• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
আজ চা শ্রমিক দিবস

দাসত্বের শৃঙ্খলেই চা শ্রমিকরা


বিশেষ প্রতিনিধি মে ২০, ২০১৮, ০১:২৭ পিএম
দাসত্বের শৃঙ্খলেই চা শ্রমিকরা

ঢাকা : সিলেটের মদন মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বিএ (পাস) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সজল গোয়ালা। পরিবারের সঙ্গে থাকেন স্থানীয় লাক্কাতুরা চা বাগানের শ্রমিক কলোনিতে। সজল ভালো চাকরি করে পরিবারের অভাব দূর করবেন- এমন প্রত্যাশায় তার লেখাপড়ার খরচও দিচ্ছিলেন চা শ্রমিক বাবা-মা। তবে পরিবারের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই দৈনিক ৮৫ টাকা মজুরিতে চা বাগানে মজুরের কাজ নিয়েছেন সজল। উপযুক্ত কাজের নিশ্চয়তার অভাব আর সপরিবারে বসতি হারানোর ভয় তাকে এই পথ বেছে নিতে বাধ্য করেছে। ভূমির মালিকানার অধিকার না থাকায় সজলের মতো চা বাগানের ‘অদৃশ্য শৃঙ্খলে’ আটকা পড়ে আছে আরেক শিক্ষিত যুবক উত্তম লোহারের স্বপ্নও। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার পাশাপাশি লেখাপড়া ও চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন চা শ্রমিক নেতারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের মোট ১৬২টি বাগানে চা শ্রমিক প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার। এসব শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১৪ লাখ মানুষ। দৈনিক ৮৫ টাকা আয়ে পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণ করতে হচ্ছে শ্রমিকদের। রেয়াত মূল্যে চাল ও আটা পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকলেও মাছ, মাংস, সবজি, ডিম ও দুধের মতো পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারছেন না তারা। সেখানে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালানো তো অনেক কষ্টকর। ফলে এসব পরিবারের নতুন সদস্যরাও বাধ্য হচ্ছে চা শ্রমিকের কাজে যোগ দিতে। আজ ২০ মে চা শ্রমিক দিবস সামনে রেখে এমন দাসত্ব থেকে মুক্তি চাইছিলেন এ খাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সূত্র জানায়, ১৯২১ সালের এই দিনে ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হতে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক জš§স্থানে ফেরার চেষ্টা চালান। এ সময় চাঁদপুরের মেঘনাঘাটে গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয় চা শ্রমিকদের। এর পর থেকে ২০ মে ‘চা শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন তারা।

চা শ্রমিক আন্দোলনের নেতা বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালি কার্যকরী পরিষদের সভাপতি রাজু গোয়ালা জানান, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়া চা বাগানে চা চাষ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সময় বৃহত্তর সিলেটে চা বাগান তৈরির জন্য আসাম, ওড়িশা, বিহার, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকদের নিয়ে আসা হয়। গাছ লাগানো হলেই টাকা- এমন প্রলোভনে শ্রমিকরা সিলেটে এলেও তাদের ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। পাহাড় পরিষ্কার করে চা বাগান করতে গিয়ে হিংস্র পশুর কবলে অনেক শ্রমিক মারাও যান।

তিনি জানান, ব্রিটিশদের নির্যাতনের প্রতিবাদে তৎকালীন চা শ্রমিক নেতা পণ্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পণ্ডিত দেওসরন ‘মুল­ুক চল’ (দেশে চল) আন্দোলনের ডাক দেন। ১৯২১ সালের ২০ মে সিলেট অঞ্চলের ৩০ হাজার চা শ্রমিক হেঁটে চাঁদপুরের মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌঁছান। তারা জাহাজে চড়ে নিজ ভ‚মিতে ফিরতে চাইলে ব্রিটিশরা গুলি চালিয়ে কয়েক হাজার শ্রমিককে হত্যা করে মেঘনায় ভাসিয়ে দেয়। যারা পালিয়ে এসেছিলেন তাদেরও আন্দোলন করার অপরাধে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর ২০ মে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

সম্প্রতি সিলেট জেলার মালিনীছড়া, লাক্কাতুরা, তারাপুরসহ বেশ কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা গেছে, সময়ের ব্যবধানে দেশের অর্থনীতির চিত্র পাল্টালেও চা শ্রমিকদের দৈন্য দশা কাটছে না। দৈনিক ৮৫ টাকা মজুরিতে সংসার চালাতে হয়। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে ঠিকমতো পড়ালেখা করানো হয়ে ওঠে না সন্তানদের। দৈন্য তাই এখনো তাদের নিত্য সঙ্গী।

চা শ্রমিক নেতা কাঞ্চন পাত্র জানান, চা শ্রমিকদের জীবনমানে কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়নি। অবিলম্বে চা শ্রমিকদের চুক্তি নবায়ন, দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা নির্ধারণ, রেশন হিসাবে সাপ্তাহিক ৫ কেজি চাল দেওয়ার দাবি জানান তিনি। কেন্দ্রীয় চা শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল জানান, দেশের ৯৪টি সম্প্রদায়ের প্রায় ১৫ লাখ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোক চা বাগানের ওপর নির্ভরশীল। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেরা লেখাপড়া ও চাকরিতে কোটা সুবিধা পেলেও চা শ্রমিকরা পান না। নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে লেখাপড়া ও চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি।

চা শ্রমিক নেতা রাজু গোয়ালা জানান, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না থাকায় শ্রমিকরা নিজেদের উদ্যোগে এবারও চা শ্রমিক দিবস পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে র‌্যালি ও আলোচনা সভা। ভূমির অধিকার, দৈনিক মজুরি বাড়ানোসহ ২০ দফা দাবি আদায়ে মানববন্ধনও করা হবে।

সরেজমিন দেখা যায়, চা বাগানের এক প্রান্তে কলোনিতে থাকেন শ্রমিকরা। তাদের বসবাসের এলাকা চা বাগানে ‘লেবার লাইন’ হিসেবে পরিচিত। ১২ হাত দৈর্ঘ্য ও ৮ হাত প্রস্থের মাটির ঘরে গাদাগাদি করে থাকে একেকটি পরিবারের ৮-১০ জন সদস্য। সন্তানদের পড়ালেখাও করতে হয় এমন পরিবেশে।

শ্রমিক নেতারা জানান, দীর্ঘদিন দৈনিক ৬৯ টাকা মজুরিতে কাজ করেন চা শ্রমিকরা। ২০১৫ সালে দৈনিক ২৩০ টাকা মজুরি, লাভের ৫ শতাংশ, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটি চালুসহ ২০ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনে দৈনিক মজুরি ১৬ টাকা বেড়ে ৮৫ টাকা হলেও তাদের ২০ দফার কোনো দাবিই পূরণ হয়নি।

শ্রমিক নেতা অ্যাডভোকেট মোশরেফা মিশু মনে করেন, ভাগ্য ফেরাতে চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৪০০ টাকা হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমলের জরাজীর্ণ ঘরে এসব শ্রমিক মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন। ভূমির অধিকার না থাকায় চা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা আজো দাসত্বের বাঁধনেই রয়ে গেছেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!