ঢাকা : দেশে স্থানীয়ভাবে পরিচিত চন্দ্রবোড়া নামে। তবে এই নাম ছাপিয়ে রাসেলস ভাইপার নামেই সারাদেশে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সাপটি। প্রাণী গবেষকরা অবশ্য বলছেন, যতটা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, ততটা বিপজ্জনক নয় চন্দ্রবোড়া বা রাসেল ভাইপার সাপটি। আর এর প্রতিষেধক থাকায় সাপে কাটার পর বাঁচার উপায়ও রয়েছে।
রাসেলস ভাইপার সাপটি বাংলাদেশে বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা এক সরীসৃপ প্রজাতি। এটি এক সময় বরেন্দ্রভূমি অর্থাৎ রাজশাহী অঞ্চলে দেখা গেলেও এখন আরও এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় বাড়ছে আতঙ্ক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসেলস ভাইপার দক্ষ সাঁতারু হওয়ায় বন্যার পানিতে ভেসে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়েছে। ফলে ৩০টিরও বেশি জেলায় এই সাপের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে।
এটি বিশ্বের পঞ্চম বিষধর সাপ- এমন কথাও আসছে সোশাল মিডিয়ায়; তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, বিশ্বে বিষধর সাপের ক্রমে প্রথম ৩০টির মধ্যেও নেই রাসেলস ভাইপার। বাংলাদেশেও এর চেয়ে বেশি বিষধর গোখরা সাপ।
চরিত্রগতভাবে অলস সাপ : পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বলছে, মানুষের সঙ্গে রাসেলস ভাইপারের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম। এরা মূলত নিচু ভূমির ঘাসবন, ঝোঁপ-ঝাড় ও বনে থাকে। লোকালয় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে এই সাপ।
প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ সাপ যতটা ভয় পায়, সাপ তার চেয়ে বেশি ভয় পায় মানুষকে। প্রায় সব সাপই মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই সরে পড়ে। তবে রাসেলস ভাইপার সহজে তার জায়গা ছাড়ে না। কারণ এর আলস্য।
বেশিরভাগ সময় শরীর নাড়িয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হবে বলে সাপটি কচুরিপানার সাহায্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। কচুরিপানায় শুয়েই কাটিয়ে দেয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান বলেন, এরা সহজে জায়গা ছাড়ে না। একই জায়গায় থেকে যায়। এদেরকে কেউ বিরক্ত না করলে ওরা সহজে মানুষের সামনে আসতেও চায় না।র রাসেলস ভাইপার এতটাই অলস যে মানুষ দেখে তেড়ে আসা অথবা পালানো, কোনোটিই তার স্বভাবে নেই। এই সাপের বিষের প্রতিষেধক বা অ্যান্টি ভেনম থাকায় এটি অন্য আরও সাপের তুলনায় কম বিপজ্জনক বলে মনে করেন ড. ফিরোজ জামান।
গোখরা সাপ কামড়ের পর চিকিৎসা না নিলে গড়ে ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের ক্ষেত্রে গড়ে ১৮ ঘণ্টা পর মৃত্যু হতে পারে। রাসেলস ভাইপারে ক্ষেত্রে মৃত্যু হতে পারে কামড়ের পর গড়ে ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পরে।
ফিরোজ জামান আরও বলেন, রোগীর অন্য কোনও অসুস্থতা না থাকলে ৭২ ঘণ্টার আগে রোগী সহজে মারা যায় না। এমনকি দেশে রাসেলস ভাইপারের কামড়ের পর ১৫ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার রেকর্ডও আছে।
তবে রাসেলস ভাইপার নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় যে আলোচনা আর সমালোচনা হচ্ছে তার বেশিরভাগই ভুল তথ্যে ভরা বলেও জানান তিনি।
রাসেল ভাইপারের কামড় এড়াতে করণীয় : যেসব এলাকায় রাসেলস ভাইপার দেখা গেছে, সেখানে চলাচলের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। তাতে বলা হয়েছে-
# লম্বা ঘাস, ঝোঁপ-ঝাড়, কৃষি এলাকায় হাঁটার সময় সতর্ক থাকতে হবে।
# গর্তের মধ্যে হাত-পা ঢোকানো যাবে না।
# ঝোপ-ঝাড়ে কাজ করার সময় বুট ও লম্বা প্যান্ট পরতে হবে।
# রাতে চলাচলের সময় অবশ্যই টর্চ লাইট সঙ্গে রাখতে হবে।
# বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার ও আবর্জনামুক্ত রাখতে হবে।
# পতিত গাছ, জ্বালানি লাকড়ি, খড় সরানোর সময় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
# সাপ দেখলে তা ধরা বা মারার চেষ্টা না করে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করতে হবে।
রাসেল ভাইপর কামড় দিলে কী করণীয় : দংশিত অঙ্গ নাড়াচড়া করা যাবে না। পায়ে দংশন হলে বসে যেতে হবে, হাঁটা যাবে না। হাতে দংশন হলে হাত নাড়াচাড়া করা যাবে না। কারণ হাত পায়ের গিড়া নাড়াচাড়ায় মাংসপেশীর সংকোচনের ফলে বিষ রক্তের মাধ্যমে দ্রুত শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
আক্রান্ত স্থান সাবান দিয়ে আলতোভাবে ধুতে হবে অথবা ভেজা কাপড় দিয়ে মুছতে হবে। ঘড়ি বা অলঙ্কার বা তাবিজ, তাগা ইত্যাদি থাকলে খুলে ফেলতে হবে।
দংশিত স্থানে কাটা যাবে না, সুই ফোটানো যাবে না, কোন রকম প্রলেপ লাগানো যাবে না।
সাপে কাটলে ওঝার কাছে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট না করে যত দ্রুত সম্ভব নিকটবর্তী হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যেতে হবে।
রাসেলস ভাইপারের বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে পাওয়া যায় বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ফরহাদ উদ্দিন হাছান চৌধুরী বলেন, এই সাপের বিষ শরীরে ঢুকলে মূলত রক্ত পাতলা হয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে, কিডনি বিকল হতে পারে এবং স্নায়ু অবশ হয়ে ফুসফুসের কার্যকারিতা হারিয়ে যেতে পারে এবং হতে পারে হার্ট অ্যাটাকও।
সাপে কাটা রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সাপে কাটার পরপরই দ্রুততম সময়ে হাসপাতালে আনা হলে অতি দ্রুত অ্যান্টি ভেনম শুরু করে সাপোর্টিভ অন্যান্য চিকিৎসা যেমন ডায়ালাইসিস, ভেন্টিলেশন দিতে পারলে রোগী বাঁচানো সম্ভব বলে মনে করি।
সাপে কাটা রোগীর দংশিত স্থানে গিঁট দেওয়ার রেওয়াজ থাকলেও রাসেলস ভাইপারে ক্ষেত্রে তা না দেওয়ার পরামর্শ দেন এই চিকিৎসক। এ বিষয়ে ডা. ফরহাদ উদ্দিন বলেন, কারণ বাঁধের কারণে মাংসপেশির ভেতরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে অঙ্গহানি হতে পারে।
ওজার কাছে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সাপের কামড়ে যারা আক্রান্ত হয় এবং যাদের মৃত্যু হয়, তাদের বেশিরভাগই প্রান্তিক মানুষ। সচেতনতার অভাবে হাসপাতালে না গিয়ে ওঝার কাছে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষের অপমৃত্যু হয়।
এদিকে ফরিদপুরে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে একজনের মৃত্যু হয়ে। অ্যান্টি ভেনম নেওয়ার পরও তার মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো.ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, সাপে কাটার পর তাকে ওঝার কাছে নেওয়া হয়। সেখানে অনেক সময় নষ্ট হওয়ার পর তারা হাসপাতালে আসে, সেখানে ভ্যাকসিন নিতে অস্বীকৃতি জানায়। হাসপাতাল ছেড়ে ফের ওঝার কাছে যায় তারা। সেখানে থেকে তাকে আবার হাসপাতালে আনার পরও রোগীর স্বজনরা ভ্যাকসিন দিতে রাজি হয়নি। অনেক সময় পার হওয়ার পর তাকে অ্যান্টি ভেনম দেওয়া হয়েছিল।
এমটিআই