• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রোগীর প্রতি চিকিৎসকের দায়িত্ব


ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ জানুয়ারি ১৫, ২০২১, ০২:৩৯ পিএম
রোগীর প্রতি চিকিৎসকের দায়িত্ব

ঢাকা : মানুষ যাতে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকে সে ব্যাপারে ইসলাম জোর তাগিদ দিয়েছে। অসুস্থ হলে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উৎসাহিত করেছেন। তিনি নিজে অসুস্থ হলেও চিকিৎসা গ্রহণ করতেন। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো, কেননা আল্লাহতাআলা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি; শুধু বার্ধক্যরোগ ব্যতীত।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৮৫৫) অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসার নির্দেশ অভিজ্ঞ ব্যক্তির দিক নির্দেশনায় চিকিৎসা করা হলো ইসলামের নির্দেশ। হাদিস শরিফে এসেছে, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) হূদরোগে আক্রান্ত হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে তখনকার প্রসিদ্ধ ডাক্তার হারেস ইবনে কালদাহর কাছে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। (আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৮৭৫)

ইসলামী শরিয়ত যেভাবে রোগীকে নির্দেশ দেয় অভিজ্ঞ ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণের, তদ্রূপ ডাক্তারকে নির্দেশ দেয় পরিপূর্ণ জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের। না জেনে চিকিৎসা করা বৈধ নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ডাক্তারি না শিখে কারো চিকিৎসা করে, আর এতে অজ্ঞতার কারণে রোগীর কোনো ক্ষতি করে ফেলে, তাহলে চিকিৎসক দায়ী হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস  নং-৪৫৮৭) সরকারি আইনে সার্টিফিকেটের বাধ্যবাধকতা থাকলে সরকারি আইন মেনে চলাও আবশ্যক। (আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু : ৫/৪৪৯, আহসানুল ফাতাওয়া : ৮/৯৫) রোগীর প্রতি চিকিৎসকের দায়িত্ববোধ কেমন হওয়া উচিত তা বলে বুঝানোর প্রয়োজন নেই। রোগীর প্রতি চিকিৎসকের দায়িত্ব, চিকিৎসাশাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়ায় শিক্ষকরা ছাত্রদেরকে অবশ্যই তা তালিম দিয়ে থাকেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন, বান্দা যখন কোনো কাজ করে বা কোনো বিষয় শিখে তা যেন খুব ভালোভাবে করে বা শিখে।’ (তবরানী, আল মুজামুল আওসাত, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা: ২৭৫) রাসুল (সা.)-এর কথার মর্ম হচ্ছে, একজন ছাত্র ডাক্তারি পোশাক গ্রহণ করলে, তার জন্য কর্তব্য হচ্ছে, উক্ত পেশায় পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করা। কেউ ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইলে, উক্ত বিষয়ে সে যেন ভালোভাবে দক্ষতা অর্জন করে। আধা আধা শিখে কোনো কাজ শুরু করা খুবই অন্যায়। একটি প্রবাদ বাক্য আছে, ‘অর্ধেক ডাক্তার জীবনের জন্য হুমকি।’ তাই কর্তব্য হলো পূর্ণ দক্ষতা নিয়ে মানুষের সেবা করা।

নিচে চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের নিয়ে মুসলিম ব্যক্তিবর্গের কিছু সরল কথা তোলে ধরবো। কথা স্বাভাবিক হলেও, এর প্রভাব ও শিক্ষা সুদূরপ্রসারী। উদ্দেশ্য, মুসলিম চিকিৎসগণ দীনি দিক থেকেও সচেতন হয়ে যেন দায়িত্ব পালন করেন। চিকিসৎসাশাস্ত্র ও অন্যান্য বিদ্যার মাঝে পার্থক্য হলো, এখানে মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত। তাই চিকিৎসাশাস্ত্রের কোনো অসম্পূর্ণতা নিয়ে মানুষের সেবা করা মানে মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করা। সনদ থাকার কারণে, ভুল চিকিৎসা করে মানুষ মারলে দুনিয়ার আদালতে হয়তো ছাড় পেয়ে যাবে, কিন্তু বিবেকের দংশন ও আখেরাতের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে কখনো মুক্তি পাবে না।

রোগীর প্রতি সম্মান দেখানো : রোগীর প্রতি ডাক্তারের যে দায়িত্ব রয়েছে, এর অন্যতম হচ্ছে রোগীকে সম্মান দেখানো। আর প্রত্যেক বিষয়ের সম্মান দেখানোর পদ্ধতি আলাদা আলাদা। এক্ষেত্রে সম্মান দেখানোর বিষয় হলো, রোগীর অভিযোগ ও তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনা। তার রোগ বা তাকে নিয়ে বিদ্রূপাত্মক কোনো কথা না বলা। রোগীর প্রতি কোনোরূপ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য প্রদর্শন না করা। অনেক সময় রোগীর জ্ঞানগত যোগ্যতা বা সামাজিক অবস্থান নিচু হওয়ার কারণে অবজ্ঞা করা হয়। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মানুষের মৌলিক অধিকার হচ্ছে তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলা। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর মানুষের দিক থেকে অহংকারবশত মুখ ফিরিয়ে নিও না এবং পৃথিবীতে দম্ভ করে চলো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ রোগী, ডাক্তারের খোশকথা দ্বারা উৎফুল্ল হয়ে অনেক সময় প্রশান্তি অনুভব করে। এটাও রোগীর ওপর চাপ কমাতে সহায়ক হয়। তাই রোগীকে সম্মান দেখিয়ে কথা বলতে হবে। সওয়াবের পাল্লায় এই কথাও শামিল হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ভালো ভালো কথা বলাও সদকার অন্তর্ভুক্ত।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং-৮১১১)

রোগীর দৃষ্টিতে রোগ দেখা : সমানুভূতি নিয়ে রোগী দেখা। অর্থাৎ রোগী, রোগের কারণে মানসিক ও শারীরিক যতটুকু পেরেশানিতে আছে, এর অনুভূতি ডাক্তারের মাঝে থাকা। একজন ডাক্তারের কাছে রোগী কী প্রত্যাশা করে, সে অনুযায়ী ডাক্তারের রোগীর প্রতি খেয়াল করা। এ জন্য, কোনো রোগী সরাসরি ডাক্তারের সাক্ষাতে এলে তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনা ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো। এ ব্যাপারে কোনো গাফলতি হলে, রোগীর সমস্যা বুঝার ক্ষেত্রে ডাক্তারের অনুভূতি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। (বর্তমানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলতে হয় না। একশ্রেণির অসাধু ডাক্তার, পয়সা কামানোর লোভে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের পরীক্ষার কথা লিখে দেয়)।

রোগীর কল্যাণ কামনা ও লাভজনক দিককে প্রাধান্য দেওয়া : রোগীর অবস্থা বিবেচনায়, তার সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে ডাক্তারের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সাধারণ মানুষের ভূমিকা এক্ষেত্রে অন্ধের মতো। তাই ডাক্তারকে আমানতদারি রক্ষা করে চলতে হবে। কোনো কিছু ঠিক করে দেওয়ার আগে, চিকিৎসাশাস্ত্রের আলোকে এর কার্যকারিতা ও প্রায়োগিক দিকগুলো ভালোভাবে যাচাই করে নিতে হবে। অপ্রচলিত, অগ্রহণযোগ্য কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। মানহীন কোম্পানির ওষুধ, শুধু কমিশনের লোভে দিলে চিকিৎসা পেশার সঙ্গে এটা হবে এক ধরনের বেঈমানি।

নিম্মোক্ত বিষয়গুলোও রোগীর কল্যাণ কামনার অন্তর্ভুক্ত লিখিত চিকিৎসাপত্র দেওয়া। লেখা হবে স্পষ্ট অক্ষরে (আমাদের দেশে অনেকে প্রেসক্রিপশন দেন, যা ফার্মেসিতে নিয়ে যাওয়ার পর পড়া যায় না। এটা কোনো দায়িত্বশীল ডাক্তারের কাজ হতে পারে না)। সেখানে ওষুধের পরিমাণ, ব্যবহারের পদ্ধতি, চিকিৎসা গ্রহণের সময় যে সব বিষয় পরিহার করে চলতে হবে ও ওষুধ ব্যবহারের ফলে সাময়িক যে সব সমস্যা দেখা দিতে পারে তা সুস্পষ্ট অক্ষরে লেখা থাকতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত খাঁটি মুমিন হতে পারে না, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে তা অন্যের জন্য পছন্দ করে না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৩)

রোগ এমন হলে, যা থেকে নিরাময়ের কোনো সম্ভাবনাই নেই তাহলে দায়িত্ব হচ্ছে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকে সেবা দিয়ে যাওয়া। যে বিষয় নিয়ে পড়া-লেখা হয়েছে, ওই বিষয়ের কোনো রোগী এলে চিকিৎসা দিতে কোনো কার্পণ্য না করা; বরং সামর্থ্যের সর্ব্বোচ্চটা ব্যয় করা। যদি নিজের দ্বারা সম্ভব না হয়, তাহলে কাছের কোনো হাসপাতালে রেফার করা। মনে রাখতে হবে, একজন মানুষের জীবনের মূল্য জগতের কোনো বস্তু হতে পারে না। তাই অবহেলার কারণে কেউ মারা গেলে আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে। আল্লাহ যেমন অনুগ্রহ করে আমাকে ডাক্তার বানিয়েছেন, আমারও কর্তব্য হলো মানুষের ওপর ইহসান করা।

রোগীর গোপনীয়তা রক্ষা করা : পরীক্ষা ও রোগ চিহ্নিত করা ও চিকিৎসার জন্য, রোগীর গোপনাঙ্গ দেখা জায়েজ হবে। গোপনাঙ্গ বলতে বুঝানো হয়েছে, সতরের অংশ। এক্ষেত্রেও রোগীর অনুমতি নিতে হবে। সেখানকার কোনো বিষয় মানুষের সামনে ফাঁস করে দেওয়া, অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের দোষ গোপন করবে আল্লাহতায়ালা তার দোষ দুনিয়া ও আখেরাতে গোপন রাখবেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৮৯৩) যেখানে দোষকে গোপন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেখানে দোষ নয় বরং বাধ্য হয়ে চিকিৎসার স্বার্থে নিজের কোনো বিষয় চিকিৎসকের সামনে প্রকাশ করলো আর ডাক্তার সাহেব তা মানুষের সামনে প্রকাশ করে তাকে সামাজিকভাবে হেয় করলো তাহলে এর কি কোনো বিচার হবে না?

রোগী চিকিৎসা করাতে অনীহা প্রকাশ করলে চিকিৎসকের করণীয় : রোগী চিকিৎসা করাতে অনীহা প্রকাশ করলে বা বিরত থাকতে চাইলে ডাক্তারের কিছু করণীয় আছে। চিকিৎসা না করলে ভবিষ্যতে কী কী সমস্যা হতে পারে তা রোগীকে বুঝানো। রোগ বিস্তারের ভয়াবহ দিকগুলো তার সামনে তুলে ধরা। তবে এক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত হয় এমন কিছু না বলা। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, রোগীর অনুমতি নিয়ে চিকিৎসা করা। তবে রোগ যদি সাধারণের জন্য ঝুঁকির কারণ হওয়ার মতো হয় তাহলে বিশেষ কারণে অনুমতি ছাড়াই চিকিৎসা হতে পারে। রোগীর মৌখিক সম্মতিও অনুমতি হিসেবে ধর্তব্য হবে। কোনো চিকিৎসা গ্রহণে রোগী অনীহা প্রকাশ করলে, যদি এর বিকল্প থাকে তাহলে চিকিৎসকের দায়িত্ব হলো তাকে বিকল্পটা বলে দেওয়া। একটার মধ্যে আটকে রেখে মানসিক চাপে ফেলা উচিত নয়।

সংক্রামক রোগের রোগী হলে চিকিৎসকের করণীয় : রোগ আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত কারো শরীর থেকে অন্যের শরীরে সংক্রামিত হতে পারে না। আল্লাহর নির্দেশে কোনো কোনো রোগ একজন থেকে আরেক জনের মাঝে ছড়াতে পারে। তাই এমন রোগ হলে যা ছড়ানোর আশংকা আছে চিকিৎসকের দায়িত্ব হলো যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পরিশেষে বলতে চাই  চিকিৎসা সম্পর্কে ইসলামের গাইডলাইন হলো রোগ অনুযায়ী চিকিৎসা করা। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘রোগ অনুযায়ী চিকিৎসা হলেই আল্লাহর হুকুমে আরোগ্য হয়।’ (মুসলিম) আল্লাহ আমাদের সবাইকে সুস্থ থাকা এবং রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্যলাভের তাওফিক দান করুন। আমিন!

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য
স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা, হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমিটি

 

Wordbridge School
Link copied!