• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ব্যাংকের প্রশ্নফাঁস

নিয়োগ পরীক্ষার টেন্ডার পাইয়ে দেন নিখিল


নিজস্ব প্রতিবেদক নভেম্বর ২৯, ২০২১, ০১:১১ পিএম
নিয়োগ পরীক্ষার টেন্ডার পাইয়ে দেন নিখিল

ঢাকা : বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে সখ্য ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক নিখিল রঞ্জনের। এই সখ্য কাজে লাগিয়ে অল্প টাকায় আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষার টেন্ডার আহছানউল্লাকে পাইয়ে দেন নিখিল। এ ছাড়া নিয়োগ পরীক্ষার আগের রাতে প্রতিবার প্রেস থেকে দুই সেট প্রশ্ন ব্যাগে করে নিয়ে যেতেন নিখিল। এভাবে তিনি চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস করতেন।

সরকারি পাঁচ ব্যাংকের সমন্বিত নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে উত্তর বিক্রির অভিযোগে আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস সহায়ক দেলোয়ার হোসেন, পারভেজ মিয়া ও প্রেসকর্মী রবিউল আউয়ালকে জিজ্ঞাসাবাদে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ইতোমধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে দেলোয়ার প্রশ্নফাঁসে নিখিলের ভূমিকার ফিরিস্তি দিয়েছেন।

গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, অল্প টাকায় পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্নে আহছানউল্লার টেন্ডার পাওয়ার ক্ষেত্রে হাত ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির। পাশাপাশি প্রশ্নফাঁসেও এ কমিটির কয়েকজন সদস্যের সংশ্লিষ্টতার তথ্য মিলেছে। প্রাথমিক এ তথ্যের যাচাই-বাছাই ও প্রমাণ সংগ্রহে কাজ চলছে।

ঠিক কী প্রক্রিয়ায় আহছানউল্লা টেন্ডার পেয়েছে, ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্য কারা, তাদের প্রোফাইল ডাটা চেয়ে গত শনিবার বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এ চক্রের পলাতক ও গ্রেপ্তার হওয়া সদস্যদের ব্যাংক হিসাবও চাওয়া হয়েছে—গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগ সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

ডিবি জানায়, গত ১৭ নভেম্বর রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকা থেকে দেলোয়ার ও রবিউলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মহাখালী থেকে পারভেজকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন তারা। জবানবন্দিতে গত ছয় বছর ধরে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে তারা জড়িত বলে স্বীকার করেন। গত ৬ নভেম্বর সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস করেন তারা। প্রশ্নের উত্তর তৈরির কাজ কীভাবে হয়েছে তা বর্ণনা করেন তিনজন।

জবানবন্দিতে দেলোয়ারের দাবি, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অল্প টাকায় পরীক্ষার টেন্ডার পাবার ব্যবস্থা করতেন বুয়েটের শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর। দেলোয়ারও কয়েকবার নিখিলের ব্যাগে প্রশ্ন দিয়েছেন।

ডিবি পুলিশ সূত্রে আরও জানা যায়, তিন আসামির জবানবন্দিতে কাজী শরীফুল নামে আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা, দেলোয়ারের ভগ্নিপতি মুবিন উদ্দিনের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

জবানবন্দিতে দেলোয়ার বলেন, গত ৬ নভেম্বরের প্রশ্ন দেলোয়ার সংগ্রহ করেন আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আশুলিয়ার যে প্রেসে ছাপায় সেখানকার কর্মচারী রবিউল আউয়ালের কাছ থেকে। রবিউল এক সেট প্রশ্ন জামার মধ্যে লুকিয়ে প্রেস থেকে বাইরে নিয়ে আসেন। দেলোয়ারকে আহছানউল্লার টেকনিশিয়ান মুক্তারুজ্জামান রয়েল ও ল্যাব সহকারী পারভেজ মিয়া প্রশ্ন ফাঁসে যুক্ত করেন। কমপক্ষে চার-পাঁচটি পরীক্ষার প্রিলিমিনারি ও রিটেনের প্রশ্ন এনে দিয়েছেন তিনি। এক লাখ টাকা পেয়ে তিনি আবার ৫০ হাজার টাকা রবিউলকে দিয়েছেন।

জিজ্ঞাসাবাদে রবিউল জানান, তিনি আহছানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনসের কাটিংম্যান। দেলোয়ার তাকে ফোন করে কামারপাড়া নিয়ে রয়েল ও পারভেজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তখন পাঁচ ব্যাংকের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের প্রস্তাব দেন। রয়েল পারভেজকে তার ছোট ভাই পরিচয় করিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন। পরে চুক্তি মতো ২ নভেম্বর প্রশ্ন ছাপা হলে রবিউল একটি সেট লুকিয়ে রাখেন। ৪ নভেম্বর রয়েল ও পারভেজের হাতে প্রশ্নপত্র তুলে দেন রবিউল।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা ওই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় মোট ১১জনকে গ্রেপ্তার করেছি। এর মধ্যে পাঁচজন ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে দেলোয়ার হোসেনের বক্তব্যে শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরের নাম ও সংশ্লিষ্টতা উঠে আসে। তিনি পরীক্ষার আগে ব্যাগে করে প্রশ্নপত্র নিয়ে যেতেন।

আমরা আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দিয়েছি। নিয়োগ পরীক্ষার দায়িত্বে কারা ছিলেন, সেখানে শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরের সংশ্লিষ্টতা কীভাবে আসল, তার ভূমিকা কী ছিল—  এসব জানতে চেয়েছি। কারণ কোনোভাবে এই নিয়োগ পরীক্ষায় তার সংশ্লিষ্টতার সুযোগ ছিল না।

তিনি আরও বলেন, এখনও অনেক লেয়ার বাকি আছে। নতুন করে আরও ৭/৮ জনের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পেয়েছি। তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে। আমরা সেই চেষ্টা চালাচ্ছি। পাশাপাশি তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করছি।

ডিসি ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের জোর সন্দেহ পাঁচ ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্নে আহছানউল্লার টেন্ডার পাওয়ার ক্ষেত্রে হাত ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির। কারণ আহছানউল্লা কর্তৃক পাঁচ ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষার পরপর চারটিতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এ সংক্রান্ত বেশকিছু তথ্য-উপাত্তও আমরা পেয়েছি। ঠিক কী প্রক্রিয়ায় আহছানউল্লা টেন্ডার পেয়েছে, সেই ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্য কারা, তাদের প্রোফাইল ডাটা চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে গত শনিবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এই চক্রের পলাতক ও গ্রেপ্তার হওয়া সদস্যদের ব্যাংক হিসাবও চাওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ওই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসে যারাই জড়িত থাকুক না কেন তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আইনানুগ প্রক্রিয়ায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাঁচ ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরের সঙ্গে ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির ২/৩ জন সদস্যের যোগসাজশের তথ্য পেয়েছি। আমরা তাদের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। পারসেন্টেজ খেয়ে তারা টেন্ডার পাইয়ে দিয়েছেন। তাদের ব্যাপারে তথ্য চাওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। সহসাই গ্রেপ্তার হবেন বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর। সে প্রক্রিয়াও এগিয়েছে।

আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে খ্লকালীন চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) বিভাগের এই সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান নিখিল। তার দায়িত্ব ছিল শুধু টেকনিক্যাল সাপোর্ট। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় তার নাম আসায় তাকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে।

ডিবি সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় বছরে বুয়েটের এই শিক্ষকের অ্যাকাউন্টে ১০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। একজন শিক্ষকের অ্যাকাউন্টে এত টাকা কোথা থেকে আসল এবং সেই অর্থের উৎসের সন্ধান করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে ডিবির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামিদের জবানবন্দিতে বুয়েট শিক্ষক নিখিলের নাম উঠে এসেছে। এ সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দিয়েছি।

বুয়েটের ভিসি অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার এ প্রসঙ্গে জানান, গোয়েন্দা পুলিশ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিছু তথ্য দিয়েছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

ডিবির চিঠিপ্রাপ্তির বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক ও সহকারী মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ডিবির চিঠি এখনও পাইনি। আগে চিঠি পাই, চিঠিতে ডিবি কী বলছে বা কী জানতে চাইছে; সেটা জেনেই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

যদিও এর আগে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক ও সহকারী মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি সচিবালয়ের (বিএসসিএস) আওতায় গত ৬ নভেম্বর সরকারি পাঁচটি ব্যাংকের ‘অফিসার (ক্যাশ)’ পদে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ব্যাংকের ‘অফিসার (ক্যাশ)’ পদে নিয়োগ পরীক্ষা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ছিল আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ওই পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিএসসিএস ওই পরীক্ষা বাতিল করেছে। এছাড়া, আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয় বিএসসিএস’র আরও দুটি পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্বে থাকায় তা ইতোমধ্যে স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভবিষ্যতে এ ধরনের পরীক্ষা পরিচালনার সুযোগ না দেওয়ার জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

ওই পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং অধিকতর তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনোপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

গত ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকে অফিসার (ক্যাশ) পদে নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় এক হাজার ৫১১ কর্মকর্তা নিয়োগের জালিয়াতির তথ্য পেয়ে পাঁচ ব্যাংকারসহ আটজনকে আগেই গ্রেপ্তার করে ডিবি। এ খবরে পরীক্ষা বাতিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

 

Wordbridge School
Link copied!