• ঢাকা
  • শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

করছাড় চায় পুঁজিবাজার ও ব্যাংক-বিমার অংশীজনেরা


নিজস্ব প্রতিবেদক  ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৪, ০৯:৫২ পিএম
করছাড় চায় পুঁজিবাজার ও ব্যাংক-বিমার অংশীজনেরা

ঢাকা: আসন্ন বাজেটে শুধুই করছাড়ের দাবি তুলেছেন পুঁজিবাজার, ব্যাংক, বিমাসহ আর্থিক খাতের বিভিন্ন অংশীজনের। 

মঙ্গলবার (০৬ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সভাকক্ষে প্রাক বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে বিভিন্নভাবে করছাড়ের প্রস্তাবনা দিয়েছে আর্থিক খাতের শীর্ষ সংস্থাগুলো।

এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেয় স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্যাংক, বিমা, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর সংগঠন ও প্রতিনিধিরা।

আলোচনায় অংশ নিয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেডের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘গ্রামে-গঞ্জে হাজার ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীকে আমরা ঋণ দিয়ে থাকি। তাঁদের ক্ষেত্রে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের কাগজপত্র (প্রুফ অফ রিটার্ন সাবমিশন) দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে অনুৎসাহিত হয়ে তাঁরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের দিকে যাচ্ছে। যেখানে ঋণের সুদের হার একটু বেশি হয়, কিন্তু এ সমস্ত নথির প্রয়োজন হয় না। এসএমই খাতে ৫০ লাখ টাকার সীমা নির্ধারণ দেন। এর বেশি ঋণ হলে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের প্রমাণাদি যেন নেওয়া হয়। এর নিচে হলে যেন এটা ছাড়া দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, আমানতের বিপরীতেও আমাদের এখন এটা নিতে হচ্ছে। যার ফলে অনেক আমানতকারী আর ব্যাংকিং খাতে না এসে অন্যান্য খাতে যাচ্ছেন। তাঁদের টিন না থাকলে উৎসে কর ১৫ শতাংশ করতে হচ্ছে। গ্রাহকের আমানতের ক্ষেত্রে এটা ছাড় দেওয়া যায় কিনা বা সীমাটা কমিয়ে আনা বা আরেকটু সহজ করা যায় কিনা।

ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সেলিম বলেন, ঋণ প্রদান ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী আমরা প্রভিশনিং (সঞ্চিতি) করি। এই প্রভিশনের ওপরে পুরো কর দিয়ে আসতে হচ্ছে আমাদেরকে। এটা আপনারা বিবেচনা করতে পারেন। কেন না, সরকারই যেখানে আমাদেরকে বলছে প্রভিশনিং করতে, সেখানে এটার ওপর আবার কেন ট্যাক্স দিতে হবে?

বন্ডের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ছাড়ের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, জিরো কুপন বন্ডে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করলে করছাড় সুবিধা পায় না। কিন্তু অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করলে করছাড় পায়। 

এবিবি চেয়ারম্যান বলেন, ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতা বা কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) করতে হয়, সেটাও বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের চাওয়াতেই করতে হয়। এমন নয় নিজেরা শখ করে করা। এটার একটা সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এই যে খরচটা আমরা করছি, এটা ব্যাংকের সাধারণ খরচের মধ্যে পড়ে না। খরচ কোনো ক্ষেত্রে বেশি হলেও ১০ শতাংশের বেশি করছাড় দেওয়া হয় না।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. তারিকুজ্জামান বলেন, গত অর্থবছরে আমরা ৩৪২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছি। আমরা পুঁজিবাজারের উন্নয়নে যেসব কাজ করছি, সেগুলো সম্পন্ন হলে এই রাজস্ব এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাব বলে আশা করছি।

তিনি বলেন, ট্রেকহোল্ডার কোম্পানি বা ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে প্রতি ১ লাখ টাকা লেনদেনের বিপরীতে ৫০ টাকা কর দিতে হয়। এটা আগে ১৫ টাকা ছিল। এমনিতেই করোনা ও বৈশ্বিক বিভিন্ন কারণে বাজারের অবস্থা নয়। সে অবস্থায় ব্রোকারদের ৫০ টাকা বেশি হয়ে যায়। ব্রোকারেজ হাউসের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। হাউসগুলো লোকসান করলেও এই টাকা দিতে হয়। অথচ ভারতে ১৩, পাকিস্তানে ২০ ও হংকংয়ে এই খরচ ২ টাকা ৭০ পয়সা। এখানে অনেক লোকজন কাজ করে, কর্মসংস্থান হয়। ছাড় দিলে ব্রোকারেজ হাউসগুলো টিকে থাকতে পারবে।

লভ্যাংশের ওপর করছাড়ের সুপারিশ করে ডিএসইর এমডি বলেন, লভ্যাংশ (ডিভিডেন্ড) আয়ের ওপর কর দিতে হয়। কোনো ক্ষেত্রে সহযোগী বা সাবসিডিয়ারি কোম্পানি থেকে লভ্যাংশ পেলেও কর দিতে হয়। এতে দ্বৈত করারোপ হয়ে যায়। ফলে একবার করারোপের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।

বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে করছাড়ের ব্যবস্থার রাখার প্রস্তাবনা দিয়ে তারিকুজ্জামান বলেন, ১ লাখ টাকা আয় হলে প্রথম ৫০ হাজার টাকা ছাড় দিয়ে বাকি টাকার ওপর করারোপ করা হলে বিনিয়োগকারীরা অনেক আগ্রহী হবেন। এই সুবিধা আগে ছিল, পুনরায় চালু করার সুপারিশ জানাই।

তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে করহারের পার্থক্য বাড়ানোর দাবি জানিয়ে ডিএসইর এমডি বলেন, তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে করহারের পার্থক্য ১০ শতাংশ ছিল। এখন, বাজারে আসেছ কিন্তু তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। প্রণোদনা থাকলে তালিকাভুক্তি বাড়বে, রাজস্ব আদায় হবে। আমরা চাই, এই করহারের পার্থক্য সাড়ে ১২ শতাংশ করা হোক।

বন্ডের বাজার সম্প্রসারণের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বন্ডের বাজার গতিশীল করতে চাই। এ জন্য তালিকাভুক্ত বন্ডের ক্ষেত্রে করছাড় থাকলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে নেই। আমরা এই বন্ডের আয়ের ওপর কর মওকুফ চাই।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান মজুমদার বলেন, বেসরকারি বন্ড বাজার তৈরি করা প্রয়োজন। বর্তমানে পুঁজিবাজারের মার্কেট ক্যাপ ও জিডিপির রেশিও ১১ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে এসেছে। আমাদের প্রতিবেশি দেশ, বিশেষ করে ভারতে সেটা ইতোমধ্যে শতভাগ হয়ে গেছে। এই প্যারামিটারটা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের জন্য প্রতিবন্ধকতা। সে জন্য আশা করি, বাজেট কাঠোমোর মধ্যে কিছু কৌশল অন্তর্ভুক্ত করা যায়, বিশেষ করে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার হ্রাসকরণ, তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারের ব্যবধান বৃদ্ধিকরণ।

তিনি বলেন, পণ্য বৈচিত্র্যকরণের অংশ হিসেবে অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) ও স্মল ক্যাপিটাল বোর্ড (এসএমই) চালু করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিংয়ে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকায় এই দুটো বোর্ডকে কার্যকর করতে পারছি না। এই দুই বোর্ডে তালিকাভুক্ত হলে প্রথম তিন বছর যদি কর মওকুফ করা যায়, তাহলে কোম্পানিগুলোকে একটা কাঠামোয় আনা যাবে এবং মধ্যমেয়াদে একটা এনবিআরের রাজস্ব আয় বাড়বে।

বন্ডের বাজার সম্প্রসারণের বিষয়ে সিএসইর এমডি বলেন, কয়েক বছরের জন্য হলেও সব ধরনের বন্ড এবং বেসরকারিক বা করপোরেট বন্ডের ওপর কর প্রত্যাহার করা হোক। এটা মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘিমেয়াদি ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেট গড়ে তুলতে ও রাজস্ব আদায়ে সহায়ক হবে।

বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে এশিয়া ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ইমাম শাহীন বলেন, পুনঃবীমা প্রিমিয়ামের কমিশনের ওপর মুসক প্রযোজ্য নয়। বিমা কোম্পানি প্রিমিয়াম গ্রহণের সময় গ্রাহকের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ হারে মূসক গ্রহণ করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়। বিমা কোম্পানি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার স্বার্থে এই প্রিমিয়ামের একটি অংশ পুনঃবিমাকারীকে প্রদান করে পুনঃবিমা গ্রহণ করে থাকে। যেহেতু প্রিমিয়াম গ্রহণকালে সম্পূর্ণ প্রিমিয়ামের ওপর আইন অনুযায়ী মূসক গ্রহণ করে সরকারকে দেওয়া হয় এবং এই প্রিমিয়ামেরই একটি অংশ পুনঃবিমাকারীকে প্রদান করা হয়, ফলে পুনঃবিমা প্রিমিয়ামের কমিশনের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের কোনো সুযোগ নেই। এই ধরনের ভ্যাট প্রত্যাহার হলে তা যৌক্তিক হবে। 

এছাড়াও তিনি জীবন বিমা গ্রহণকারীদের মুনাফার ওপর ৫ শতাংশ ও স্বাস্থ্যবিমার ওপর ১৫ শতাংশ কর প্রত্যাহারের দাবি জানান।

এসব দাবির বিপরীতে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, সবাইকে শক্তিশালী করতে হবে, সবাই অস্তিত্ব সংকটে পড়ে আছে, চরম বিপর্যয়ের মুখে আছে। কী কারণে? ট্যাক্স-ভ্যাটের কারণে। সবাইকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে, বিকশিত করতে হবে, কী করে? ট্যাক্স-ভ্যাট ছাড় দিয়ে। ট্যাক্স-ভ্যাট হলো সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য। তাহলে আমি যাব কোনদিকে? কাকে শক্তিশালী করব?

তিনি আরও বলেন, আমরা সামনের দিকে এলডিসি গ্রাজুয়েশন, গ্রাজুয়েশন পরবর্তী আরও উন্নত দেশের দিকে যাচ্ছি। সেখানে কোন বিষয়গুলো আসে, সক্ষমতা। সক্ষমতা আসে সরকার আরও ট্যাক্স-ভ্যাটের ওপরে। সেজন্য আমাদের চিন্তু করতে হচ্ছে। আবার অন্যভাবে যদি বলি, অন্যদের সক্ষমতা প্রকাশ পাবে কীভাবে নির্ভরতা কমালে। এই জিনিসগুলো মাথায় রাখতে হবে। তবে তিনি সবার দাবি পুনর্বিবেচনা করবেন বলে জানান।

এমএস

Wordbridge School
Link copied!