• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সবুজ গম্বুজের ঘ্রাণে মোহিত বিশ্ব


গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির জানুয়ারি ১২, ২০২১, ০১:২২ পিএম
সবুজ গম্বুজের ঘ্রাণে মোহিত বিশ্ব

ঢাকা : একজন কবির কবিতার শিরোনাম দেখেছিলাম ‘সবুজ গম্বুজের ঘ্রাণ’। সম্ভবত মানবতার মহান বন্ধু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করেই তাঁর এ লেখাটি। দীর্ঘদিন পর মানবসভ্যতার কারিগর ও নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের বন্ধু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবুজ গমজের কথা মনে পড়লো। এই সেই সবুজ গম্বুজ, যার ছায়াতলে শুয়ে আছেন সীমাহীন কৃতিত্বের অধিকারী, সতত প্রবাহমান ঝরনাধারা সৃষ্টিকারী রাহমাতুল লিল আলামীন  মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এই সেই সবুজ গম্বুজ যার ছায়াতলে তাঁরই পাশে শুয়ে আছেন উত্তাল সংগ্রামমুখর জীবনের সাথী, হিজরতের সাথী, সওর গুহার সাথী, দুঃসহ জীবনের সাথী, সারা জীবনের সাথী এমনকী পরকালের (কবর) জীবনের সাথী সাইয়্যেদুনা আমিরুল মুমেনীন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। আরো শুয়ে আছেন সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জনক, অর্ধেকটা পৃথিবীর বাদশা আমিরুল মুমেনীন সাইয়্যেদুনা হজরত ওমরে ফারুক (রা.)। আল্লাহর কী অপার মহিমা সম্ভবত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো পূর্ব নির্দেশনা ছিল না। অত্যন্ত নাজুক ও স্পর্শকাতর জীবনের সাথী, সুখ-দুঃখে সান্ত্বনাদানকারী হুজুরের সম্মানিত স্ত্রী উম্মুল মুমেনীন হজরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.) নয়, কলিজার টুকরা হজরত ফাতেমা (রা:) নয়, আমিরুল মুমেনীন প্রিয় জামাতা হজরত আলী (রা.) নয়, অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ইমাম হাসান ও হোসাইন (রা.)ও নয়; কিন্তু জীবনের দীর্ঘপথ পরিক্রমায় এই দুজন মহান পরকালের জীবনের সাথীকে পাশে নিয়ে সময়ের পথ অতিক্রম করে চলেছেন দূর দিগন্তরের পানে। উচ্চাঙ্গের মেধাবী ও বুদ্ধিমান, সাহসী বীর, ধৈর্যশীল, আদর্শে অবিচল, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ, উদার ও মহানুভব, দাতা, দায়িত্ব-সচেতন, বিনয়ী ও ভাবগম্ভীর এবং প্রিয়ভাষী ও শুদ্ধভাষী চরিত্র মাধুর্য ও অহংকারমুক্ত জীবনধারার আলোকরশ্মি সবুজ গম্বুজের চূড়া থেকে অবিরত বিচ্ছুরিত হয়ে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ, প্রতিটি জনপদকে আলোকিত করে চলেছে। এর সুরভিত পবিত্র ঘ্রাণ পৃথিবীকে মোহিত করে চলেছে। পৃথিবীর শেষ অবধি এই আবহ চলবে। যেন সতত প্রবাহিত কোনো এক নির্ঝর, যার স্বচ্ছ নির্মল পানি সারা পৃথিবীকে সিক্ত করে চলেছে। তাঁরই রূপের মহিমায় প্রকৃতি বার বার নতুন সাজে আবির্ভূত হয়, পৃথিবী ঢেকে যায় সবুজ বন-বনানীতে, ফুলে-ফলে সুশোভিত হয় মন ও মানস। এই সেই সবুজ গম্বুজ যেন একটি ভালো জাতের গাছ, যার সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয় তৃণলতাহীন, কুল কিনারাহীন ও অন্তহীন মরভূমির দিকভ্রান্ত পথিক খরতাপ রোদ্রে একটু ছায়ার জন্য যার প্রাণ ওষ্ঠাগত। এটি এমন একটি গাছ, যার শিকড় মাটির অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত এবং শাখা-প্রশাখা আকাশে পৌঁছে গেছে। যার সবুজপাতা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণে সাহায্য করে। প্রতিটি মুহূর্তে নিজের রবের নির্দেশে ফলদান করে। যে ফল মানুষ ও পাখপাখালীরা খায় এবং আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করে।

মানবতার পরম সহূদ সবুজ গম্বুজের নিবিড় ছায়ায় শুয়ে আছেন। যার গভীর চেতনাসমৃদ্ধ মিশন মেঘমালা পেরিয়ে অনন্তের দিগ্বলয় পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। ফলে এই সবুজ গম্বুজ পৃথিবীর প্রতিটি জনপদকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। তাই তারা অকৃত্রিম ভালোবাসা ও প্রচণ্ড আবেগের টানে ছুটে আসে সবুজ গম্বুজের একটু ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য। প্রচণ্ড আবেগের কারণেই তাঁকে নিয়ে এত গান, এত সাহিত্য-প্রবন্ধ, কাব্যমালা ও জীবনচরিত রচিত হয়েছে। এমনটি দ্বিতীয় কোনো জীবনচরিত আজো আবির্ভূত হয়নি এবং ভবিষ্যতেও আর হবে না। যেন এক অনিশেষ ঝরনাধারা।

যারা এই আবেশে পাগলের মতো তাঁর দিকে ছুটে আসেন, তাদের আবেগ-অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই যে, এই সবুজ গম্বুজের সত্যিকারের ঘ্রাণ একমাত্র তারাই নিতে পারে, এই স্রোতস্বীনি নির্ঝর থেকে স্বচ্ছ ভালোবাসার স্বাদ তারাই গ্রহণ করতে পারে যারা তাঁর সংগ্রামমুখর জীবনের অনুসারী। যারা নিজ নিজ এলাকায় তাঁর মিশন বাস্তবায়নে রক্ত ঝড়ায়। যারা নিজ মাতৃভূমিতে জেঁকে বসা অসংখ্য প্রভুর নাগপাশ থেকে মানবতাকে রক্ষায় জানমাল খরচ করে। প্রচলিত অসংখ্য বাতিল জীবন ব্যবস্থার স্থলে সত্য-সরল জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় যাদের সময় ও শ্রম ব্যয় হয়।

পৃথিবীর দেশে দেশে মানবতার লাঞ্ছনা যাদের মানবিকতাকে সামান্যতম বিচলিত করতে পারে না। যেখানে মানবজাতি নিকষ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে, পাশবিকতা, হিংস্রতা, জুলুম ও নির্যাতন রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে, শিরক ও পৌত্তলিকতা সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে প্রবেশ করেছে। সমাজজীবনের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গে এমন ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে যে, সেখান থেকে উৎকট দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। সাধারণ মানুষ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরতে বসেছে। ক্ষমতাসীনরা রাষ্ট্রীয় অস্ত্রধারীদের জোরে নিদারুণ শোষণ-নিষ্পেষণে জাতিকে পিষ্ট করছে। চারদিকে দলিত মথিত হচ্ছে মানবিক মর্যাদা। লাঞ্ছিত ও ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে মনুষ্যত্ব।

বিবেক ও মন যেন আজ কঠিন দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে গেছে, যার দরুন কোথাও প্রতিবাদ নেই। হতাশা ও ব্যর্থতার দীর্ঘ শ্বাসে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে গেছে। এহেন অবস্থায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিশন যে একমাত্র মুক্তির উপায় হতে পারে, তা যাদের মনে ক্ষীণতম আশার আলো জ্বালে না। মানবতার আত্মার আর্তনাদ যাদের কর্ণকুহুরে পৌঁছে না। তারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কীভাবে কোন ধরনের ভালোবাসা পোষণ করেন, তা আমার বুঝে আসে না।

কিন্তু মনের কান পেতে শুনুন সবুজ গম্বুজের চূড়া থেকে বয়ে আসা সম্মিলিত করুণ কান্না। মানবতার করুণ লাঞ্ছনায় সবুজ গম্বুজ থেকে সুরা রুমের ৪১ নং সেই আয়াতটি যেন তেলাওয়াত হচ্ছে-‘পৃথিবীর জলে-স্থলে যে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে, তা শুধু মানুষের কৃতকর্মের ফল। এভাবে আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করাতে চান। হয়তো তারা সৎপথে ফিরে আসবে।’ নিপীড়িত, বঞ্চিত, বিপন্ন মানবতার নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেন ব্যথিত হূদয়ে বিদায় হজ্বের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের বার বার পুনরাবৃত্তি করছেন। রাতের অন্ধকারে মনের চক্ষু দিয়ে লক্ষ করুন, এই বুঝি মহাকালের মহান রাষ্ট্রপতি হজরত ওমর (রা.) ক্ষুধার্ত মানুষের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছেন। জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি কায়েমের জন্য বার বার তাগাদা দিচ্ছেন সিদ্দিকে আকবর হজরত আবু বকর (রা.)। যদি এই কান্নার সুর আপনি উপলব্ধি না করতে পারেন, তবে আপনার আবেগ-অনুভূতি সস্তা মায়াকান্নার রূপ নেবে।

সুদীর্ঘ ২৩ বৎসর ছিল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিশনারি জীবন। মিশন কী ছিল তা নিম্নোক্ত আয়াতে ব্যক্ত হয়েছে, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি স্বীয় রাসুলকে হেদায়াত ও সত্য জীবনব্যবস্থা সহকারে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি এই সত্য জীবনব্যবস্থাকে অন্যসব ধর্মমত ও জীবন ব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করে দিতে পারেন। মুশরিকদের তা যতই অপছন্দনীয় হোক না কেন।’ (৬১ : ৯) তিনি মুশরিকদের পছন্দ-অপছন্দের তোয়াক্কা না করে, সব প্রকার বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে সত্য জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নের কাজ সুসম্পন্ন করেছেন। মহাবিশ্বের একজন শ্রষ্টা ও প্রভু আছেন এবং মানুষ তাঁরই গোলাম ও দাস শ্রেষ্ঠতম এই সত্য, যার ওপর সভ্যতার কল্যাণ-অকল্যাণ পুরোপুরি নির্ভরশীল। তিনি সৎ ও নিষ্কুলষ সভ্যতার এই পবিত্র বৃক্ষরোপণ করে গেছেন। তিনি মানুষের মন-মননে দ্রুব সত্যের রূপ দিয়ে গেছেন। সুতরাং যারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিপ্লবী জীবন চরিত্রে মনোনিবেশ করেন কেবল তারাই সবুজ গম্বুজের চূড়ায় আলোকরশ্নি দেখতে পায়। তারাই কেবল সবুজ গম্বুজের সত্যিকার ঘ্রাণ নিতে পারে।

লেখক : কলামিস্ট, সাংবাদিক, কবি ও সংগঠক

Wordbridge School
Link copied!