• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

উদ্বোধনের অপেক্ষায় দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার


বিশেষ প্রতিনিধি মে ৯, ২০২২, ১২:৫৬ পিএম
উদ্বোধনের অপেক্ষায় দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার

ঢাকা : পয়োবর্জ্যের নেটওয়ার্ক ছাড়াই উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে রাজধানীর আফতাবনগরসংলগ্ন দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। চলতি বছরের জুলাই কিংবা আগস্টে প্রকল্পটি উদ্বোধন হতে পারে। প্রকল্পটিতে এখন চলছে ট্রায়াল রানসহ ট্রিটমেন্ট। দাসেরকান্দি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটি এশিয়ার সর্ববৃৎ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বলে দাবি করা হচ্ছে ওয়াসার পক্ষ থেকে।

রাজধানীর পয়ঃবর্জ্য শোধন করে পরিষ্কার ও দুর্গন্ধমুক্তভাবে সেই পানি নদীতে ফেলতে ঢাকা ওয়াসা মোট পাঁচটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে শুরু হওয়া দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।

এই পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের কাজ শেষ হলে গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা, মহাখালী, ডিওএইচএস, তেজগাঁও, মগবাজার, ইস্কাটন, নিকেতন, কলাবাগান (আংশিক) এবং হাতিরঝিল ও তৎসংলগ্ন এলাকার পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন করা যাবে। এতে বালু নদীতে নিষ্কাশন এবং এর মাধ্যমে পানি ও পরিবেশ দূষণ রোধ হবে। এই প্রকল্পে দিনে ৫০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন হবে। আর এর সুফল পাবে নগরের ৫০ লাখ মানুষ।

তবে বৃহৎ এই প্রকল্পের বড় ধরনের অসঙ্গতি আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, প্রকল্পটিতে নেটওয়ার্ক নির্মাণ না করায় যেসব এলাকার পয়ঃবর্জ্য শোধনের জন্য প্রকল্পটি নির্মিত হয়েছে ওইসব এলাকার পয়ঃবর্জ্য এখনই শোধন করা যাবে না।

নাম না প্রকাশের শর্তে ওয়াসার একাধিক প্রকৌশলী বলেন, আফতাবনগর সংলগ্ন দাশেরকান্দি শোধনাগার নির্মাণে বর্তমানে যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তাতে নেটওয়ার্ক নির্মাণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। নেটওয়ার্ক নির্মাণ একটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। পয়োবর্জ্যের নেটওয়ার্ক করতে কয়েক হাজার কোটি টাকার নতুন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এতে সময় লাগবে কয়েক বছর। নেটওয়ার্ক না থাকায় এখন প্রকল্প শেষে শোধনাগার ফেলে রাখতে হবে।

নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ওয়াসার কর্মকর্তাদের অদূরদর্শিতার কারণে অর্থ ব্যয় করেও সুফল পাওয়া যাবে না। এটি ইচ্ছাকৃতভাবে জনগণের অর্থের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। প্রকল্প শুরুর আগে থেকেই ওয়াসা জানত, নেটওয়ার্ক ছাড়া শোধনাগারটি অব্যবহূত ফেলে রাখতে হবে। এমন প্রকল্প গ্রহণের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

যদিও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে আপাতত হাতিরঝিলের এসএসডিএসের বিদ্যমান নেটওয়ার্কগুলোর সংযোগ থেকে আসা বর্জ্য শোধন করা হবে দাশেরকান্দিতে।

ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, নেটওয়ার্ক তৈরি না করায় দাশেরকান্দি শোধনাগারটি যেসব এলাকার জন্য করা হচ্ছে, তারা সুফল পাবে না। এই শোধনাগারের আওতাভুক্ত এলাকায় পয়োনেটওয়ার্ক করতে চীনের অর্থায়নে একটি নতুন প্রকল্প নেওয়া হবে। তার আগ পর্যন্ত ঢাকায় বিদ্যমান যেসব নেটওয়ার্ক আছে, সেগুলোর সংযোগ দাশেরকান্দিতে দেওয়া হবে।

ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানায়, দাশেরকান্দি শোধনাগার প্রকল্পের নির্ধারিত এলাকার জন্য পাইপলাইন নেটওয়ার্ক একটি আলাদা প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। ইতোমধ্যে নেটওয়ার্ক তৈরির জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, চীনের এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নের জন্য তা প্রক্রিয়াধীন। এর আগপর্যন্ত হাতিরঝিলের দুই পাশের সীমানা বরাবর নির্মিত বিশেষ পয়োবর্জ্য ডাইভারশন অবকাঠামো (এসএসডিএস) থেকে আসা বর্জ্য শোধন করা হবে দাশেরকান্দিতে।

ওয়াসা সূত্র জানায়, বর্তমানে ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন হাজার লিটার পয়োবর্জ্য উৎপন্ন হয়। ঢাকায় ৮৮১ কিলোমিটার পয়োনালা আছে। ঢাকার ২০ ভাগ এলাকা পয়োনালার আওতায় এসেছে। এর বাইরে ঢাকার আর কোনো এলাকায় পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই।

ঢাকা মহানগরীর মাত্র ২০ শতাংশ এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা রয়েছে। ৮০ শতাংশ এলাকাতেই তা নেই। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ এক প্রকল্প প্রস্তাবে এমনটি বলেছে।  

জানা যায়, ঢাকা শহরে প্রতিদিন তৈরি হওয়া ১৭৫ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্যের মধ্যে মাত্র ৩৫ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য শোধন করতে পারে ঢাকা ওয়াসা। বাকি ১৪০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য ঢাকা ও চারপাশের নদী, খাল এবং জলাশয়ে মিশছে। এর ফলে নগরীর পরিবেশ দূষণ এবং বাসযোগ্যতা নষ্ট হচ্ছে।

এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড স্যানিটেশন’ প্রকল্পের আওতায় স্যুয়ারেজ মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে ঢাকা ওয়াসা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলছে, এর আওতায় রাজধানীতে পাঁচটি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিটিপি) তৈরি করবে ওয়াসা।

ঢাকা ওয়াসার প্রথম সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটি নারায়ণগঞ্জের পাগলা পয়ঃশোধনাগার। এটিতে দৈনিক ৩৩ কোটি লিটার থেকে ৪০ কোটি লিটার বর্জ্য শোধন করা হচ্ছে। দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারটি দ্বিতীয়।

এরপর রায়েরবাজার, উত্তরা, মিরপুর ও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় আরো চারটি পয়ঃশোধনাগার করবে ওয়াসা। এর মধ্যে রায়েরবাজার পয়ঃশোধনাগারটিকে আন্ডারগ্রাউন্ড পয়ঃশোধনাগার করতে চায় ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। ২০২৭ সালের মধ্যে এসব পয়ঃশোধনাগার কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান এ প্রসঙ্গে বলেন, পাগলা পয়ঃশোধনাগারের কাগজ-কলমের কাজ শেষ হয়েছে। টেন্ডারও ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে আশা করছি অচিরেই আমরা ফিজিক্যাল কাজে যেতে পারব ওটা হলে যে ক্যাচমেন্ট এরিয়াটা লালবাগ এবং পুরান ঢাকার আমাদের জোন ২ এবং ১-এর অংশবিশেষ পরিশোধনাগার আওতায় আনতে পারব। উত্তরা সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের ভূমি অধিগ্রহণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়। রায়েরবাজারেরটির ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ হয়েছে। কন্সেপচ্যুয়াল ডিজাইন ও বিডিং ডকুমেন্ট প্রণয়ন করা হয়েছে। মিরপুর সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের ভূমি দিচ্ছে ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট। এই তিনটারই ডাইন আপ করা আছে। ঋণদাতা ব্যাংকের সঙ্গেও ডাইনআপ করা আছে আশা করি যথা সময়ে এগুলোর কাজ শেষ করতে পারব।

দাসেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’- কর্মসূচির মাধ্যমে ঢাকা শহরের পানি ব্যবস্থাপনা আমূল পরিবর্তন এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে কতগুলো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে শুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হাতে নেওয়া হয়েছে। ঢাকা শহরকে একশতভাগ সুয়ারেজ নেটওয়ার্কে মধ্যে নিয়ে আসা এবং পয়ঃবর্জ্য ট্রিট করে নদীতে ফেলার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে আমরা ইতোমধ্যেই পাঁচটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হাতে নিয়েছি। যা আমাদের মাস্টার প্ল্যানে রয়েছে। এর মধ্যে দাসেরকান্দি একটা।

দাসেরকান্দি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় একটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। চীনা প্রতিষ্ঠান কাজটি করেছে। হাতিরঝিলের যে সমস্ত বর্জ্য আমরা বাইপাস করেছি, সেগুলো যাচ্ছে ওখানে। সেখানে ট্রিট করার কথা। এ কাজ প্রায় শেষ। চূড়ান্ত পরীক্ষা চলছে।

ট্রিটমেন্ট চলছে, ট্রায়াল রান চলছে। আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে জুলাই কিংবা আগস্টে।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। শুরুতে প্রকল্পের খরচ ছিল তিন হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। পরে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে বাড়ানো হয় খরচ। ৩৯৫ কোটি টাকা বেড়ে এই প্রকল্পে খরচ দাঁড়ায় তিন হাজার ৭১২ কোটি টাকা।

প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, প্রকল্পের অধীনে প্রগতি স্মরণিতে রামপুরা সেতুর পশ্চিম পাশে একটি বর্জ্য লিফটিং স্টেশন, রামপুরা থেকে আফতাবনগর হয়ে দাশেরকান্দি শোধনাগার পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ট্রাংক সুয়্যার লাইন (পয়োবর্জ্য পরিবহনের প্রধান লাইন) ও দাশেরকান্দিতে শোধনাগার নির্মাণ করা হবে। চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। কাজ বাস্তবায়ন করছে চীনা প্রতিষ্ঠান হাইড্রো চায়না করপোরেশন। সূত্র : বাংলাদেশের খবর

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!