• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাগরিক কবি শামসুর রাহমান


সাহিত্য ডেস্ক অক্টোবর ২৩, ২০২১, ০১:১১ পিএম
বাংলা সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাগরিক কবি শামসুর রাহমান

ছবি : অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাগরিক কবি শামসুর রাহমান

ঢাকা : ‘জীর্ণ দেয়ালের কানে বলি; দেয়াল আমাকে তুমি একটি কবিতা দিতে পারো? পুরোনো দেয়াল বলে শ্যাওলা-ঢাকা স্বরে, এই ইঁট সুরকির ভেতর যদি নিজেকে গুঁড়িয়ে দাও, তবে হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা!’

নগরকেন্দ্রিক যান্ত্রিক সভ্যতাকে যিনি কবিতায় আশ্রয় দিয়েছেন তিনি কবি শামসুর রাহমান। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জন্মলগ্ন যদি ধরা হয় তিরিশ দশককে। তবে শহুরে যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাত, ক্লান্তি, নৈরাশ্য, আত্মবিরোধ, অনিকেত মনোভাব ইত্যাদি তিলক পরিধান করে তিরিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার শোভাযাত্রা শুরু হয় পঞ্চ কবির হাত ধরে। নগরকেন্দ্রিক সভ্যতাকে ধারণ করে বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে ও অমিয় চক্রবর্তী কবিতা লিখলেও নাগরিক কবি হিসেবে বিশেষভাবে চিহ্নিত হননি কেউই। শামসুর রাহমান আধুনিক কবিদের উত্তরসূরী। আক্ষরিক অর্থে বাংলা সাহিত্যের নাগরিক-কবি বলা হয় তাকেই।

এই যে আসুন, তারপর কী খবর? আছেন তো ভাল? ছেলেমেয়ে?’ কিছু আলাপের পর দেখিয়ে সফেদ দেয়ালের শান্ত ফটোগ্রাফটিকে বললাম জিজ্ঞাসু অতিথিকে– ‘এই যে আমার ছোট ছেলে, যে নেই এখন, পাথরের টুকরোর মতন ডুবে গেছে আমাদের গ্রামের পুকুরে বছর-তিনেক আগে কাক-ডাকা গ্রীষ্মের দুপুরে।’

যদিও অনেকে জানি মধ্যযুগের শেষ কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাগরিক-কবি বলা হয়। তবে ভারতচন্দ্ররের জীবন ও কর্মকীর্তি ছিল নগর ও পল্লীজীবনের প্রেক্ষাপট ঘিরে। কিন্তু যে-অর্থে শামসুর রাহমান নাগরিক-কবি বলা হয়, সে-অর্থে ভারতচন্দ্র নন। কারণ, বিবর্ণ প্রতিবেশ পৃথিবীর চৌচির মুখচ্ছবি যতটা শামসুর রাহমান অঙ্কিত করেছে ততটা ভারতচন্দ্র করতে পারেননি।

শামসুর রাহমান ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম। ১৩ ভাই-বোনের ভিতরে তিনি ছিলেন ৪র্থ। বাংলা গীতিকবিতা ১৯৪৭ পরবর্তী দুইটি ধারায় প্রবাহিত হয়। প্রথম ধারাটি প্রধান কবি ছিলেন আল মাহমুদ এবং দ্বিতীয় ধারার প্রধান কবি শামসুর রহমান। তিরিশোত্তর বোধকে লালন করে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার যান্ত্রিক জীবনকে লালন করে শামসুর রাহমান সেখান থেকে তুলে এনেছেন কবিতা।

আধুনিক কবিতার সাথে পরিচয় ও আন্তর্জাতিক-আধুনিক চেতনার উন্মেষ ঘটে ১৯৪৯-এ, এবং তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ১৯৪৯ মুদ্রিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। শামসুর রাহমান বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে নানা ছন্দনাম নিয়েছেন তিনি যেগুলো হচ্ছে: সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক। পাকিস্তান সরকারের আমলে কলকাতার একটি সাহিত্য পত্রিকায় মজলুম আদিব (বিপন্ন লেখক) নামে কবিতা ছাপা হয় যা দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট সমালোচক আবু সায়ীদ আইয়ুব।

শামসুর রাহমান স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল (পত্রিকা) পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক কবিতা। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ্য করে লেখেন অসাধারণ কবিতা ‘টেলেমেকাস’ (১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সালে)। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান-এ কর্মরত থাকা অবস্থায় পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন যাতে আরো স্বাক্ষর করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, আহমেদ হুমায়ুন, ফজল শাহাবুদ্দীন।

১৯৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইয়ুব খান যার প্রতিবাদে আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন যাদের একজন ছিলেন শামসুর রাহমানও। কবি ক্ষুদ্ধ হয়ে লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’।

১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন 'আসাদের শার্ট' কবিতাটি। ১৯৭০ সালের ২৮ নভেম্বর ঘূর্ণিদুর্গত দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ও মৃত্যুতে কাতর কবি লেখেন 'আসুন আমরা আজ ও একজন জেলে' নামক কবিতা।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। শামসুর রাহমান ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের তিনি প্রথম বছরে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’, দ্বিতীয় বছরে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’, তৃতীয় বছরে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ এবং চতুর্থ বছরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ লেখেন । ১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর লেখেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তার চেতনায় প্রবাহিত ছিল।

শামসুর রাহমানের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের ‘মধ্যে রৌদ্র করোটিতে’, ‘বিধ্বস্ত নিলীমা’, ‘নিরালোকে দিব্যরথ’, ‘নিজ বাসভূমে’, ‘বন্দী শিবির থেকে’, ‘দুঃসময়ে মুখোমুখি’, ‘আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি’, ‘এক ধরনের অহংকার’, ‘আমি অনাহারী’, ‘শূন্যতায় তুমি শোকসভা’, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে’, ‘প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে’, ‘ইকারুসের আকাশ’, ‘মাতাল ঋত্বিক’, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে’, ‘কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি’, উল্লেখযোগ্য।

বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য শামসুর রাহমান ভূষিত হয়েছেন- বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, জীবনানন্দ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে।

তিনি ২০০৬ সালের আজ (১৭ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টা বেজে ৩৫ মিনিটে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী ঢাকাস্থ বনানী কবরস্থানে, তার মায়ের কবরের পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

সোনালীনিউজ/এসএন

Wordbridge School
Link copied!