• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একজন রাবেয়া খাতুন


সালেহীন বাবু জানুয়ারি ৪, ২০২০, ০৪:১২ পিএম
একজন রাবেয়া খাতুন

ঢাকা : রাবেয়া খাতুন সমকালীন বাংলা সাহিত্যের এবং এই সময়ের বাঙালি লেখকদের মধ্যে আলোকিত ও আলোচিত নাম। তার সাহিত্য সৃষ্টিতে বহুমাত্রিকতা, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মানুষের মনের জাগরণ, নির্লিপ্ততা, শিল্পের জন্য শিল্প, সাহিত্যের গভীরতা, নারী জাগরণ ও আবহমান বাংলা জীবনের ছবির সঙ্গে নৈসর্গ চেতনা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। আর এ কারণেই সমকালীন সাহিত্যে আলোচিত ও   প্রাসঙ্গিক নাম রাবেয়া খাতুন।

তার শিল্পযাত্রায় আমাদের সমাজের পরিবর্তনগুলো চিহ্নিত হয়। পরিণতজনদের কথাসাহিত্যে যেমন, তেমনই ছোটদের জন্য রচনার বেলাতেও একই। ষাটের কাছাকাছি উপন্যাসের রচয়িতা তিনি। এখন পর্যন্ত সংকলিত ছোটগল্পের সংখ্যাও চারশ ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। সংখ্যায় ছোটদের জন্য লেখা গল্প-উপন্যাসের সংখ্যাও প্রচুর।

গ্রাম সমাজ ও নাগরিক সমাজের পরিবর্তন চিহ্নিত হয়েছে তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘মধুমতী’তে (১৯৬৩)। উন্মোচিত হয়েছে তাঁতি সম্প্রদায়ের জীবন সংকটের সঙ্গে নাগরিক উঠতি মধ্যবিত্ত জীবনের পটভূমি। কথাসাহিত্যিক হিসেবে তার যাত্রা শুরু এমন একটা সময়ে যখন ঢাকা অঞ্চলের মানুষ অবস্থান করছিল আধুনিকতা ও গ্রামীণতার সন্ধিক্ষণে। সে কারণেই আধুনিকতার প্রশ্নে রাবেয়া খাতুনের কথাসাহিত্য গুরুত্ব পায়।

ঢাকাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত সমাজের সঙ্গে তিনি গ্রাম জীবনের সম্পর্ক ধরে রেখেছেন উপন্যাস ও ছোটগল্পের আধারে। সে সময় পুরান ঢাকা কাঠামোগত দিক থেকে নগর হয়ে উঠলেও গাঢ় হয়ে ওঠেনি তার যথার্থ নাগরিক জীবন। তবে এখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে গ্রামের জীবনযাত্রার ছিল বিস্তর ফারাক। পুরান ঢাকার  স্বাতন্ত্র্যকে রাবেয়া খাতুন স্বচ্ছভাবে তুলে আনতে পেরেছিলেন ‘রাজাবাগ’ (১৯৬৭), ‘বায়ান্নো গলির এক গলি’ (১৯৮৪), ‘সাহেব বাজার’ (১৯৬৯) প্রভৃতি উপন্যাসে। মুক্তিযুদ্ধ তার সংবেদনশীলতাকে নাড়া দেয় বলেই বারবার তার গল্প-উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ উপজীব্য হয়। নয় মাসের অবরুদ্ধ সময়ের দিনলিপিও একদিকে হয়ে ওঠে সাহিত্য, অন্যদিকে অকাট্য দলিল। মুক্তিযুদ্ধকালের পরিস্থিতি বাংলাদেশের মানুষের জীবনবোধকে কীভাবে বিবর্তিত করেছে, তাও তার কথাসাহিত্যে ফুটে ওঠে।

‘মোহর আলী’ (১৯৮৫) উপন্যাসে সমাজের জীবনবোধকে ধরে রাখা হয়েছে। আবার সাম্প্রতিক জীবনধারাকেও তিনি ধারণ করেন সজীবতায়। ‘দূরে বৃষ্টি’ (২০০৩), ‘ঠিকানা বি এইচ টাওয়ার’ (২০০৫), ‘কুয়াশায় ঢাকা নগর বধূ’ (২০০৩), ‘রমনা পার্কের পাঁচ বন্ধু (২০০৩) ইত্যাদি উপন্যাসে বিশ্বায়ন-কবলিত নগরজীবনের সংকট ও স্বপ্নকে বা স্বপ্নভঙ্গকে ধারণ করেছেন। এখানেও মূর্ত হয়েছে চিহ্নিত জীবন।

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পেয়েছিলাম বাংলাদেশ রাষ্ট্র। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীরা এখনো তৎপর। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখনো চলছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কথাটির মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধকেই বহাল রাখার কথা বলা হয়। রাবেয়া খাতুন এই চেতনায় উজ্জীবিত লেখক বলেই ‘প্রথম বধ্যভূমি’ (২০০৪) উপন্যাস লেখেন ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে, ‘ফেরারী সূর্য’ (১৯৭৫), ‘ঘাতক রাত্রি’ (১৯৯৯), ‘হিরণ দাহ’ (১৯৯৫), ‘বাগানের নাম মালনিছড়া’ (১৯৯৫), ‘হানিফের ঘোড়া’ (১৯৯৫) লেখেন মুক্তিযুদ্ধের শ্বাসরুদ্ধকর দিনগুলো নিয়ে।

পল্লীজীবনের বিবর্তনকথা তিনি বলেছেন, ‘ই ভাদর মাহ ভাদর’ (১৯৮৮) উপন্যাসে। তার স্বামী প্রয়াত ফজলুল হক চলচ্চিত্রকার হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘সিনেমা’ নামে চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা, যখন বাংলাদেশে চলচ্চিত্রেরও সূচনা ঘটেনি। সেই সুবাদে এই জগতের মানুষ সম্পর্কে অনেক কাছ থেকে জেনেছেন। ফলে তিনি লিখে ফেলতে পারেন ‘রঙ্গিন কাচের জানলা’ (২০০১) বা ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ (২০০৪) উপন্যাস।

পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে লেখা তার ছোটগল্পগুলোকে যথার্থ নান্দনিক মাত্রা বিচারের মাধ্যমে নির্বাচন করা হলে হয়তো তার মধ্যে আরও শক্তিমান একজন গল্পকারকে শনাক্ত করা সম্ভব।

ব্যতিক্রমী রাবেয়া খাতুন ভ্রমণ শুধু ভালোই বাসেন না, ভালোবাসেন তার আনন্দ ও উপলব্ধিকে পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে। ভ্রমণসাহিত্য রচনাকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করেছেন বলে তার এই আঙ্গিকের বইও অনেক। ‘হে বিদেশী ভোর’ (১৯৯০), ‘মোহময়ী ব্যাংকক’ (১৯৯১), ‘টেমস থেকে নায়েগ্রা’ (১৯৯৩), ‘কুমারী মাটির দেশে’ (১৯৯৪), ‘হিমালয় থেকে আরব সাগরে’ (১৯৯৯), ‘কিছুদিনের কানাডা’ (২০০০), ‘চেরি ফোটার দিনে জাপানে’ (২০০১), ‘কুমারী মাটির দেশ অস্ট্রেলিয়া (২০০৪), ‘মমি উপত্যকা এবং অন্যান্য আলোকিত নগর’ (২০০৫) তার উল্লেখযোগ্য ভ্রমণসাহিত্য। আরো অনেক লেখা পত্রপত্রিকার পাতায় ছড়িয়ে আছে।

সরাসরি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী না লিখলেও আত্মজৈবনিক স্মৃতিমূলক রচনা লিখেছেন। ‘একাত্তরের নয় মাস’-এ (১৯৯০) লিখেছেন একাত্তরের শ্বাসরুদ্ধকর দিনগুলোর কথা। স্মৃতিকথায় নিজের কথা নয়, নিজের হয়ে ওঠায় যেসব মানুষের প্রভাব ও ভূমিকা রয়েছে তাদের কথা বলেছেন। ‘স্বপ্নের শহর ঢাকা’ (১৯৯৪), ‘স্মৃতির জ্যোতির্ময় আলোয় যাঁদের দেখেছি’ (২০০৫), ‘চোখের জলে পড়ল মনে’ (২০০৮) বইয়ে নিজের ব্যক্তিজীবন নয়। পরিবার ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের উজ্জ্বল যেসব ব্যক্তির সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তাদের ছবি পাওয়া যায়।

আপনাআপনি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাঙালির চিরকালের লোক-সংস্কৃতির সম্পদকে রাবেয়া খাতুনের সহজাত প্রতিভা নিয়েছে আত্মস্থ করে।

তিনি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীরও লেখক। ছোটদের জন্য লেখা প্রথম বই ‘দুঃসাহসিক অভিযান’ (১৯৬৭) যার নিদর্শন। নগরজীবনের পটভূমিকায় লেখা ছোটদের উপন্যাস ‘সুমন ও মিঠুর গল্প’ তো আধুনিক ক্ল্যাসিকই হয়ে উঠেছে। ছোটদের জন্য লেখা ‘একাত্তরের নিশান’ (১৯৯২) উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি উপস্থিত রয়েছে। ইতিহাসের ঘটনা মানুষের মধ্যে জীবনবোধের রূপান্তর ঘটায় তার পরিচয় রয়েছে ছোটদের জন্য লেখা তার ‘তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা’ (১৯৮১) উপন্যাসে।

রাবেয়া খাতুনের জন্মদিন ছিল ২৭ ডিসেম্বর। এদিন রাবেয়া খাতুনের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসসমগ্র’-এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বইটি প্রকাশ করেছে অনন্যা প্রকাশনী। রাবেয়া খাতুন বহুদিন পর কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে নিজের লেখা ও প্রকাশিত এ যাবৎকালে সবশেষ বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন। বইটি এবারের একুশে বইমেলাতেও পাওয়া যাবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!