• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কোরবানি যাদের ওপর ওয়াজিব


মুফতি ইমামুদ্দীন সুলতান জুলাই ৭, ২০২২, ০১:৩২ পিএম
কোরবানি যাদের ওপর ওয়াজিব

ঢাকা : সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। হাদিস শরিফে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্বেও যে কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।’ (ইবনু মাজাহ হাদিস নং-৩১২৩, মুসনাদে আহমদ-৮২৫৬) অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ জিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু এবং ঋণ ব্যতীত নিসাব পরিমাণ অর্থের মালিক হবে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার- ৯/৪৫৪-৫৭ জাকারিয়া) সুতরাং গরিব, মুসাফির এর ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়। তবে নেসাবের মালিক নয় এমন গরিব ব্যক্তি যদি কোরবানির নিয়তে পশু কিনে তাহলে জন্তুটি কোরবানি করা তার জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়। (ফাতওয়ায়ে শামী- ৯/৪৬৫ জাকারিয়া।) এছাড়া কোনো ব্যক্তি চাই সে ধনী হোক অথবা গরিব যদি কোরবানির মানত করে তাহলে আইয়্যামে নহরে তা আদায় করা আবশ্যক। (বাদায়েউস সানায়ে-৪/১৯২ জাকারিয়া)

কমার্শিয়াল লোন কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় নয়; বরং ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বা জীবিকা নির্বাহের জন্য যে লোন নেওয়া হয় একমাত্র এসব লোন-ই নেসাবের ক্ষেত্রে বিয়োগযোগ্য। তাই ব্যবসায়িক ঋণের কারণে কারো থেকে কোরবানি রহিত হবে না। (ফিকহি মাকালাত-৩/১৫৬ যমযম বুক)

কোরবানির নেসাব : কোরবানির নিসাব হলো স্বর্ণের ক্ষেত্রে (৭.৫) সাড়ে সাত ভরি, রুপার ক্ষেত্রে (৫২.৫) সাড়ে বায়ান্ন ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হলো সেগুলোর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রুপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। (আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫)

কোরবানি ও জাকাতের নেসাবের মধ্যে পার্থক্য : অনেকে মনে করেন, কারো ওপর জাকাত ফরজ না হলে তার ওপর কোরবানিও ওয়াজিব হয় না। তারা মনে করেন কোরবানি এবং জাকাতের নেসাব এক ও অভিন্ন। ফলে অনেকে কোরবানি ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও কোরবানি দেন না। তাদের এমন ধারণা সঠিক নয়। কেননা জাকাত ও কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। কোরবানির নেসাবের পরিধি জাকাতের তুলনায় ব্যাপক। মূলত কোরবানি এবং সাদাকাতুল ফিতরের নেসাব এক। জাকাতের সাথে এর কিছু পার্থক্য রয়েছে। (হিন্দিয়া-৫/২৯২, তাতারখানিয়া-১৭/৪০৫)

যে ব্যক্তির মালিকানায় কোরবানির দিনগুলোতে সাড়ে ৫২ তোলা রুপার মূল্য সমপরিমাণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো সম্পদ থাকবে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে। এখানে অতিরিক্ত সম্পদ বলতে ব্যাপক অর্থে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ফিকহী পরিভাষায় কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে সম্পদটা বর্ধনশীল হওয়া শর্ত নয়। কিন্তু জাকাতের নেসাবের ক্ষেত্রে সম্পদ বর্ধনশীল হতে হয়। আর বর্ধনশীল সম্পদ হলো, স্বর্ণ, রুপা, নগদ টাকা-পয়সা এবং ব্যবসায়ী মাল। এছাড়া জায়গা-জমি, অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ইত্যাদি বর্ধনশীল নয়। তাই জাকাত শুধু টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা ও ব্যবসায়িক পণ্যের ওপরই ফরজ হয়। এছাড়া অন্য কোনো সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ হয় না। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া-৫/২৯২ জাকারিয়া, ফাতাওয়ায়ে শামী-৯/৪৫৩ জাকারিয়া)

পক্ষান্তরে কোরবানির ক্ষেত্রে এগুলো না থাকলেও প্রয়োজন অতিরিক্ত জমি, বাড়ি বা অন্যকোনো আসবাবপত্র নেসাব পরিমাণ থাকলে কোরবানি ওয়াজিব হয়ে যাবে। সাদাকাতুল ফিতরও এমন। (আল বিনায়া-৩/৪৮২ আশরাফিয়া, মাজমাউল আনহুর-১/২২৭ বায়রুত) এছাড়া কোরবানি ও জাকাতের নেসাবের মাঝে আরেকটি পার্থক্য হলো, কোরবানির নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কোরবানির তিনদিনের মধ্যে যেকোনো দিন থাকলেই কোরবানি ওয়াজিব হবে। পক্ষান্তরে জাকাতের নেসাব পূর্ণ এক বছর থাকা জরুরি। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২)

মোদ্দাকথা কারো কাছে কোরবানির দিনগুলোতে টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা ও ব্যবসায়িক পণ্য ছাড়াও সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে কোনো সম্পদ থাকলেই তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়ে যায়। অথচ জাকাত শুধুমাত্র টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা ও ব্যবসায়িক পণ্য থাকলেই ফরজ হয়। এই তিন প্রকার সম্পদ ছাড়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত অন্য কোনো সম্পদের ওপর জাকাত আবশ্যক হয় না। (বাদায়েউস সানায়ে ৬/২৮০; তাবয়ীনুল হাকায়েক ৬/৩; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯২)

একান্নভুক্ত পরিবারের কোরবানি : যদি একান্নভুক্ত পরিবার হয় বা একাধিক ভাই বা বাবা ও ছেলে যৌথ ব্যবসা করে এবং প্রত্যেকে ব্যবসার একজন অংশীদার হয়ে থাকে তাহলে ব্যবসার সমুদয় মাল ও লভ্যাংশ ভাগ করেলে যদি প্রত্যেক সদস্য পৃথভাবে নেসাবের মালিক হয় তাহলে প্রত্যেকের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। পরিবারের যেকোনো একজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করলে তা যথেষ্ট হবে না। আর যদি ব্যবাসার মাল ও লভ্যাংশ ভাগ করলে পৃথকভাবে প্রত্যেকের নেসাব পূর্ণ না হয় তাহলে কারো ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে না। (ফাতওয়ায়ে হিন্দিয়া-৫/২৯২ জাকারিয়া, তাতারখানিয়া-১৭/৪০৫, ফাতওয়ায়ে শামী-৯/৪৫৪-৫৭ জাকারিয়া) অবশ্য বাবার সাথে সন্তানদের যৌথ ব্যবসায় যদি বাবা মূল মালিক এবং ছেলেরা সহযোগী হয়ে থাকে তাহলে শুধু বাবার ওপর কোরাবানি ওয়াজিব হবে। ছেলেদের ওপর হবে না। (ফাতওয়ায়ে শামী-৬/৫০২ জাকারিয়া)

হাজীদের কোরবানি করার বিধান : হাজীদের কোরবানি বলতে দুই ধরনের কোরবানি উদ্দেশ্য। এক. স্বাভাবিক কোরবানি যা প্রাপ্তবয়স্ক নেসাব পরিমাণ অর্থের মালিক এমন প্রাপ্তবয়স্ক মুকীম ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব হয়। মুসাফিরের ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয় না। সুতরাং হাজী সাহেবগণ যদি কোরবানি র দিনগুলোতে তারা মুকীম থাকে তাহলে তাদের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। তারা চাইলে তা ওখানে আদায় করতে পারে। আবার চাইলে নিজ দেশেও আদায় করতে পারে। তবে নিজ দেশে আদায়ের ক্ষেত্রে শর্ত হলো এমন দিনে কোরবানি করতে হবে যেদিন মক্কাতেও আইয়্যামে নহর বাকি থাকে। (দুররুল মুখতার-৯/৪৫৭ জাকারিয়া,বাদায়েউস সানায়ে-৪/১৯৫ জাকারিয়া)

আর হাজীদের বেলায় দ্বিতীয় প্রকারে কোরবানি হলো দমে শুকর। দমে শুকর হলেও এটাকে সাধারণ মানুষ কোরবানি বলে থাকে। এ হুকুমটি মূলত ওই সমস্ত হাজীদের জন্য যারা হজে তামাত্তু বা হজে কেরান করে। তাদের জন্য শুকরিয়া স্বরূপ ১১, ১২ বা ১৩ তারিখ মিনায় একটি পশু জবায়ের মাধ্যমে দমে শুকর আদায় করতে হয়। যারা হজে ইফরাদ করে তাদের জন্য এ বিধান প্রযোজ্য নয়। (সুরা বাকারা, আয়াত-১৯৬)

মোদ্দাকথা যারা হজে ইফরাদ করে তারা যদি আইয়্যামে নহরে মুকীম থাকে তাহলে তাদের ওপর শুধুমাত্র উপরোক্ত প্রথম প্রকারের কোরবানি করা ওয়াজিব। আর যদি মুকীম বা নেসাব পরিমাণ অর্থের মালিক না হয়। তাহেল কিছুই ওয়াজিব হবে না। (গুনইয়াতুন নাসিক-১৭২, মাবসুতুস সারখসি-১২/১৮ বায়রুত) আর হজে তামাত্তু বা কেরান আদায়কারী আাাইয়্যামে নহরে মুকীম ও ধনী হলে তাদের ওপর কোরবানি এবং দমে শুকর উভয়টা ওয়াজিব। আর মুসাফির হলে শুধু দমে শুকর ওয়াজিব হবে। স্বাভাবিক কোরবানি ওয়াজিব হবে না।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া ইমদাদিয়া আরাবিয়া শেখেরচর, নরসিংদী

Wordbridge School
Link copied!