ঢাকা : এ লেখাটি যেদিন বেরোবে তার দুদিন পরেই, অর্থাৎ তৃতীয় দিনেই সারা দেশে উদ্যাপিত হবে পবিত্র ঈদুল আজহা। এটি মুসলমানদের অন্যতম আনন্দের দিন। আমাদের আটপৌরে জীবনে আনন্দের ঘটনা খুব একটা ঘটে না। ঈদ, পূজা-পার্বণ কিংবা বাংলা নববর্ষ সর্বজনীন আনন্দের পসরা সাজিয়ে আমাদের দ্বারে এসে উপস্থিত হয়। আমরা যে যার সাধ্যমতো সে আনন্দকে উপভোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু দুবছর হতে চলল আমাদের জীবন থেকে সে হাসি-আনন্দ যেন বিদায় নিয়েছে। মন খুলে আমরা হাসতে পারছি না, আনন্দকে ভাগাভাগি করতে পারছি না। এমন এক মহামারী গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করেছে, সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। প্রতি মূহূর্তে উৎকণ্ঠিত থাকতে হয় কখন কোন প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর এসে হূদয়কে ভেঙে খান খান করে দেয়। কত আপনজন চলে গেলেন এই পৌনে দুই বছরে! কারো জানাজা নামাজেও শরিক হতে পারিনি। এখন বেঁচে থাকাকেই খুব আশ্চর্যজনক মনে হয়।
এই সেদিন চলে গেল আমার ছেলেবেলার খেলার সাথি, স্কুলজীবনের ঘনিষ্ঠ সহপাঠী মহসীন উদ্দিন খান মজনু। একই গ্রামের ছেলে আমরা। খালের এপার-ওপার বাড়ি। স্কুলে যেতে-আসতে, খেলার মাঠে কত স্মৃতি ওর সাথে আমার! সেই অকৃত্রিম বন্ধুটি হঠাৎ করেই চলে গেল না-ফেরার জগতে। ক’দিন আগে খবর পেলাম মহসীন অসুস্থ, করোনায় আক্রান্ত। অবস্থার অবনতি ঘটায় নেওয়া হয় হাসপাতালে। খবর নিচ্ছিলাম কেমন আছে বন্ধু আমার। হঠাৎ গত ১২ জুলাই দুপুরে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো খবরটি এলো আমার কাছে—বন্ধু মহসীন আর নেই। স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। মাস দেড়েক আগেও ওর সাথে কথা হয়েছে আমার। আমাদের গ্রামের মসজিদ কমিটি হবে, আমাকে যেতে বলেছিল। শারীরিক অসুস্থতার জন্য যেতে পারিনি। স্বভাবসুলভ কণ্ঠে ও বলেছিল, তোকে কি আমরা হারিয়ে ফেললাম? বলেছিলাম—দোস্ত, যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, কখন কে হারিয়ে যাই কে জানে। বলেছিলাম, সবকিছু ঠিক থাকলে ইনশাআল্লাহ ঈদুল আজহায় দেখা হবে। কিন্তু সবকিছু ঠিক রইল না। ঈদ আসার আগেই আমার প্রাণোচ্ছল বন্ধুটি আমাদের কাঁদিয়ে চলে গেল!
না, আমার এ বন্ধুটি বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি ছিল না। এসএসসি পাস করার পর পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে পড়াশোনা আর করতে পারেনি। অথচ মেধাবী ছিল। হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতো। সংসারের হাল ধরতে সে বয়সেই পিতার দলিল লেখার পেশাকে গ্রহণ করেছিল। ভালো পসার জমিয়েছিল পেশায়। নাম পড়ে গিয়েছিল মহসীন মোক্তার। আমাদের শ্রীনগর উপজেলায় এক নামে চিনত সবাই ওকে। সততা, ভদ্রতা, মার্জিত এবং অমায়িক ব্যবহারের জন্য ও ছিল সবার প্রিয়পাত্র। ওর সততার একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করতে চাই। ১৯৮৩ কি ৮৪ সালের কথা। এক লোক দলিল লেখাতে এসে পাঁচ হাজার টাকা ফেলে যায় ওর সেরেস্তায়। যত্ন করে রেখে দেয় মহসীন টাকাটা। খোঁজ করতে থাকে টাকার মালিকের। একদিন পরে সেই ভদ্রলোক আসেন টাকার খোঁজে। মালিকানা নিশ্চিত হয়ে টাকাটা তার হাতে তুলে দেয় মহসীন। ঘটনাটি আমারও কানে আসে। আমি তখন বর্তমানে লুপ্ত দৈনিক দেশ-এর শ্রীনগর প্রতিনিধি। শ্রীনগরে গিয়ে ওর এক কপি ছবি এনে খবরটি লিখে সেগুনবাগিচায় দৈনিক দেশ অফিসে গেলাম। মফস্বল সম্পাদক আবু সাঈদ জুবেরী ভাই অত্যন্ত যত্নসহকারে ‘সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত’ শিরোনাম দিয়ে খবরটি ছেপেছিলেন। ঘটনাটি উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, ওই সময়ে পড়ে পাওয়া পাঁচ হাজার টাকার লোভ সামলানো চাট্টিখানি কথা নয়। সততার এ গুণটি আমৃত্য ধরে রেখেছিল মহসীন। শ্রম আর নিষ্ঠার দ্বারা সৎ উপার্জন করেও যে সচ্ছলতা আনা যায়, তার উদাহরণ আমার বন্ধু মহসীন। অত্যন্ত ধার্মিক ছিল সে। সমাজের প্রতি যে আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে এটা সে স্মরণ রেখে কাজ করেছে সবসময়। মাশুরগাঁও মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছে একাধিকবার। সর্বশেষ এবারো গ্রামের সবাই জোর করে ওকে কমিটির সভাপতি বানিয়েছিল। সেদিন ওকে কথা দিয়েছিলাম ঈদে এসে দেখা করব। সব সময় তাই করতাম। কর্মজীবনের ব্যস্ততার কারণে এখন আর সেভাবে গ্রামে যাওয়া হয় না। রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়ার পর তা আরো কমিয়ে দিয়েছি। ফলে ঈদে-পার্বণে গেলে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠতাম। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে এক ধরনের প্রশান্তি লাভের চেষ্টা করতাম। কিন্তু করোনা সে সুযোগ থেকেও আমাদেরকে বঞ্চিত করে চলেছে। বন্ধু মহসীনের মৃত্যু আমার গ্রামে যাওয়ার আগ্রহকে আরো কমিয়ে দিল। আল্লাহ আমার এ বন্ধুটিকে জান্নাতবাসী করুন—এ প্রার্থনা করি।
আচ্ছা এই যে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে, মানুষ সব ফেলে চলে যাচ্ছে পরপারে, এসব দেখেও কি আমাদের হুঁশ হচ্ছে? আমরা কি আমাদের লোভ সংবরণ করতে পারছি? যে যেভাবেই যত অর্থ-বিত্ত অর্জন করি না কেন, একদিন এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে একদম খালি হাতে। দুনিয়ার যত রাজা-বাদশাহ, ফকির-দরবেশ, বীর-পাহলোয়ান, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি সবাইকে চলে যেতে হয়েছে, চলে যাবেনও। পরিশ্রম করে কিংবা নানারকম ফন্দি-ফিকির করে অর্জিত সম্পদ এ দুনিয়াতেই রেখে যেতে হয়। এক কানাকড়িও কেউ সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন না। অর্ধেক দুনিয়র বাদশাহ শাহ সেকান্দর (মতান্তরে বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার) মৃত্যুর আগে তার পারিষদবর্গকে অসিয়ত করে গিয়েছিলেন, ‘আমার শবযাত্রার সময় আমার হাত দুটি কাফনের বাইরে রেখো।’ এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘সবাই দেখবে, অর্ধেক দুনিয়ার বাদশাহ শাহ সেকান্দর যার অর্থ-সম্পদের কোনো অভাব নাই, সে খালি হাতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছে।’ এ কাহিনী আমরা প্রায় সবাই জানি। কিন্তু এ থেকে আমরা কি কোনো শিক্ষা নিয়েছি?
দুনিয়া চিরস্থায়ী আবাস নয় জেনেও আমরা এখানে বাগান সাজাতে ব্যস্ত। আর তা করতে গিয়ে কেউ কেউ ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত ভুলে যান। যে-কোনো উপায়ে অর্থবিত্তের মালিক হওয়া এক শ্রেণির মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। কেউ রাষ্ট্রকে কর ফাঁকি দিচ্ছে, কেউ শ্রমিক-কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনা দিচ্ছে না, কেউ আবার দরিদ্র মানুষের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ পকেটে ভরছে। কেউ খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে, কেউ নকল পণ্য তৈরি করে মানুষকে ঠকাচ্ছে। আবার কেউ কেউ করছে মানুষ পাচার। আর একদল অর্থলোভী শকুন মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে দেশের যুবসমাজকে ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের মুখে। যারা এসব করছে তাদের বিবেক যেন মরে গেছে। আইন-কানুন, নীতিকথা, সদুপদেশ কোনো কিছুই এদেরকে অসৎ পথ থেকে বিরত রাখতে পারছে না।
ঈদের কথায় ফিরে যাই। আমরা যখন বালক বয়সি, অর্থাৎ গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ঈদ ছিল অন্যরকম। আজকের মতো এত জৌলুস তখন ছিল না। আজ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কোরবানির ঈদ এলেই এক শ্রেণির টাকাওয়ালার মধ্যে কে কয়টা কত বড় গরু জবাই করত পারে, তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এদের কোরবানী অনেকটাই লোক দেখানো। খোদাকে সন্তুষ্ট করার চাইতে সমাজে নিজের বড়ত্বকে জাহির করার প্রবণতাটা বেশি। যে লোকটি লাখ টাকা দামের কোরবানি দিচ্ছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে সে তার অধীন কর্মচারীদের ন্যায্য পাওনাটুকু দেয়নি। বছর দশেক আগের কথা। আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক, যার রাজধানীতে বেশ বড়সড় ব্যবসা ছিল, তিনি কোরবানির ঈদে তার কর্মচারীদের বোনাস দিলেন না। কিন্তু প্রায় এক লাখ টাকা দিয়ে গরু কোরবানি দিলেন। সেদিন তার কর্মচারীরা নীরবে চোখের জল ফেলেছিল। তারা কোনো অভিশাপ দিয়েছিল কি না জানিনা। তবে তার বছর দুয়েকের মাথায় ওই ব্যক্তি ব্যাংক ঋণের দায়ে মামলার আসামি হয়ে বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তার সব সম্পদ ব্যাংক বাজেয়াপ্ত করেছে। এ রকম ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। কিন্তু আমরা শিক্ষা নিই না। শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করা যে কতটা জরুরি তা নবী করিম (সা.)-এর একটি হাদিস থেকেই অনুমান করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা শ্রমিকের মজুরি পরিশোধ করো তার শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই’ (মিশকাত)। শুধু তাই নয়, শ্রমিকের মজুরি পরিশোধে গড়িমসি করাকে তিনি অবিচার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অপর একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, আল্লাহ্ বলেন, হাশরের দিন আমি ওই তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে থাকব, যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে, মানুষকে বিক্রি করে এবং ওই ব্যক্তি, যে কাউকে কাজে নিয়োগ করল, অতঃপর সে তার কাজ পুরোটা করল; কিন্তু সে তার ন্যায্য মজুরি দিল না (বোখারি)। নবীজির এসব হাদিস থেকে শ্রমিকের শ্রম এবং তার মজুরির গুরুত্ব অনুধাবন কোনো কঠিন বিষয় নয়।
কয়েকদিন আগে আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধু ফেসবুকে লিখলেন, লকডাউনে তারা দোকান খুলতে পারছেন না। এখন কর্মচারীদের বেতন-বোনাস বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে হবে। আমি তাকে লিখলাম—এসব কর্মচারী পরিশ্রম করে এত বছর আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সচল রেখেছে। দুর্যোগকালীন দু’চার মাস তাদের সংসার চালিয়ে নেওয়া কি আপনার দায়িত্ব নয়? সর্বত্র এক অবস্থা। বছরের পর বছর ব্যবসা করেছেন, কারখানা চালিয়েছেন, লাভ করেছেন, ব্যবসার টাকায় আলিশান বাড়ি করেছেন, কিনেছেন গাড়ি। শ্রমিক-কর্মচারীরা তো সেসবের ভাগ চাইতে আসেনি। সংকটে তাদেরকে সাহায্য করা তো আপনাদের কর্তব্য। কিন্তু বিত্তবানদের বেশিরভাগ এটা মানতে নারাজ। আর এ থেকেই সৃষ্টি হয় সামাজিক বৈষম্য; যা কখনো কখনো দুঃখজনক ঘটনার জন্ম দেয়।
ঈদ আসছে। হয়তো আগের আমেজ পাওয়া যাবে না। তারপরও মানুষ উদ্বেলিত হবে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের যে ৫২ জন শ্রমিক পুড়ে মারা গেল তাদের পরিবারে ঈদ আসবে কি? যদিও ওই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে—তারা নিহত-আহত শ্রমিকদের পরিবারের পাশে থাকবে। থাকা উচিতও। ঘটনার তদন্ত চলছে। মালিকসহ কয়েকজন পুলিশের হেফাজতে আছেন। এ মামলার ফলাফল কী হবে তা নিয়ে আগাম মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। তবে এ মূহূর্তে সবচেয় বেশি দরকার স্বজনহারা ওই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো। দেখা যাক প্রতিষ্ঠানটির মালিক পক্ষ সে দায়িত্ব কতটা পালন করে।
চিরাচরিত নিয়মে প্রতি বছর ঈদ আসবে। কিন্তু আগের সে আমেজ আর ফিরে আসবে কি না জানি না। জীবন প্রতি মুহূর্তে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। সবকিছু কেমন বদলে যাচ্ছে। কোনো কিছুই আর ঠিক থাকছে না। তারপরও এখন পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা বাঁচিয়ে রেখেছেন, পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ উপভাগের সুযোগ পাচ্ছি, এটা কী কম সৌভাগ্যের কথা! সবাইকে আগাম ঈদ মুবারক।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।







































