“বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ”— জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসে লেখা এই বিখ্যাত সতর্কবাণীর সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতার মিল খুঁজে পান অনেকেই। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেভাবে আড়িপাতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, তার প্রতিধ্বনি আজও শোনা যায়।
২০১৫ থেকে ২০২৫— এ এক দশকে নজরদারি প্রযুক্তি ও স্পাইওয়্যার কেনায় বাংলাদেশ ব্যয় করেছে প্রায় ১৯ কোটি ডলার, যা টাকার অঙ্কে দুই হাজার কোটিরও বেশি। প্রযুক্তি বিষয়ক আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এই অর্থ ব্যয়ে শুধু কল রেকর্ড শোনা হয়নি, বরং সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত ডিভাইস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করার মতো কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছিল।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিশেষ করে ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আড়িপাতার সরঞ্জাম কেনার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া থেকেই বোঝা যায়, ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবেই এগুলো ব্যবহৃত হয়েছিল।
নজরদারির শিকারদের অভিজ্ঞতা
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না নিজেকে সরাসরি ভুক্তভোগী হিসেবে উল্লেখ করেন। ২০১৫ সালে প্রয়াত বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে তার টেলিফোন আলাপ ফাঁস হওয়ার পর রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাকে দুই বছর কারাভোগ করতে হয়েছিল। ধারণা করা হয়, সে সময়ই আড়িপাতার প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার কল রেকর্ড সংগ্রহ করা হয়েছিল।
মান্না বলেন, “আমি ভুক্তভোগী একথা তো আমি বলতেই পারি।”
এনটিএমসি: অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু
সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওঠে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)–র বিরুদ্ধে। ২০০৮ সালে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই’র ভবনে ‘ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার’ হিসেবে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি, পরে ২০১৩ সালে নাম বদলে এনটিএমসি হয়। ২০১৪ থেকে এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে কাজ শুরু করে।
টেক গ্লোবালের তথ্যমতে, ২০১৬ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত নজরদারিতে শুধু এনটিএমসি-ই খরচ করেছে প্রায় ৫২ মিলিয়ন ডলার (৬৩১ কোটি টাকা)।
জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং রিপোর্টে সংস্থাটিকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করা হলেও এখনও এর কার্যক্রম অব্যাহত আছে। গণঅভ্যুত্থানের পরও প্রতিষ্ঠানটি নজরদারি বন্ধ করেছে কি না— এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি সরকার।
আইনের আড়ালে বৈধ নজরদারি
বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও বাস্তবে পরিস্থিতি ভিন্ন। টেক গ্লোবালের হিসেব অনুযায়ী, অন্তত ২২টি আইনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নজরদারি কার্যক্রম বৈধতা পেয়েছে।
মানবাধিকার আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, “২২টি আইনে যেহেতু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এই ক্ষমতা দেয়া আছে, সেটার একটি পর্যালোচনা হওয়া উচিত। অভ্যুত্থানের সময়ও দেখা গেছে আড়িপাতার মাধ্যমে তথ্য ব্যবহার করে অনেককে গুরুতরভাবে হয়রানি করা হয়েছে। তাই সংস্কারের এই সময়ে বিষয়টি আলোচনায় আসা জরুরি।”
সরকার ও বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম অবশ্য দাবি করেন, সরকার বেআইনি কোনো কাজ করছে না। তবে প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, “অভ্যুত্থানের পর নানা ধরনের সংস্কার হলেও গোয়েন্দা সংস্থা ও নজরদারির কাঠামোয় কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে যে কোনো সরকার আগের মতো অপব্যবহার করতে পারবে।”
তার মতে, বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্র ও সংসদীয় কাঠামোর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় চেক অ্যান্ড ব্যালান্স তৈরি করা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে সেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটাই অনুপস্থিত।
সংস্কার প্রচেষ্টা ও বিতর্ক
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডিজিটাল আইন বাতিল করে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ জারি করে। এটিকে অনেকেই ইতিবাচক পদক্ষেপ মনে করলেও সেখানে এখনো বিভিন্ন কারণে ডেটা ব্লক করার ক্ষমতা রয়ে গেছে।
এছাড়া, নতুন করে আসা স্টারলিংক গাইডলাইনেও আড়িপাতার সুযোগ রাখার বিষয়টি বিশেষজ্ঞদের উদ্বিগ্ন করছে। ফোন কল ও ইন্টারনেট ডেটা সংরক্ষণ নীতিমালাও অপরিবর্তিত রয়েছে।
ভবিষ্যতের শঙ্কা
বহু অর্থ ব্যয়ে যে বিশাল নজরদারির কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, সেটি আইনের আওতায় না আনলে তা ভবিষ্যতে আবারও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে— এমন আশঙ্কাই প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অধিকারকর্মীদের মতে, ব্যক্তিগত তথ্য কীভাবে সংগ্রহ ও ব্যবহার হচ্ছে, তার ওপর নজরদারি করতে একটি স্বতন্ত্র ও জবাবদিহিমূলক সংস্থা গঠন ছাড়া বিকল্প নেই।
ওএফ







































