• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইস্তেখারার নামাজ কী ও কেন?


উসমান বিন আব্দুল আলিম জুন ১৮, ২০২১, ১১:১৬ পিএম
ইস্তেখারার নামাজ কী ও কেন?

ঢাকা : ইস্তেখারা শব্দটি আরবী। অর্থ : কোনো বিষয়ের কল্যাণ চাওয়া। ইসলামী পরিভাষায়- দু-রাকাত নামাজ ও বিশেষ দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার নিকট দোদুল্যমান কোনো বিষয়ে মন ধাবিত হওয়ার জন্য আশা করা। অর্থাৎ দুটি বিষয়ের মধ্যে কোনটি অধিক কল্যাণকর হবে এ ব্যাপারে আল্লাহর নিকট দুই রাকাত সালাত ও ইস্তিখারার  দোয়ার মাধ্যমে সাহায্য চাওয়ার নামই সালাতে ইস্তেখারা। (ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী শরহু সহিহিল বুখারি) একজন মুমিন যে কোনো ভালো কাজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এই নিয়তে আল্লাহর কাছে যেন চায় যে, হে আল্লাহ আমি এই ভালো কাজ করতে চাচ্ছি। যদি আমার এই কাজটি ভালো বা আমার জন্য কল্যাণের হয় তাহলে আমার এই কাজে বরকত দান কর, আমার জন্য আহসান কর। আর যদি এই কাজ আমার জন্য ভালো না হয়, তাহলে আমাকে এই কাজ থেকে বিরত রাখ।

ইস্তেখারা করার হুকুম : এটি সুন্নাত। যা সহিহ বুখারি শরিফের হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যদিও অনেকে এটাকে মুস্তাহাব বলেছেন। যখন একটা মানুষ কোনো ভালো কাজ করার জন্য বা সফরে বের হবে, অথবা কোনো বিষয় সিদ্ধান্তহীনে থাকে। তখন তার উচিত হলো, আল্লাহর কাছে এর মধ্যে কল্যাণ আছে কিনা জেনে নেওয়া। ইস্তেখারার নামাজ মানে আল্লাহর ওপর ভরসা। বিয়ে, চাকরি, সফর ইত্যাদি ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালা যেই ফয়সালা করেন তার মধ্যেই আমাদের কল্যাণ রয়েছে। যদিও আমাদের যুক্তিতে তা মনমতো না হয়। কাতাদা (রহ.) বলেন, ‘মানুষ যখন আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরে পরামর্শ করে তখন আল্লাহতায়ালা তাদেরকে সব চেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার তওফিক দেন।’ ইমাম নববী (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালার নিকট ইস্তেখারা করার পাশাপাশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ভালো লোকদের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার। কারণ, মানুষের জ্ঞান-গরীমা অপূর্ণ। সৃষ্টিগতভাবে সে দুর্বল। তাই যখন তার সামনে একাধিক বিষয় উপস্থিত হয় তখন কি করবে না করবে, বা কি সিদ্ধান্ত নিবে তাতে দ্বিধায় পড়ে যায়।

ইস্তেখারার নামাজের গুরুত্ব : হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন; রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক কাজে আমাদের ইস্তেখারা করা সম্পর্কে এমনভাবে শিক্ষা দিতেন যেভাবে  কোরআনের সুরা শিক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, তোমাদের কেউ যখন কোনো কাজ করার নিয়ত করবে তখন সে দু- রাকাত নফল নামাজ আদায় করবে, এরপর সে এই দোয়াটি পাঠ করবে। (তিরমিযি-৪৮০) উক্ত হাদিস দ্বারা এটা স্পষ্ট যে, প্রতিটি মুসলমানের জন্য যে কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহর দিকে মুখাপেক্ষী হওয়া। আল্লাহর ওপর ভরসা করা। বড়ো ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তুমি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মানুষের সাথে পরমর্শ করো। অতঃপর আল্লাহর ওপর ভরসা করে (সিদ্ধান্তে অটল থাক)। আল্লাহ ভরসাকারীদেরকে পছন্দ করেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৫৯)

ইস্তেখারা নামাজের নিয়ম : ইস্তেখারা নামাজের পদ্ধতি হলো, প্রথমে পাক-পবিত্র হয়ে ইস্তেগফার করে দোয়া-দরুদ পাঠ করে নিজের যে সমস্যা আছে তা নিয়তে রেখে সুরা ফাতেহার সাথে যে কোনো সুরা মিলিয়ে দুই রাকাত নামাজ ধীর-স্থিরভাবে আদায় করা এবং হাদিসে বর্ণিত নিম্নোক্ত দোয়া পড়ে নেওয়া। তারপর সেই বিষয়ে নিজের মন যেইদিকে ঝুঁকে সেই দিকেই নিজের কল্যাণ মনে করে সেটার ওপর অটল থাকা। এটাই আসল পদ্ধতি যা হাদিসে রয়েছে। যদিও অনেক উলামায়ে-কেরাম অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন পন্থা বলে থাকেন।

ইস্তেখারার দোয়া : দুই নামাজ আদায় করে এই  দোয়াটি পড়া। উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসতাখিরুকা বিইলমিকা ওয়া আসতাকদিরুকা বিকুদরাতিকা ওয়া আসআলুকা মিন ফাদলিকাল আজিমি ফাইন্নাকা তাকদিরু ওয়া লা আকদিরু ওয়া তালামু ওয়া লা আলামু ওয়া আংতা আল্লামুলগুয়ুবি; আল্লাহুম্মা ইন কুনতা তালামু আন্না হাজাল আমরা খাইরুন লি ফি দ্বীনি ওয়া মায়িশাতি ওয়া আক্বিবাতি আমরি ফি আঝিলি আমরি ওয়া আঝিলিহি ফাইয়াসসিরহু লি ছুম্মা বারিক লি ফিহি ওয়া ইন কুনতা তালামু আন্না হাজাল আমরা শাররু লি ফি দ্বীনি ওয়া মায়িশাতি ওয়া আক্বিবাতি আমরি ফি আঝিলি আমরি ওয়া আঝিলিহি ফাসরিফহু আন্নি ওয়াসরিফনি আনহু ওয়াক্বদুরলিয়াল খাইরা হাইছু কানা ছুম্মা আরদ্বীনি বিহি।’

ইস্তেখারার দোয়ার অর্থ : ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার ইলমের ওসিলা দিয়ে আপনার কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আপনার কুদরতের ওসিলা দিয়ে আপনার কাছে কল্যাণমূলক কাজের সক্ষমতা প্রার্থনা করছি। আপনি গায়ব সম্পর্কে জ্ঞাত। হে আল্লাহ, আপনি সব জানেন আর আমি কিছুই জানি না। অর্থাৎ এ বিষয়টি আমার জন্য কল্যাণকর না অকল্যাণকর, সেই জ্ঞান আপনার আছে, কিন্তু আমার নেই। আপনার কুদরত রয়েছে আর আমার মধ্যে কোনো কুদরত-সক্ষমতা নেই। যদি আপনার ইলমে এটা থাকে যে, এই বিষয়টি (এখানে কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি কল্পনায় আনবে) আমার জন্য কল্যাণকর, আমার দীনের জন্য কল্যাণকর, আমার জীবনধারা এবং দুনিয়ার জন্য কল্যাণকর এবং পরিণতির বিচারেও কল্যাণকর, তাহলে তা আমার জন্য নির্ধারিত করে দিন। আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার জন্য তাতে বরকত সৃষ্টি করে দিন। আর যদি আপনার ইলমে এটা থাকে যে, এই বিষয়টি (এখানে কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি কল্পনায় আনবে) আমার জন্য মন্দ, আমার দীনের জন্যও মন্দ, আমার জীবনধারা এবং দুনিয়ার জন্যও মন্দ, পরিণতির বিচারেও মন্দ, তাহলে আমার থেকে তা সরিয়ে দিন এবং আমাকেও তা থেকে সরিয়ে রাখুন আর আমার জন্য কল্যাণকর বিষয় নির্ধারিত করুন, তা যেখানেই হোক। আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার জন্য তাতে বরকত সৃষ্টি করে দিন। অর্থাৎ এ বিষয়টি যদি আমার জন্য কল্যাণকর না হয়, তাহলে তা হটিয়ে দিন এবং তার স্থলে যা কল্যাণকর হবে, আমার জন্য তা নির্ধারিত করে দিন। এরপর আমাকে সে বিষয়টির প্রতি সন্তুষ্ট করে দিন এবং আমার অন্তর প্রশান্ত করে দিন।’

আরবী দোয়া যদি একান্ত স্মরণ না আসে, তাহলে নিজের ভাষায় এভাবে দোয়া করে নিলেও হবে-‘হে আল্লাহ! আমি সিদ্ধান্তের দোদুল্যমানতায় ভুগছি। আপনি আমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন।’ মুখেও যদি বলার মতো পরিস্থিতি না থাকে, তাহলে মনে মনে এ কথা স্মরণ করবে, হে আল্লাহ! এই সমস্যা এবং পেরেশানি দেখা দিয়েছে। এখন আপনি আমাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিন; যে পথ আপনার সন্তুষ্ট মোতাবেক হবে এবং যাতে আমার জন্য প্রভূত কল্যাণ নিহিত থাকবে।

ভুল প্রচলন : অনেকে মনে করে থাকেন ইস্তেখারা নামাজের নির্দিষ্ট সুরা, সময় ও নিয়ম রয়েছে। কিন্ত এটা জরুরি না। নামাজের জন্য মাকরুহাতের সময় ছাড়া আপনি যে কোনো সময় বা যে কোনো সুরা দিয়ে এটা আদায় করতে পারেন। কেউবা মনে করেন শুধু রাতেই এই নামাজ পড়া যায়, তাদের ভুল ধারণা রয়েছে। যে কোনো সময় এই নামাজ আদায় করতে পারবেন। অনেকে আবার মনে করেন ইস্তেখারা নামাজ পড়ে ঘুমাতে হয়, সেটাও ভুল। এরজন্য ঘুম জরুরি নয়। এরকম আলোচনা হাদিসে আসেনি। তবে কেউ যদি গভীর রাতে উঠে পাক-পবিত্র হয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে ঘুমিয়ে যায় এবং স্বপ্নে দেখে তারপর সে স্বপ্নে সঠিক সিদ্ধান্ত পেয়ে যায় সেই বিষয়ে। তাহলে সুন্নাত মনে না করলে এভাবে করার অবকাশ আছে। অনেক বুজুর্গ এভাবে করতেন। কাউকে আবার ইস্তেখারা তিনবার করে করতে দেখা যায়, কিন্তু এটা জরুরি মনে করা যাবে না। হাদিসে এরকম নিয়ম পাওয়া যায় না। একবার করলেই যথেষ্ট।

যদি কোনো একদিকে মন ঝুঁকে যায় তাহলে সেটাকেই আপনার জন্য কল্যাণমূলক মনে করবেন। আর যদি দোদুল্যমানতা থাকে তাহলেও চিন্তার কারণ নেই, আল্লাহর ওপর ভরসা করে নিজের মন যেটা চায় সেটাই করতে থাকুন। ওটার মধ্যেই খায়ের থাকবে ইনশাআল্লাহ। কেননা আপনি যখন কাজ করার আগে নিজেকে আল্লাহর সোপর্দ করেছেন, আল্লাহতায়ালা আপনার দ্বারা সেই কাজটাই করাবেন যা আপনার জন্য ভালো। খেয়াল রাখতে হবে, কোনো ধরনের খারাপ কাজের জন্য এরকম করা যাবে না। এতে অনেক বড় গুনাহ হবে।

আল্লামা তাকী উসমানি (হা.) বলেন যে, আমি আমার বাবা শফী (রহ.)কে যে কোনো সিদ্ধান্তের বিষয় সামনে আসলে সাথে সাথে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে চোখ বন্ধ করে ইস্তেখারার দোয়া পড়ে নিতেন। তারপর সিদ্ধান্ত নিতেন। আল্লামা ইবনে মোবারক (রহ.) বলেন, যে বান্দা নিজের বিষয়াদিতে ইস্তেখারা করে, সে কখনো ব্যর্থ হয় না। আর যে নিজের কাজকর্মের শুরুতে পরামর্শ করে, সে কখনো অনুতপ্ত হবে না যে, কেনো এ কাজটি করে ফেললাম কিবা কেনো এই কাজটি করলাম না। কেননা সে যা করেছে পরামর্শ করেই করেছে কিবা যা সে করেনি তা পরামর্শক্রমেই করেনি। এজন্য সে কখনো অনুতাপে ভোগবে না। (মাজমাউজ যাওয়ায়িদ-৮/৯৬) আল্লাহ আমাদেরকে প্রতিটি ভালো কাজ  ইস্তেখারা বা পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে করার তাওফিক দান করুন। সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবীয়া, সাভার, ঢাকা
পরিচালক, বাংলাদেশ কওমি তরুণ লেখক ফোরাম

 

Wordbridge School
Link copied!