ঢাকা : বান্দার চোখের পানি আল্লাহ তায়ালা'র নিকট অনেক দামী। দয়াময় রবের ভয়ে কান্না করতে পারা বিশাল বড় নেয়ামত। কারণ যারা আল্লাহ তায়ালা'র ভয়ে কান্না করতে পারে না তাদের চেয়ে হতভাগা এ জগতে আর কেউ নেই। আল্লাহর ভয়ে তারাই কান্না করতে পারে যাদের মন নরম হয়। অন্তর বিনয় হয়। কারণ মানুষের চোখ অন্তর ও মনের প্রতিনিধি। এর প্রমাণ মানুষ যখন টেনশন করে তখন এর ছাপ চোখেও মুখে ফুটে ওঠে। এজন্যই ইবনু কায়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, যখন আপনি আল্লাহর ভয়ে অনায়াসে কান্না করতে পারবেন, তখন বুঝবেন আপনার অন্তর ঠিক আছে। মন এখনো নরম,শক্ত ও রুক্ষ হয়নি। আর যদি কান্না না করতে পারেন, বুঝে নিবেন আপনার অন্তর শক্ত হয়ে গেছে, মন মরে গেছে। কেননা হাদিসের ভাষ্যমতে শক্ত ও রুক্ষ অন্তরের মানুষ আল্লাহর থেকে সবচে বেশি দূরবর্তী। আচ্ছা! আপনি আল্লাহর ভয়ে কেন কান্না করবেন না! অথচ আপনি সৃষ্টির সেরা জীব। আরে! পাথর ও তোরাব্বুল আলামিনের ভয়ে কান্না করে। যার প্রমাণ ঐশীগ্রন্থ আল-কোরআনে রয়েছে।
আল্লাহর ভয়ে কান্নাকারীর আরশের ছায়ায় স্থান : আল্লাহতায়ালার ভয়ে কান্না করার অনেক ফজিলত রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে দিন আল্লাহর (রহমতের) ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা তাঁর নিজের (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দিবে। তন্মধ্যে একজন হলো সে ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহর জিকর করে, ফলে তার দু-চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইতে থাকে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৬৬০)
রবের ভয়ে কান্নাকারী জাহান্নামে যাবে না : আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালার ভয়ে ক্রন্দনকারী ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে না, যেরূপ দোহনকৃত দুধ আবার স্তনে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। আর আল্লাহতায়ালার পথের (জিহাদের) ধুলা ও জাহান্নামের ধোঁয়া কখনো একত্র হবে না।’ (জামে তিরমিযি, হাদিস নং-১৬৩৯)
রবের ভয়ে কান্নাকারী চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না : ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, ‘জাহান্নাম স্পর্শ করবে না দুটি চোখ-যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে আর যে চোখ আল্লাহর পথে পাহারা দানে বিনিদ্র রজনী যাপন করে।’ (জামে তিরমিযি, হাদিস নং-১৬৪৫)
পাপের জন্য কান্না করা মুক্তির উপায় : উকবাহ ইবনে আমির (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞেস করলাম, (হে আল্লাহর রাসুল!) মুক্তির উপায় কি? তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তুমি নিজের মুখ নিয়ন্ত্রণ করো, নিজের ঘরে পড়ে থাকো এবং নিজের পাপের জন্য ক্রন্দন করো।’ (জামে তিরমিযি, হাদিস নং-২৪০৪)
অশ্রুফোঁটা রবের নিকট অতি দামি : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহপাকের নিকট দুটি ফোঁটার চেয়ে উত্তম অন্য কোনো ফোঁটা নেই। একটি হচ্ছে অশ্রুফোঁটা যা আল্লাহর ভয়ে নির্গত হয় এবং অপরটি রক্তফোঁটা যা আল্লাহর পথে জিহাদ করার সময় দেহ থেকে বের হয়।’ (জামে তিরমিযি)
কান্নার বিষয়ে পূর্বসূরীদের উক্তি : হজরত আবু বকর (রা.) বলেন, ‘মানুষের অন্তর শক্ত হলে চোখ অশ্রুহীন হয়ে যায় আর অন্তর শক্ত হয় অধিক পরিমাণে গোনাহ করার কারণে।’ আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আল্লাহতায়ালার ভয়ে কান্না করা আমার নিকট এক হাজার দিরহাম সদকা করার চেয়েও অতি প্রিয়। হজরত মোহাম্মদ বিন মুনকাদির যখন ক্রন্দন করতেন, তখন চোখের পানি চেহারা ও দাড়িতে মুছতেন আর বলতেন, আমি জানতে পেরেছি যে, যে জায়গায় চোখের পানি লাগবে সেখানে দোজখের আগুন স্পর্শ করবে না। হজরত আব্দুল্লাহ বিন উমর (রা.) বলেন, তোমরা ক্রন্দন কর, যদি ক্রন্দন না আসে তবে অন্তত উহার ভান কর। তোমরা যদি এর হাকিকত অবগত হতে, তবে এমনভাবে চিৎকার করতে যে, তোমাদের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো।
হজরত আবু সুলাইমান দারানী (রহ.) বলেন, কারো চোখ যদি অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে যায়, তবে কিয়ামতের দিন তার চেহারা অপমানিত হবে না। আর চোখের অশ্রু যদি গড়িয়ে পড়ে, তবে উহার প্রথম বিন্দু দ্বারাই বহু অগ্নি সমুদ্র শীতল হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে কোনো ব্যক্তি যদি কোনো জামাতের সাথে ক্রন্দন করে তবে সেই জামাতের লোকদের কোনো আজাব হবে না। তিনি আরো বলেন, কান্না আসে ভয়ের কারণে এবং আশা হয় শওকের কারণে। হজরত কাব আহবার বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি একটি স্বর্ণের পাহাড় দান করে দেওয়া অপেক্ষা উত্তম মনে করি আল্লাহর ভয়ে এমনভাবে ক্রন্দন করাকে যেন চোখের পানি আমার চেহারাতে গড়িয়ে পড়ে।
আসহাবে সুফফার কান্না : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন যখন এই আয়াত নাজিল হলো, ‘তবে কী তোমরা এ কথায় বিস্ময়বোধ করছ? এবং (একে উপহাসের বিষয় বানিয়ে) হাসি-ঠাট্টা করছ? এবং কান্নাকাটি করছ না? অথচ তোমরা অহমিকার সাথে খেলাধুলায় লিপ্ত রয়েছ?।’ (সুরা নাজম, আয়াত-৫৯, ৬০, ৬১) তখন আসহাবে সুফফা বলল, আমরা আল্লাহর তরে এবং আল্লাহর কাছেই আমরা ফিরে যাবো। তারপর তারা এত কান্না করলেন যে, চোখের অশ্রুতে তাদের গণ্ডদেশ সিক্ত হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কান্নার আওয়াজ শুনে কাঁদলেন। রাসুল (সা.)-এর কান্নার কারণে উপস্থিত সকলে কান্না করেছি। তারপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, যারা আল্লাহর ভয়ে কাঁদে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে না এবং কোনো জনপদের অধিবাসী আল্লাহর নাফরমানি করে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। যদি তোমরা গুনাহ না করতে আল্লাহ তোমাদের সরিয়ে এমন এক জাতি নিয়ে আসতেন যারা গুনাহ করে আল্লাহর নিকট তাওবা করবে ফলে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেবেন। তাদের প্রতি দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, দয়ালু।
হজরত আবু হাজেম রহিমাহুল্লাহ বলেন, জিবরাইল আলাইহিস সালাম নবীজির নিকট এসে একজনকে ক্রন্দনরত দেখলেন। জিবরাইল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, সে কে? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন সে অমুক। তারপর জিবরাইল আলাইহিস সালাম বলেন, ‘আমরা ফেরেশতাকুল আদম সন্তানের সকল আমল পরিমাপ করতে পারি কান্না ব্যতীত। কারণ আল্লাহতায়ালা একফোঁটা অশ্রুর কারণে জাহান্নামের আগুনের সাগর নিভিয়ে দেন।’ (তাফসিরে কুরতুবী)
চোখের পানি নিয়ে বিজ্ঞানী উইলিয়াম ফ্রের গবেষণা : চোখের পানি নিয়ে উইলিয়াম ফ্রে নামে একজন বিজ্ঞানী প্রায় ১৫ বছর গবেষণা করেছেন। গবেষণা শেষে তিনি বলেছেন, ‘চোখের পানি কোনো সাধারণ কিছু নয়। এটি পানি, শ্লেষ্মা, তেল, ইলেক্ট্রোলাইট-এর এক জটিল মিশ্রণ। এটি ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী, যা চোখকে ইনফেকশন থেকে রক্ষা করে। এটি কর্নিয়াকে মসৃণ করে, যা পরিষ্কার দৃষ্টির জন্য অত্যাবশ্যকীয়। এটি কর্নিয়াকে যথেষ্ট আর্দ্র রাখে এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে দেয়। এটি চোখের জন্য ওয়াইপার হিসেবে কাজ করে, যা চোখকে ধুয়ে ধুলোবালি থেকে পরিষ্কার করে। চোখের পানি যদি শুধুই পানি হতো, তাহলে তা ঘর্ষণের কারণে চোখ শুকিয়ে জ্বালাপোড়া করত। শীতকালে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি হলে পানি শুকিয়ে জমে বরফ হয়ে যেত!
আবার চোখের পানি যদি শুধুই এক ধরনের তেল হতো, তাহলে তা চোখের ধুলাবালি পরিষ্কার না করে উল্টো আরো ঘোলা করে দিত। চোখের পানির মধ্যে প্রকৃতির লক্ষ উপাদান থেকে এমন বিশেষ কিছু উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে, যার এক বিশেষ মিশ্রণ একই সাথে পরিষ্কার, মসৃণ এবং জীবাণুমুক্ত করতে পারে এবং অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে।
আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে তাঁর ভয়ে কান্না করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : সহাকরী শিক্ষা পরিচালক, জামিয়া দারুল উলুম মুহিউস সুন্নাহ আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া







































