• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেও চাকরি জুটেনি পরিতোষের


মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, নাটোর থেকে নভেম্বর ১৮, ২০১৭, ০৩:৪৫ পিএম
প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেও চাকরি জুটেনি পরিতোষের

নাটোর: মায়ের পাঠানো টাকায় খাওয়া-হোস্টেল ভাড়া আর টিউশনি করে নিজের খরচ চালানোর চেষ্টা করে প্রতিবন্ধী যুবক পরিতোষ বিবিএ পাশ করেছেন কিন্তু কপালে জুটেনি একটা চাকরি।

জানা যায়, এন,এস সরকারি কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে বিবিএ করা মেধাবী ছাত্র পরিতোষ কুমার। ইতিমধ্যে বিবিএ অনার্সে প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছে সে। শারীরিক প্রতিবন্ধী পরিতোষের বাড়ি নাটোরের সিংড়া উপজেলার বনকুড়াইল গ্রামে। পরিতোষ যখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র তখন বাবা জ্যোতিষ চন্দ্র পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান। অনাথ পরিতোষ ও তার পুরো পরিবারের ভার তখন মায়ের কাধে। নিজেদের থাকার ভিটেটুকু ছাড়া আর কিছুই নাই। ভাইবোনগুলো তখন ছোট। বহুকষ্টে গ্রামের একটি স্কুলে পরিতোষকে পড়ালেখা করান তার মা।

২০০৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪.০০ পেয়ে সিংড়ার রহমত ইকবাল ডিগ্রি কলেজ উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন পরিতোষ। অল্প দিনেই পড়াশোনায় ভালো করার কারণে নজরে আসেন কলেজের শিক্ষকদের। একজন শারীরিক প্রতিবন্ধীর পড়াশোনায় আগ্রহ দেখে কলেজের অধ্যক্ষ মুনসুর রহমান মুকুলের আন্তরিকতায় পরিতোষের পড়ালেখার যাবতীয় ব্যয়ভার গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ।

ওই কলেজ থেকে ২০১১ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪.৯০ পেয়ে পাশ করেন পরিতোষ। যোগ্যতা থাকা সত্বেও পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফর্ম কিনে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারেনি পরিতোষ। একই বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এনএস সরকারি কলেজ থেকে অনার্স ১ম বর্ষ ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এর কিছুদিন পর পরিতোষ বুঝতে পারেন অনার্সে পড়ালেখার খরচ বহন করা তার পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সে পুনরায় রহমত ইকবাল ডিগ্রী কলেজে ফিরে যান এবং অধ্যক্ষের পরামর্শে অনার্সের ভর্তি বাতিল করে ওই কলেজেই ডিগ্রিতে ভর্তি হবার জন্য মন স্থির করে।

এন এস সরকারি কলেজে অনার্সের ভর্তি বাতিল করতে এলে তার পারিবারিক অস্বচ্ছলতার বিষয়টি শিক্ষকরা জানতে পারেন। তখন ওই বিভাগের প্রভাষক এম এ তৌফিক তাকে আশস্ত করেন যে, যদি সে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে তবে বিভাগ তার পড়াশোনার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করবে, তাকে অস্বচ্ছলতার জন্য অনার্স পড়া বাদ দিতে হবে না। তৎকালীন হিসাববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আশীষ কুমার স্যান্যালের আন্তরিকতার পর থেকে তার বই-পুস্তকসহ সকল পড়াশোনার ব্যয়ভার হিসাববিজ্ঞান বিভাগ বহন করে।

অনার্সে ভর্তি হবার পর পরিতোষ স্থানীয় একটি ছাত্রাবাসে উঠেন। কিন্তু তার থাকা-খাওয়ার সামর্থ্য ছিল না। পরিতোষের এ অবস্থার কথা জানতে পেরে তাকে কলেজ হোস্টেলে একটা সিটের ব্যবস্থা করে দেন তৎকালীন কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি বুলবুল আহমেদ। আর বর্তমানে হোস্টেল খরচ ও খাবারের অর্ধেক খরচ মওকুফ করেছে হোস্টেল কর্তৃপক্ষ।
বাড়ি থেকে বৃদ্ধা মা অতি কষ্টে সামান্য কিছু টাকা দিতে পারতেন পরিতোষের খরচের জন্য। পরিতোষের মায়ের কষ্ট দেখে তাদের গ্রামের একজন ব্যক্তি ঢাকাতে একটি মেসে তার মাকে কাজ করার প্রস্তাব দেন। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ষাটোর্ধ মা ঢাকায় যান কাজের জন্য। এভাবেই কয়েক বছর কাজ করে প্রতিমাসে পরিতোষের জন্য এক হাজার টাকা করে পাঠাতেন মা। কিছুদিন যেতে মা অসুস্থ। তাই পরিতোষ মাকে ফিরে আসতে বলেন। মা ফিরে আসেন। মায়ের চিকিৎসা আর নিজের খরচ কিভাবে মেটাবে তার জন্য শঙ্কিত পরিতোষ।

অবশেষে এক বড়ভাইয়ের প্রচেষ্টায় চারটি টিউশনি পেয়েছেন পরিতোষ। আর এই টাকা দিয়েই তিনি মেটান তার খাওয়াসহ অনান্য খরচ। কিন্তু অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার খরচ ঠিকমত দিতে পারেন না। চোখে অশ্রুজলে বারবার সিক্ত হয় আর ভাবেন কবে আসবে সুদিন। কবে পাবো চাকরি। মেটবে সংসারের অভাব, অনটন। বাড়ির ৭ শতক জমিটি তার চাচার দান করা সম্পত্তি। এছাড়া এক টুকরো জমি ও নাই। টাকা দিয়ে চাকরি নেয়ার মত সামর্থ্য নাই, বিভিন্ন জায়গায় চাকরির আবেদন করবে কিন্তু অর্থ নাই।

অপরদিকে বাড়িতে অসুস্থ মা। লোনের বোঝা নিয়ে তিন ভাই বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। কিন্তু সে নিরুপায়। চাকরির জন্য অন্যের দ্বারে গিয়ে বারবার তাকে অশ্রু জলে ফিরে আসতে হয়েছে।

পরিতোষ বলেন, আমার মায়ের ঘাম ঝড়া টাকায় লেখাপড়া শিখেছি। আমি কোনোদিন আমার মায়ের ঋণ শোধ করতে পারব না, যিনি আমার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু মায়ের মুখের হাসি ফোটাতে পারলাম না। পরিতোষ শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছে এবং সে প্রমাণ করেছে, শুধু ইচ্ছাশক্তিই একজন মানুষের এগিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট, পরিতোষ তাঁর প্রমাণ।

পরিতোষের ইচ্ছা তার একটি চাকরি। সে চায় তার মতো অন্য শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করতে। সে চায় আরো ১০ জন মানুষের মতো হতে, মানুষের সঙ্গে চলতে, ফিরতে, কাজ করতে। চায় মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে।

জীবন সংগ্রামে এগিয়ে চলা জীবন যুদ্ধের এই অদম্য সৈনিক পরিতোষ একদিন তার কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছে যাবে, পৃথিবীকে জানিয়ে দেবে অদম্য ইচ্ছার কাছ হার মানে সকল প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু পরিতোষ কি পাবে না তাঁর মেধার মূল্যায়ন, সে কি পারবে না সংসারের অভাব অনটন দূর করতে? তাঁর মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে?    

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এইচএআর

Wordbridge School
Link copied!