চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই। কেন সবাই তাকে ভাই ডাকছেন। রোববার (২৭ অক্টোবর) তাঁর গুলশানের বাসায় অভিযান চালানো সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মুখের তাঁর নামের সঙ্গে ‘ভাই’ শব্দটি উচ্চারণ করতে শুনা গেছে। কারণটা কি? তিনি কি বড় মাপের কোনো ডন। দাউদ ইব্রাহিমের কোনো আত্মীয় নাকি? এমন প্রশ্ন কর্তব্যরত সাংবাদিকসহ অনেকের মনে জেগেছে। তবে ইতিহাস ঘেটে জানা গেলো ভিন্ন তথ্য, অভিযোগ আছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের ৯০ দশকের স্বনামধন্য চিত্রনায়ক সালমান শাহ্ ও সোহেল চৌধুরীর হত্যায় জড়িত ছিলেন এই প্রযোজক আজিজ ভাই।
সালমান শাহ হত্যার সবচেয়ে সন্দেহভাজন আসামি এই আজিজ মোহাম্মদ ভাই। তিনি সালমানের মৃত্যুর সময় থেকেই একজন ধনকুবের নামে পরিচিত আবার অনেকে তাকে মাফিয়া ডনও বলে থাকেন।
শুরুতে জানা যাক, আজিজ মোহাম্মদের নামের সাথে ভাই এলো কোথেকে। এটা ‘ডন’ জাতীয় ভাই নয়, আসলে উনি একজন বাহাইয়ান অর্থাৎ ‘বাহাই’ নামক এক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। সম্ভবত তার পিতাও বাহাইয়ান ছিলেন। সেই থেকে নামের সঙ্গে বাহাই যা ডাকতে ডাকতে সংক্ষেপে ভাইতে পরিণত হয়। বাংলাদেশে বাহাই ধর্মের ১০ হাজারের মতন অনুসারী আছে বলে জানা যায়।
যেভাবে সালাম শাহ হত্যায় জড়িয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাই
৯০ এর দশকে এই আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে ধরা হতো বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় প্রযোজক। যে কারণে সেই সময়ে সাফল্যের তুঙ্গে থাকা সালমান শাহের পরিবারের সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল। জানা যায় - সালমান শাহ তার মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে এক পার্টিতে তার স্ত্রী সামিরাকে কিস করার জন্য এই আজিজ ভাইকে প্রকাশ্যে কষে থাপ্পড় মারেন। ওই পার্টিতে শাবনুর ও তার মা-সহ উপস্থিত ছিল।
সেই জেদ থেকে সালমান শাহকে হত্যা করা হতে পারে এমন সন্দেহ তখন থেকে। তাছাড়া সালমান শাহের মা অভিযোগও করেছেন এই আজিজের লোকেরা সালমান হত্যাকাণ্ড বিচারের সময় তাকে ও তার ছোটছেলেকে মারার চেষ্টা করেছিল, যার ফলে তিনি লন্ডনে চলে যান।
সালমান শাহ হত্যা মামলায় আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে দুইবার গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। হত্যার উপযুক্ত কোন প্রমাণ না পাওয়ায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
সালমান ভক্তদের মতে, মিডিয়ার পীড়াপীড়িতে সবই লোক দেখানো ব্যাপার সেপার। আজিজ সব কিছু আগে থেকেই ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন। তবে এই আজিজ ছাড়াই সালমান শাহের আরো শত্রু অবশ্য ছিল। যদি তা হত্যাকাণ্ড হয়েও থাকে, এমনও হতে পারে এটা তার সকল শত্রুর মিলিত পরিকল্পনা- এমনটাও অনেকে ধারণা করেন।
এই আজিজ মোহাম্মদ ভাই একজন বড় শিল্পপতি। অলিম্পিক ব্যাটারি, অলিম্পিক বলপেন, এমবি ফার্মাসিটিউক্যাল, এমবি ফিল্ম, টিপ বিস্কুট, এনার্জি বিস্কুট এগুলোর মালিক তিনি। স্বপরিবারে তিনি এখন ব্যাঙ্ককে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। আজিজ মোহাম্মদ ভাই এখন থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের হালখাতায় একজন পত্রিকা সম্পাদককে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর তার ১৪-১৫ বছরের কন্যাকে উঠিয়ে নেয়ার অভিযোগও আছে। আর ওই সম্পাদকের মৃত্যুকে হার্ট অ্যাটাক বলে চালিয়ে দেয়ারও অভিযোগ আছে।
আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের পরিবারও স্বনামধন্য ধনী পরিবার। তার পরিবারের অনেকের বিরুদ্ধেও ভয়াবহ সব অপরাধের অভিযোগ আছে। বেশ কয়েকবছর আগে তারই আপন ভাগিনা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইয়াবা মজুদসহ ধরা পড়েন এবং ৯০ বছরের সাজা পান। অভিনেত্রী দিতির স্বামী এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা সোহেল চৌধুরীকে ঢাকা ক্লাবের সামনে খুন হন। সেই হত্যাকাণ্ডেও আজিজ ভাইয়ের প্রত্যক্ষ পরিকল্পনা ও উপস্থিতিতে এমন অভিযোগ ছিলো দিতির।
জানা যায়, এই হত্যার মূলে ছিল তখনকার রমরমা ডিশ ব্যবসা। যা সোহেল চৌধুরীর পরিবারের এক চেটিয়া অধীনে ছিল। এই ডিশ ব্যবসা আজিজের পরিবার দখল করে নিতে চেয়েছিল।
বহুল আলোচিত সালমান শাহ মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে এখন তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ঢাকা মহানগর হাকিমের আদালতে মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্ধারিত তারিখ ছিল গত ১ অক্টোবর। অবশ্য নির্ধারিত তারিখে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। আদালত অধিকতর তদন্ত করে তার প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নতুন তারিখ নির্ধারণ করেছে আগামী ১৪ নভেম্বর।
জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে আজিজ মোহাম্মদ ভাই, সামিরা হক, লতিফা হক লুসি, রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, নজরুল শেখ, ডেভিড, আশরাফুল হক ডন, রাবেয়া সুলতানা রুবি, মোস্তাক ওয়াইদ, আবুল হোসেন খান ও মনোয়ারা বেগম।
৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সালমান শাহর লাশ ১১/বি নিউ ইস্কাটন রোডের ইস্কাটন প্লাজার বাসার নিজ কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রথমে হলি ফ্যামিলি ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। সালমানের মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন। পরে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই সালমানকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন করা হয়।
পরে ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই মামলাটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করার আবেদন জানান তিনি। অপমৃত্যু মামলার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়টি একসঙ্গে তদন্ত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেন আদালত।
৩ নভেম্বর ১৯৯৭ সালে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সিআইডি। প্রতিবেদনে সালমান শাহের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। ২৫ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন গৃহীত হয়। সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী রিভিশন মামলা দায়ের করেন।
২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠায় আদালত। এরপর প্রায় ১৫ বছর মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে ছিল।
২০১৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতের বিচারক বিকাশ কুমার সাহার কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক। এই প্রতিবেদনে সালমান শাহের মৃত্যুকে অপমৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
২০১৪ সালের ২১ ডিসেম্বর সালমান শাহের মা নীলা চৌধুরী বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান এবং ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দেবেন বলে আবেদন করেন।
২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নীলা চৌধুরী ঢাকা মহানগর হাকিম জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে নারাজির আবেদন দাখিল করেন। নারাজি আবেদনে উল্লেখ করা হয়, আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ১১ জন তার ছেলে সালমান শাহের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারেন।
আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের গুলশানের বাসায় অভিযান চালাচ্ছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। মাদকবিরোধী অভিযানে বাসাটির ছাদে বিপুল পরিমাণ মদ ও ক্যাসিনো সরঞ্জাম পাওয়া গেছে।
রোববার (২৭ অক্টোবর) বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে গুলশান-২ এর ৫৭ নম্বর সড়কের ১১/এ বাড়িতে এ অভিযান শুরু হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই এ অভিযান। তবে আজিজ মোহাম্মদ ভাই বাসায় নেই বলে জানিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (উত্তর) খোরশেদ আলম।
সোনালীনিউজ/এএস







































