• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সহায়তায় গবেষণা

ফার্মের মুরগিতে ক্যানসার!


নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ৭, ২০২১, ০২:৩৫ পিএম
ফার্মের মুরগিতে ক্যানসার!

ঢাকা : ক্যানসারের ঝুঁকি সৃষ্টিকারী উচ্চমাত্রায় ক্ষতিকর পাঁচটি ধাতুর উপস্থিতি মিলেছে ফার্মের মুরগির মাংসে। পোলট্রি ফিডের মাধ্যমে এইসব ক্ষতিকর ধাতু মুরগির মাংসে মিশে যাচ্ছ। ক্ষতিকর এসব ধাতু হলো— আর্সেনিক, নিকেল, ক্রোমিয়াম, পারদ ও সীসা। সম্প্রতি এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে আসে। সংশ্লিষ্টদের মতে, খামার এবং ফিড উৎপাদনকারী শিল্পগুলো নজরদারির আওতায় আনতে না পারলে ক্ষতির মাত্র ক্রমশ বিস্তৃত হবে।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের কারিগরি সহায়তায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন গবেষকের করা ওই গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, খামারে উৎপাদন করা মুরগির মাংসে মানবদেহে সহনীয় মাত্রার চেয়ে ১০৪ গুণ আর্সেনিক, ৫.৫৮ গুণ নিকেল, ৩ গুণ ক্রোমিয়াম, ২.৮ গুণ পারদ ও ৪.৬ গুণ সিসা রয়েছে।

গবেষণাটি পরিচালনা করেছে ‘প্রবাবিলিটিস অব হেলথ রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট অব টক্সিক মেটালস ইন চিকেনস ফ্রম দ্য লারজেস্ট প্রডাকশন এরিয়া অব ঢাকা’। গবেষণায় বলা হয়েছে, এসব ক্ষতিকর ধাতু খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করলে মানবদেহে তাৎক্ষণিক কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হলেও দীর্ঘদিন ধরে এগুলো শরীরে প্রবেশ করলে ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায় ২৫ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য রোগের ঝুঁকি থাকে ৪২ শতাংশ।

নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ জার্নালে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা জেলার সাভারের ১২টি বাণিজ্যিক খামার থেকে মুরগির নমুনা সংগ্রহ করে এ গবেষণা চালানো হয়।

গবেষণাপত্রে বলা হয়, যেসব খামার থেকে মুরগির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে, সেগুলোতে ব্যবহার করা পোলট্রি ফিডের নমুনায়ও ক্ষতিকর মাত্রায় আর্সেনিক, নিকেল, পারদ ও সিসা পাওয়া গেছে। একইভাবে মুরগির পানিতেও দূষণ পেয়েছে গবেষক দল। পানিতে অন্যান্য দূষণের পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকও পাওয়া যায়। এসব ধাতুর মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি মানবদেহে ক্যানসার ও অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।

গবেষকরা বলেছেন, বাজারে বিক্রির ৭২ ঘণ্টা আগে কোনো মুরগির শরীরে হরমোন ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হলে তা খাওয়া মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এর পরও কোনো কোনো খামারি অতি মুনাফার লোভে পোলট্রি মুরগির ওজন বাড়াতে হরমোন ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করেন। গবেষণাটির তত্ত্বাবধানে থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শফি মোহাম্মদ তারেক বলেন, মানসম্মত নয় এমন ফিডের মাধ্যমেই এসব ধাতু মুরগির শরীরে ঢুকছে। তিনি বলেন, ফিডের মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে নজরদারির অভাবের কারণে দেশে মান সম্মত ফিডের উৎপাদনের ঘাটতি রয়েছে। ফিডগুলো তৈরি, মোড়ক জাত ও বাজারজাত করার ক্ষেত্রে শতভাগ সতর্কতা অবলম্বন করা হয় না বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলোতে ধাতুর উপস্থিতি রয়ে যায় যা দিন শেষে মুরগির শরীরে প্রবেশ করে। এছাড়া পোলট্রি মুরগির জন্য যে সকল উৎস থেকে পানি ব্যাবহার করা হয় তা যথাযথ পরীক্ষা ব্যতিরেকে ব্যবহার করার কারণেও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন ধাতব এবং অন্যান্য বস্তু মুরগির শরীরে ঢুকছে। অধ্যাপক ড. শফি মোহাম্মদ তারেক বলেন, মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হবে না এমন মুরগি উৎপাদনের জন্য খামারিদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে খামার এবং ফিড উৎপাদনকারী শিল্পসমূহকে নজরদারির আওতায় আনতে হবে।

এটা করা সম্ভব হলে আগামী ৪/৫ বছরের মধ্যে দেশে শতভাগ না হলেও ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ স্বাস্থ্যসম্মত পোলট্রি মুরগি উৎপাদন সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মাদ আহসানুজ্জামান বলেন, দেশে প্রায় ৪০০ ফিড ইন্ডাস্ট্রিতে মাসে ৫ লাখ টনের ওপর পোলট্রি ফিড উৎপাদিত হয়ে থাকে। যে ৪০০ ফিড ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে এর মধ্যে ২৮১টি সরকারের নিবন্ধনকৃত এবং এর মধ্যে আসোসিয়েশনের সদস্য ৯০টি।

তিনি বলেন, এসব ফিড ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে অনেকগুলোতে যে কাঁচামাল ব্যবহার করা হয় তা থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ অপসরণের যে প্ল্যান্ট এবং তৈরি হওয়া ফিড বাজারজাত করার আগে সেগুলোতে কোনো ক্ষতিকারক ধাতব পদার্থ রয়েছে কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য ল্যাবরেটরি না থাকায় জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বস্তু তাতে থাকার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

যেহেতু বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত তাই ফিড কারখানাগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানোর ওপর জোর দেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের মিডিয়া অ্যাডভাইজার মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, দেশের সব পোলট্রি খামারগুলোর অবস্থা জানতে একটা জরিপ চলছে এবং সেটা সমাপ্ত হলে এ খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতি জানা যাবে।

তিনি বলেন, তখন পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং যে সকল সমস্যাগুলো দেখা যাচ্ছ সেগুলোর একটা সমাধান পাওয়া যাবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোলট্রি মুরগির মাংস দেশের প্রোটিনের চাহিদার এক বড় অংশ পূরণ করে থাকে। এতে ভারী ধাতুর পরিমাণ বেশি পাওয়া গেলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। শুধু পোলট্রি নয়, ডেইরি, মাছ বা যে কোনো খাদ্য শতভাগ নিরাপদ হতে হবে। এসব ধাতু মানুষের স্মরণ শক্তি, ফুসফুস এবং কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. শারমিন রুমি আলীম বলেন, পোলট্রি মুরগি যেহেতু সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে তাই বাজারে এই মাংসের চাহিদাও রয়েছে। আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই মাংসের মধ্যে যেহেতু গবেষকরা মাত্রার অতিরিক্ত ভারী ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছেন, তাই এর মাধ্যমে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, যে কোনো খাবার বিশেষ করে যা দৈনন্দিন খাওয়া হয় তা শতভাগ নিরাপদ হতে হবে। এর জন্য জনসচেতনতা, নিরাপদ খাদ্য আইন প্রয়োগ ও খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মানসম্মত পরীক্ষাগার স্থাপন করতে হবে। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এরপর যথাযথভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল কাইউম সরকার বলেন, পোলট্রি মুরগির শরীরে ভারী ধাতব পদার্থ পাওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের। তিনি বলেন, এর আগেও ফিড সংক্রান্ত কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল এবং সেগুলোর সমাধান করা হয়েছে। গবেষণায় যে সকল বিষয় উঠে এসেছে সেগুলো যেহেতু নিরাপদ খাদ্যের সাথে জড়িত তাই এ বিষয়ে আরো ভালো করে জেনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হবে বলে তিনি জানান।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!