ঢাকা : নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। ঈমানের পরে নামাজের স্থান। নামাজ মুমিনের অন্যতম প্রধান ইবাদত। আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার ওপর আরোপিত সব ইবাদতের মধ্যে নামাজ এমন একটি ইবাদত যা ব্যক্তিজীবনকে গড়ে তুলে মুমিন হিসেবে। নামাজের মাধ্যমেই জীবনের সর্বাঙ্গীণ সফলতা লাভ করা যায়। নামাজই এমন এক ইবাদত যা প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মুসলমানের ওপর সর্বাবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা ফরজ। নামাজের গুরুত্ব এতই বেশি যার কারণে পবিত্র কোরআনের ৮২ স্থানে বিভিন্নভাবে নামাজের আবশ্যকীয়তা বুঝানো হয়েছে। নামাজের ফরজ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকারকারী কাফের। নামাজ অস্বীকার করলে সে ব্যক্তির আর নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেওয়ার কোনো অধিকার থাকেনা।
মহান আল্লাহতাআলা পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে ৫ ওয়াক্ত নামাজকে ফরজ ঘোষণা করেছেন। ইরশাদ হচ্ছে-‘আর তারা যা বলে সে সম্পর্কে আপনি ধৈর্যধারণ করুন আর আপনি নামাজ আদায় করুন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে, রাত্রিকালে এবং দিবসের প্রান্তসমূহে, যাতে করে আপনি সন্তুষ্ট হতে পারেন।’ (সুরা ত্বহা-১৩০)। উক্ত আয়াতে সূর্যোদয়ের পূর্বে এই শব্দ দ্বারা ফজরের নামাজ, দিনের প্রান্তসমূহে এই শব্দ দ্বারা জোহরের নামাজ, সূর্যাস্তের পূর্বে এই শব্দ দ্বারা আসরের নামাজ, রাত্রির মধ্যখানে এই শব্দ দ্বারা মাগরিব ও এশার নামাজকে বোঝানো হয়েছে। নামাজের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাজির, যারা তাদের নামাজ সম্বন্ধে বে-খবর (সুরা মাউন : ৩-৫)। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিঃসন্দেহে নামাজ যথেষ্ট কঠিন কাজ, তবে যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি আছে তাদের পক্ষে মোটেই কঠিন নয়।’ (সুরা বাকারা-৪৫)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন“‘তোমাদের ছেলে-মেয়েদের বয়স ৭ বছর হলে নামাজ পড়তে আদেশ করো এবং ১০ বছরে (নামাজ না পড়লে) প্রহার করো এবং তাদের শয্যা পৃথক করে দাও।’ (তিরমিযি, আবু দাউদ)।
সফরের সময় বা অসুস্থ অবস্থায় রোজা ফরজ নয়। তেমনিভাবে গরিব হলে হজ্ব আদায় করতে হয় না। নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হলে জাকাত ফরজ নয়। কিন্তু সর্বাবস্থায় নামাজ ফরজ। কোনো অবস্থাতেই নামাজ মাফ হয় না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ো, যদি না পারো তবে বসে পড়ো। তাতেও অপারগ হলে শুয়ে বা ইশারায় পড়ো তবুও নামাজে মাফ নেই।’ (বুখারি)। সাহাবায়ে কেরাম যখন নামাজে দাঁড়াতেন, পাখিরা তাদেরকে বৃক্ষ মনে করে তাদের মাথার ওপর বসে জিকিরে সুর তুলত। নামাজে থাকা অবস্থায় হযরত আলী (রা.) এর শরীর থেকে তীর বের করা হলে তিনি টেরও পেলেন না। অথচ প্রচণ্ড ব্যাথা পাচ্ছিলেন বলে নামাজের বাইরে থাকা অবস্থায় এই তীর বের করা সম্ভব হচ্ছিল না। অযথা নামাজ ত্যাগ করার কোনো সুযোগ নেই। স্বেচ্ছায় নামাজ ত্যাগকারীদেরকে সাহাবায়ে কেরামগণ কাফের বলে মনে করতেন। (তিরমিযি)। তবে বড়ই পরিতাপের বিষয়- একজন বেনামাজি একেবারেই ভুলে যায় যে তার জীবন শুরু হয়েছিল আজান-ইকামত দিয়ে। আর শেষ হবে নামাজ দিয়ে। মুসলমান মাত্রই জন্মের সময় তার ডান কানে আজান আর বাম কানে ইকামত দেওয়া হয়, এটা মুস্তাহাব। বাকি থাকে ঐ একামতের নামাজ। সেটা জানাযা দ্বারা পূর্ণ করা হয়। চিরবিদায় হয় দুনিয়া থেকে। এটা জানার পরও মানুষ কীভাবে এতো মহামূল্যবান সম্পদ ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নামাজকে অবহেলা করে। স্বেচ্ছায় তা ত্যাগ করে। কী ভয়ংকর কথা!
ইসলামের অন্যান্য ইবাদত যেমন রোজা, হজ্ব, জাকাত ইত্যাদি ওহির মাধ্যমে ফরজ করা হয়েছে। কিন্তু নামাজ স্বয়ং আল্লাহতায়ালা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে সোপর্দ করেছেন। এজন্যই নামাজের গুরুত্ব অন্যসব ইবাদতের চাইতে বেশি। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা বলেন, আল্লাহতায়ালাকে সন্তুষ্ট করার প্রধান উপায় নামাজ। নামাজ ব্যতীত কোনো ইবাদত আল্লাহর নিকট কবুল হয় না। নামাজের কারণে রিযিকে বরকত আসে। নামাজ কেয়ামত পর্যন্ত সঙ্গে থেকে নামাজির প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করবে। নামাজ বেহেশতের চাবি এটা বেহেস্তের দরজা খুলে নামাজিকে প্রবেশ করাবে।
নামাজে মনোযোগ স্থাপন প্রসঙ্গে হযরত হাসান বসরী (র.) বলেন, নামাজি ব্যক্তির জন্য আল্লাহতায়ালা কতগুলো নির্দিষ্ট সম্মান নির্ধারিত করে রেখেছেন। তার একটি হলো : একজন ফেরেশতা নামাজিকে ডেকে বলে, হে বান্দা! তুমি যদি জানতে তোমার সামনে কে আছেন এবং নামাজের মধ্যে তুমি কার সাথে কথা বলছ, তবে খোদার কসম, কেয়ামত পর্যন্ত সালাম না ফিরিয়ে তুমি নামাজে মশগুল থাকতে। যখন কোনো বান্দা নামাজে দাঁড়াই তখন আল্লাহরাব্বুল আলামিন তার সামনে এসে উপস্থিত হয়। এমতাবস্থায় যদি নামাজি ব্যক্তি অন্য মনস্ক হয়ে অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে থাকে তখন আল্লাহতাআলা বলেন, হে আমার বান্দা আমি তো তোমার সামনেই আছি আমার চাইতে বড় আর কি আছে যে, তুমি সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছ?
নামাজি ব্যক্তির জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যেমন পুরস্কার রয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে বেনামাজির জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। ইহজগতেও বেনামাজিকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। বেনামাজির জীবিকা নির্বাহে কোনো বরকত থাকবে না। তার চেহারায় নেক লোকের কোনো চিহ্ন থাকে না। বেনামাজির দোয়া এবং ইবাদত আল্লাহর নিকট কবুল হয় না এমনকী তার জন্য কেউ দোয়া করলে, সেটাও মহান আল্লাহর নিকট তা গ্রহণ হয় না। এছাড়াও বেনামাজির মৃত্যু হবে অত্যন্ত অপমানের সাথে। কবরে তাকে ভোগ করতে হবে কঠোর শাস্তি। কেয়ামতের দিন বেনামাজিকে বহু অপমান করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। নামাজ বিনষ্টকারীদের সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, যারা নামাজ বিনষ্ট করেছে এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে, খুব শিগগিরই তারা কঠোর আজাবের সম্মুখীন হবে।
সমাজে অনেক ব্যক্তি আছেন যারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, আত্মীয়-স্বজন, অফিস-আদালতে খুব সাজগোজ করে পরিপাটি হয়ে যান কিন্তু নামাজের সময় পুরাতন, কম দামি, ময়লা হয়ে যাওয়া পোশাকটি পরে মহান রাব্বুল আলামীনের সামনে গিয়ে হাজির হন। এটা একেবারেই ঠিক নয় বরং সর্বোৎকৃষ্ট, সবচেয়ে উত্তম পোশাকটি পরেই সৃষ্টিকর্তার সামনে হাজির হওয়া উচিত। আল্লাহতাআলা বলেন- হে বনী-আদম! তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় সাজ-সজ্জা গ্রহণ করো। (সুরা আরাফ-৩১)। তবে কারো যদি একেবারেই কাপড় না থাকে এমনকি সে যদি উলঙ্গ অবস্থায় থাকে তবে তাকে ঐ উলঙ্গ অবস্থাতেই নামাজ আদায় করতে হবে। (তাহসিব ১ম, পৃষ্ঠা ১৫০)। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বারবার নামাজের প্রতি বিনয়ী হওয়ার তাকিদ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে“‘আমার স্মরণে নামাজ প্রতিষ্ঠা করো।’ অন্য আরেক আয়াতে বলা হয়েছে-‘এবং অমনোযোগীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন-যার নামাজ তাকে অশ্লীলতা ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত না রাখে, সে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। আর অমনোযোগীর নামাজ তাকে অশ্লীলতা ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে না। এ থেকে বুঝা গেল, যে লোক অন্যমনস্ক হয়ে নামাজ পড়ে, সে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যেতে থাকে।
তাকবিরে তাহরিমার সময় বিনয়সহ মনের একাগ্রতা বজায় রেখে আল্লাহর উদ্দেশে নামাজের নিয়ত করতে হবে। পরে নামাজের যে অংশে খুশি থাকবে না, ওই অংশের সাওয়াব থেকে সে বঞ্চিত হবে। তবে ফিকাহ অনুযায়ী তাকে নামাজ পরিত্যাগকারী বলা চলবে না এবং বেনামাজির ওপর যে শাস্তি প্রযোজ্য তার জন্য সেই শাস্তির বিধান করা যাবে না। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র অভ্যাস ছিল, যখনই তিনি কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতেন তখনই নামাজ আরম্ভ করতেন। আর আল্লাহতায়ালা সে নামাজের বরকতেই তার সব বিপদ-আপদ দূর করে দিতেন। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে জামাতের সাথে আদায় করার তওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : আলেম ও ইসলামী কলামিস্ট







































