্ত লাল।

চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে রেফারেল পদ্ধতি চালু হওয়ার উপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের কনসালটেন্টদের পেছনে প্রচুর মানুষের ভিড়।

আমি যদি অন্য দেশের মতো একটি রেফারেল পদ্ধতি চালু করতে পারি… রেফারেল ছাড়া কনসালটেন্ট দেখতে পারবে না। এ ধরনের পদ্ধতি রোগীদের কষ্ট ও ঘোরাঘুরি কমাতে পারে।

সরকারি হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যন্ত্রপাতির অভাব ও অনেকক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, এক মাস হয়নি তার দায়িত্ব নিযেছেন। সরকারি হাসপাতালের ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে যথাযথভাবে চালানোর পদক্ষেপ তিনি নেবেন।

রোগ পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে সেন্টার থেকে চিকিৎসকদের কমিশন নেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, এই ধরনের কাজ উচিত নয়। এসব নিয়েও তিনি কাজ করবেন।

চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখিতার প্রশ্ন : সরকারি হাসপাতালে সাধারণ মানুষের আস্থার বিষয়ে এক প্রশ্নে সামন্ত লাল বলেন, আপনি জানেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে তার চোখের চেকআপের জন্য যান। যদি তিনি সেখানে আস্থা রাখতে পারেন, তাহলে অন্য মানুষ কেন সরকারি হাসপাতালে আসতে পারবেন না?

সরকারি হাসপাতালে লোকবলের অভাব ও প্রচুর চাপ থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রচুর চাপের কারণে চিকিৎসকরা রোগীদের যথাযথ সময় দিতে পারেন না। এ কারণে গরিব রোগীরা আসে, ধনীরা আসে না। আমি মনে করি, রোগীর চাপ কমাতে পারলে ধনী-গরিব সবাই সরকারি হাসপাতালে আসবে।

চিকিৎসাকে ব্যক্তিগত পছন্দ হিসাবে অভিহিত করে তিনি বলেন, কেউ তার মাকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর বা ব্যাংককে নেবেন, এটা তার সিদ্ধান্ত। মানুষ তো এখন শপিং করার জন্যও কলকাতা আর মুম্বাইতে যায়।

হাসপাতালগুলোতে যথাযথ সুবিধা ও যন্ত্রপাতি ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে এই চিকিৎসক বলেন, আমাদের চিকিৎসকদের পৃথিবীর অন্যদের তুলনায় ভালো যোগ্যতা ও জ্ঞান রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে হাসপাতালের পরিস্থিতি ও ব্যবস্থাপনায়। আমরা যদি সেটাকে উন্নত করতে পারি, তাহলে মানুষ নিশ্চয়ই আস্থা পাবে, বিদেশে যাবে না।

সরকারি হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে চিকিৎসকদের উদাসীনতার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের কাজের প্রচুর চাপ। কাউন্সেলিংটা চিকিৎসার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রোগীদের ভিড়ের কারণে চিকিৎসকরা সেখানে যথাযথ কাউন্সেলিং করতে ও সময় দিতে পারেন না।

ওষুধ কোম্পানি থেকে লোভনীয় উপঢৌকন নিয়ে চিকিৎসকদের ওষুধ দেওয়া বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, কিছু ঘটনা হয়ত রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই বিশৃঙ্খলাকে দূর করার চেষ্টা করব, দেখব কী করা যায়।

ভেবেছিলাম ভুয়া টেলিফোন : মন্ত্রিসভায় শপথের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছ থেকে প্রথম যে টেলিফোন সামন্ত লাল পেয়েছিলেন, সেটাকে ভুয়া ভেবেছিলেন। অবশ্য পরে টেলিভিশন স্ক্রল দেখে তার ভুল ভেঙেছিল।

চিকিৎসা পেশা থেকে রাজনীতির নতুন মঞ্চে ওঠার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি কখনো ভাবিনি আমি মন্ত্রী হব, কখনই না। কেননা আমি কখনো রাজনীতিক ছিলাম না, এমপি ছিলাম না।

গত ১০ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনের সঙ্গে ফোনালাপের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমি যখন আমাদের মন্ত্রিপরিষদ সচিবের ফোন পাই, তিনি আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন। বলছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বাছাই করেছেন। আমি বিশ্বাস করিনি। আমি তাকে বলছিলাম- ‘আপনি কি সত্য বলছেন?’ তিনি বলেন, ‘জি, স্যার’।

তখন আমি ভাবছিলাম, এটা ভুয়া টেলিফোন বা অন্য কিছু। যখন আমি টেলিভিশন স্ক্রলে আমার নাম দেখেছি, তখন বুঝতে পারলাম- আমি সত্যিকার অর্থে মন্ত্রী হতে যাচ্ছি।

নিশ্চিত হওয়ার পর ‘কিছুটা হতভম্ব ও ভীত’ হয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, মন্ত্রী হওয়া বিশাল ব্যাপার, আমি কীভাবে কাজ চালিয়ে যাব? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বাছাই করেছেন, ১৭ কোটি মানুষের সেবা দেওয়া। এটা আমার জন্য বেশ বড় দায়িত্ব।

১৯৭৩ সালে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন সামন্ত লাল সেন। মাত্র পাঁচ শয্যার ওই চিকিৎসার সুযোগ থেকে সর্বশেষ শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পৌঁছানোর কথা তুলে ধরেন তিনি।

পুড়ে যন্ত্রণা ভোগের ঘটনা বাংলাদেশে ব্যাপকতার কথা তুলে ধরে সামন্ত লাল সেন বলেন, “আমি যখন শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন আমি পোড়া রোগীদের যন্ত্রণা দেখেছি।

কেউ তাদের দেখাশোনা করত না। ফলে মেঝেতে কিংবা শৌচাগারের সামনে তাদের চিকিৎসা চলত। এ কারণে আমি পোড়া রোগীদের জন্য কিছু করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছি।

প্লাস্টিক সার্জন হয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকলেও পোড়া রোগীদের কষ্ট দেখে এক্ষেত্রে নিজের ক্যারিয়ার চালিত করার কথা তুলে ধরেন তিনি। সূত্র : বিডিনিউজ

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!