• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু : বাঙালির আত্মসম্মান ও সংস্কৃতি  


হায়াৎ মামুদ জানুয়ারি ২২, ২০২১, ০৫:১৫ পিএম
বঙ্গবন্ধু : বাঙালির আত্মসম্মান ও সংস্কৃতি  

ঢাকা : এদেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান ও পতন আমাদের জটিল রাজনীতি-জগতেরই শুধু নয়, আমাদের জাতীয় চরিত্রেরও দিকনির্দেশক। ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জয় বাংলা’ আজ ব্রাত্য ধ্বনি। রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ অলঙ্কারটি স্বহস্তে তৈরি করেন নি। দেশবাসী তাদের চিদাকাশ ও স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা দিয়ে ঐ অলঙ্কারটি গড়িয়ে তাদের ঐ মধ্যবিত্ত গ্রামীণ সন্তানের কণ্ঠে তা পরিয়েছিল। ‘জয় বাংলা’ শব্দেরও উদ্ভাবক সচেতন নাগরিক ও দেশের অগ্রগামী ছাত্রসমাজ। তাদের কণ্ঠ থেকে শুধু তা বঙ্গবন্ধু নিজের কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন। সবাই নয়, শুধু একজন দেশ নেতাই যে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়েছিলেন এবং ‘জয় বাংলা’ যে বাঙালির জাতিসত্তার প্রতীকধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল তার কারণ তাই শেখ মুজিব নন, তার কারণ তার দরিদ্র নিরক্ষর দেশবাসী। ব্যক্তির কৃতিত্ব ও সাফল্য এখানে যে, জনগণের ভালোবাসাকে চিনতে সে ভুল করে নি, তাদের প্রত্যাশাকে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়ার জন্য সে নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করেছিল। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দেশবাসী উভয়েই উভয়ের নিকট কৃতজ্ঞ এই অর্থে যে, একক ব্যক্তির ‘বঙ্গবন্ধু’তে রূপান্তর ঘটানোর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় চালিকাশক্তি ছিল জনগণ এবং তাদের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে পরাধীন দেশকে স্বাধীন করেছিলেন ওই ব্যক্তি।

দেশনেতাও যেহেতু অন্যদের ন্যায় সমাজ ও পরিবেশ-নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি এবং অন্যান্য ব্যক্তির মতোই মরদেহী মানুষ, তাই অনুভূতি, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা বা বিচার-বিবেচনার অস্বচ্ছতা, সীমাবদ্ধতা, দোদুল্যমানতা, ত্রুটি ইত্যাদির উপস্থিতি অসম্ভব বা অস্বাভাবিক নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধচিত্তে বলবার কথা নিশ্চয়ই অনেক, কারণ জনগণের প্রত্যাশা যেখানে বাধাবন্ধনহীন, আশাভঙ্গের বেদনা ও তালিকা তো সেখানে গভীর ও দীর্ঘ হতেই পারে। এসব সত্ত্বেও একটি ঐতিহাসিক সত্য স্বীকার করার সততা আমাদের থাকা নিতান্তই প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু বিহনে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের জন্ম অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব ছিল। যুক্তিসিদ্ধ আনুপূর্বক বিশ্লেষণে তাঁর রাজনৈতিক তথা প্রশাসনিক প্রজ্ঞা বা দূরদৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন অনেকেই করে থাকেন এবং হয়তো তা বহু ক্ষেত্রে সঙ্গতও। কিন্তু তবুও তাঁর সাহস ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে দ্বিধাহীন হতে আমরা বাধ্য অন্ততপক্ষে এই একটি কারণে যে, ১৯৭১-এ পাকিস্তানি কারাগারে বন্দিদশাতে মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে অজ্ঞ থেকেও এবং চরম ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক হতাশার মধ্যেও তিনি এমন একটি কথাও দীর্ঘ ন মাসে উচ্চারণ করেন নি যা পাকিস্তানি শাসকচক্র তাদের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারে। এই নৈতিক সাহস ও বীরত্ব সাম্প্রতিক বাঙালি চরিত্রের পক্ষে প্রায় অকল্পনীয়। ভুললে চলবে না যে, সাহস, সততা ও মহৎ অন্তঃকরণ মানুষের চর্চাসাপেক্ষ বা বুদ্ধিবৃত্তিগত অর্জন নয়, তা একজন মানুষের মৌলিক চরিত্র-কাঠামোর অভ্যন্তরীণ অণুকণা। তাঁর চরিত্রে যত ছিদ্রান্বেষণই করি না কেন, শুধু এই ত্রিগুণের সমন্বয়েই তিনি অনন্য ও ভবিষ্যৎ বাঙালির প্রাতঃস্মরণীয় বলে জ্ঞান করি। আমাদের দূরদৃষ্টি যে, জাতি হিসেবে বাঙালির বিশ্বাসঘাতকতা ও আত্মবিস্মৃতির চিরন্তন ঐতিহ্য ও অভিশাপ তাঁকে এখনো অবরুদ্ধ করে রেখেছে। বঙ্গবন্ধুহত্যা এরই সাম্প্রতিকতম জ্বলন্ত প্রমাণ এবং তার কারণ তাঁর কোনো চারিত্রিক বিচ্যুতি নয়, বরং বিপরীত-তাঁর বিরাটত্ব, মহত্ত্ব ও ক্ষমাপ্রবণতাই তাঁর ধ্বংসের মূলে।

এদেশের বাঙালি যত দিন জীবিত থাকবে এই কলঙ্ক ও লজ্জা কখনো মুছে যাবে না যে, আমরা পিতৃহত্যার দায়ে পাতকী ও অভিশপ্ত।

২. বঙ্গবন্ধু ও তাঁর বিশ্বস্ত চার অনুসারীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। বিগত এগারো বৎসরে এদেশে শাসনক্ষমতা ও শাসনকাঠামোর রদবদল এত হয়েছে যে, বাংলা ও বাঙালির মুখচ্ছবি প্রায় আমূল পরিবর্তিত হয়েছে। শেখ মুজিবের সব সুকৃতি আজ জাতি বিস্মৃত হয়েছে, তাঁর ভ্রান্তি ও ত্রুটি দানবীয় বিশালতায় রাষ্ট্রযন্ত্রকর্তৃক সবসময় প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু এত কালিমালেপন সত্ত্বেও তাঁর প্রবলতম শত্রুর পক্ষেও এ কথা বলা সম্ভব হয় নি যে, তিনি চরিত্রহীন, লোভী বা জাতিদ্রোহী ছিলেন। বলা সম্ভবও নয়, কারণ তাঁর বিচ্যুতি যত গভীর বা বিভিন্নমুখীই হোক না কেন, তাঁর ভেতরে এসবের বিন্দুতম অস্তিত্ব ছিল না। তাঁর রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘদিনের এবং তিনি ক্রমশ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে বুঝতে পেরেছিলেন যে, একটি চরম ও পরম সত্যের হাত ধরে তাঁকে এগোতে হবে;  তিনি বাঙালি। তিনি নিজে ধর্মাশ্রয়ী মানুষ ছিলেন এবং সমাজসাম্যে বিশ্বাসী হলেও পদ্ধতি হিসেবে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব কখনো কাম্য মনে করেন নি।

তবুও নীতিচতুষ্টয়ের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে তিনি স্থান দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতালব্ধ সমাজসত্যকে স্বীকারের জন্যই। বাঙালি জাতি একধর্মী নয়, আনুপাতিক পরিসংখ্যানের বৈষম্য যেমনই থাকুক যে-জাতির ভেতরে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আছে তাকে ধর্মের ভিত্তিতে শনাক্তিকরণ নীতিবিগর্হিত বলেই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে আদর্শ হিসেবে তিনি বরণীয় মনে করেছিলেন এবং এই বহুধর্মী বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক দারিদ্র্য দূরীকরণের অভীপ্সাই তাঁকে বাধ্য করেছিল সমাজতন্ত্রের পথে যেতে। সব দিক দিয়েই তাঁর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাঙালিত্বের বোধ ও গর্ব। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ সে জন্যই তাঁর যাত্রাবিন্দু এবং তিনি জেনে না গেলেও এই অন্তর্বর্তী এগারো বৎসরের তিক্ত অভিজ্ঞতায় আমরা জেনেছি যে তাঁর অকাল মৃত্যুর জন্যও দায়ী তাঁর বাঙালি জাতিত্ববোধ।

জীবদ্দশায় কি বিরোধী দলীয় রাজনীতির কেন্দ্রশক্তি হিসেবে, কি স্বাধীন বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক হিসেবে-কোথাও কখনো তিনি জাতির সংস্কৃতি সম্পর্কে কোনো কথা বলেন নি। তার কারণ এই নয় যে, তিনি কেতাবী পণ্ডিত বা গবেষক ছিলেন না, কারণ এই নয় যে তাঁর শিক্ষা ও মেধাশক্তিতে এত ভারী, গভীর, বিশাল ব্যাপার নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা সাধ্যাতীত হয়েছিল। কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে আমার ধারণা। বাঙালির সংস্কৃতিকে তিনি আদৌ কোনো সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে অস্বীকার করেছিলেন। তাঁর তীব্র সাধারণ বুদ্ধি তাঁকে শিখিয়েছিল যে, জাতি যদি ‘বাঙালি’ হয় তা হলে তার সংস্কৃতিও ‘বাঙালি’ হবে এবং তা প্রমূর্ত হবে তার আচরিত জীবনযাত্রায়।

বাঙালির সংস্কৃতিচিন্তা বিষয়ে তাঁর নিঃসংশয় ধারণার দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রমাণ তাঁর প্রাত্যহিক জীবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং রবীন্দ্রপ্রেম। আরকেটি বড়ো প্রমাণ তাঁর শিক্ষানীতি-শিক্ষা ও জ্ঞানানুশীলন মাতৃভাষা বাংলাকে স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত করা। তাঁর দেশপ্রেম ও সংস্কৃতিচিন্তার সবচেয়ে বড়ো পরিচয় বিধৃত আছে তাঁর বচনে ও কর্মে। দেশরিনাশ্রয়ী বিদেশি ভাবনাচিন্তা ও বস্তুজাগতিক প্রভাবকে তিনি কখনেই প্রশ্রয় দেন নি। বিদেশের অনুকরণ ও অনুসরণকে তিনি ঘৃণ্য ও বর্জনীয় বলে ভাববার আত্মমর্যাদা দেশবাসীর মনে সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন। জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণদান তার একটি প্রতীকী ব্যবহার মাত্র। ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’-তিনি কোথাও উচ্চারণ করেন নি, অথচ নিজস্ব জীবনচর্চায় তাকেই প্রস্ফুটিত করে তুলেছিলেন। ১৯৭৫ পর্যন্ত এদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির পোশাক-খদ্দরের পায়জামা-পাঞ্জাবি-চাকর স্মরণ করলেই তাঁর উদ্দীপ্ত প্রভাব আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

সংস্কৃতি সম্বন্ধে প্রায় কিছুই না বলে যিনি নিজে হাত ধরে আমাদেরকে সংস্কৃতি চিনিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাকেই এই দেশ ও জাতি একদিন ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে ডেকেছিল। এখনো ডাকে এবং ভবিষ্যতেও ডাকবে। বাঙালির আত্মসম্মান ফিরে পেতে হলে ‘জয় বাংলা’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!