• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
জীব ও পরিবেশ

প্রাণের সুন্দরবনে ক্ষত


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ১৭, ২০১৯, ০১:২৮ পিএম
প্রাণের সুন্দরবনে ক্ষত

ঢাকা : সুন্দরবন আমাদের প্রাণ, আমাদের ঐতিহ্য। নিকট অতীতে আইলা কিংবা সিডরের মতো মহাপ্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলকে বাঁচিয়েছে মমতাময়ী মায়ের মতো। এখনো লাখো মানুষের প্রতিদিনের জীবন বাঁচে এই বাদাবনের কৃপায়। দেশের বড় একটা জনগোষ্ঠী এই বনের কৃপায় যেমন বেঁচে থাকছে তেমনি বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মাথাও উঁচু করে রেখেছে ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে।

তবে সুন্দরবনের প্রতি যতটুকু দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল তার ধারের কাছেও নেই আমরা। যান্ত্রিক কোলাহল আর দূষণে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের বর্ম খ্যাত এই বন। একদিকে যেমন ‘উন্নয়নের অনুন্নয়’ হুমকির মুখে ফেলছে এই বনকে অন্যদিকে সেই হুমকিকে আরো শক্তিশালী করছে কৌশলে আর চুপিসারে বন উজারের ঘটনা।

সম্প্রতি স্যাটেলাইট ইমেজে ধরা পড়েছে প্রাণের এই বনের স্থানে স্থানে দগদগে ক্ষতের দৃশ্য। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের নারিকেলবাড়িয়া এলাকায় বনের বাইরের দিকে কিছু গাছ রেখে ভেতর থেকে প্রায় ৪০ একর বন উজার করা হয়েছে। সেখানে গড়ে উঠেছে শুটকি পল্লী। এই ঘটনায় বন বিভাগের চরম উদাসীনতা বা কর্মকর্তাদের অসাধুপনাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঘটনাটি খতিয়ে দেখতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ সরকার চাইছে সুন্দরবনের পাশাপাশি অন্যান্য বনের আকার ও বৈচিত্র সংরক্ষণ করতে। এই লক্ষ্যে ২০১৬ সালের বননীতিতে রাখা হয়েছে বনভূমি বাড়ানোর পরিকল্পনা। দেশে বর্তমানে ১৭ শতাংশ জমিতে বন থাকলেও সরকার চাইছে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশের মোট আয়তনের ২০ শতাংশই সবুজে আচ্ছাদিত হোক। বাড়ুক বন আর বনের জীববৈচিত্র্য। বাঁচুক আমাদের প্রিয় জন্মভুমি।

এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে। সুন্দরবনকে প্রাণের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তুলতে তাকে সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে ‘জলদস্যু মুক্ত’ হিসেবে। তবে গত বছরের নভেম্বর মাসে এই প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরেও অবৈধ হরিণ শিকারের একাধিক খবর ছাপা হয়েছে পত্রিকার পাতায়। আর অতি সম্প্রতি খবর আসলো বন উজারের।

খবরে প্রকাশ, সুন্দরবনের দুবলারচরসহ মেহের আলী, মাঝির কেল্লাসহ নানান চরে রোদে শুটকি শুকান শ্রমিকরা। সেই সব শ্রমিকদের কথার সূত্র ধরেই প্রথমে জানা যায় নারিকেলবাড়িয়ার আরেকটি পল্লীর কথা। পরে স্যাটেলাইটে ধারণ করা ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ওই এলাকার প্রায় ৪০ একর বন কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা।

এই শুটকি পল্লীটির চরটি বন থেকে বেশখানেক দূরে। এই অংশের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী থেকে বনের কোনো অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ে না। কারণ কৌশল হিসেবে নদীর পড়ের দিকের কিছু গাছ রেখে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। কিন্তু স্যাটেলাইট ছবি বলছে বছর দশেক আগেও এই শুটকি পল্লীটি ছিল চরে। এরপর সেটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বনের ভিতর। পরে সেই বনে প্রায় ৪০ একর বাড়ানো হয়েছে শুটকি পল্লীর আয়তন। এভাবেই বছর বছর গাছকাটা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

এ বিষয়ে পক্ষ থেকে নারিকেলবাড়িয়ার শুঁটকি পল্লীর পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেছেন, ওই এলাকায় নতুন করে কোনো গাছ কাটা হয়নি। সেখানে আগেই এভাবে শুটকি পল্লী ছিলো।

এই ঘটনায খুলনা অঞ্চলের উপ বন সংরক্ষক মো. কবির হোসেন পাটোয়ারী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের ডিএফও মো. মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। কিন্তু একাধিকবার মুঠোফোন কল দিয়েও পাওয়া যায়নি তাকে। তবে দুইদিন আগে বেসকারি টেলিভিশন চ্যানেলটির কাছে কোনো মন্তব্য করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন ডিএফও মো. মাহমুদুল হাসান।

অথচ সুন্দরবনসহ দেশের বনাঞ্চল রক্ষার প্রত্যয় ব্যক্ত করেই সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া হাবিবুন নাহার সংবাদমাধ্যকে বলেছেন, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন রক্ষায় স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হবে। সুন্দরবন আমাদের সবার। এই বন রক্ষার দায়িত্ব সবাইকেই নিতে হবে। বিশেষ করে সুন্দরবন লাগোয়া যেসব সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্যরা আছেন, তাদের বন রক্ষার ক্ষেত্রে কঠিন হতে হবে।

তিনি বলেন, সুন্দরবনের সব ধরনের সম্পদ রক্ষায় বন বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হবে। সম্পূর্ণভাবে বনজ দ্রব্য আহরণ বন্ধ করা গেলেই সুন্দরবনকে রক্ষা করা যাবে।

এদিকে নাড়িকেলবাড়িয়ার বন উজারের ঘটনার বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বন অধিশাখা) খোরশেদা ইয়াসমীনও কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তিনি এ বিষয়ে স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক ফারুক আহমেদ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, বিশ্বব্যাপী আশঙ্কাজনক হারে ম্যানগ্রোভের ধ্বংস বেড়েই চলেছে। গত ৫০ বছরে আমরা হারিয়েছি পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। স্থানীয় জনবসতিতে বনজ সম্পদের চরম অপব্যবহার, বড় ধরনের উন্নয়ন,  কৃষি, বনায়ন, লবণ আহরণ, নগরায়ণ ও অবকাঠামো স্থাপন এবং সেচের জন্য স্বাদু পানির গতিপথ পরিবর্তন ইত্যাদির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বন। এর মধ্যে বনের গাছ উজার করার ঘটনা ম্যানগ্রোভকে বলি দেওয়ার সামিল।

সুন্দরবনের মতো একটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গাছ কেটে শুটকি পল্লী স্থাপনের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেছেন, একটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে শুঁটকি পল্লীসহ কোনো ধরনের স্থাপনা বা কার্যক্রম পরিচালনার এখতিয়ার কারো থাকার কথা না। বন বিভাগের কারও যোগসাজশেই এমন হয়ে থাকতে পারে।

তিনি বলেন, বন খেকোদের থামাতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। ওই এলাকার শুঁটকি পল্লী উচ্ছেদ করতে হবে। সময় সাপেক্ষে সেখানে আবার বন ফিরে আসবে। বনরক্ষীদের কেবল পাহারা দিলেই হবে।

রিজওয়ানা হাসান ঘটনাটি ক্ষতিয়ে দেখতে দুদকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে, বন কর্মকর্তাদের অজান্তে এমন ঘটনা ঘটতে পারে না। তাদের দুর্নীতির কড়াল থাবা পড়েছে আমাদের প্রাণের সুন্দরবনে। তাই ঘটনাটি জরুরি ভিত্তিতে দুদকের খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!