• ঢাকা
  • বুধবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
SonaliNews

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত নিউজ পোর্টাল

বিএনপি-জামায়াতের তীব্র দ্বন্দ্বে বদলে যাচ্ছে নির্বাচনী সমীকরণ


নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ১০, ২০২৫, ০৩:৫৪ পিএম
বিএনপি-জামায়াতের তীব্র দ্বন্দ্বে বদলে যাচ্ছে নির্বাচনী সমীকরণ

ছবি: সোনালীনিউজ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেড় দশকের পরিচিত সমীকরণ যেন আর আগের জায়গায় নেই। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব দেশ ছাড়ে। এর পরবর্তী কয়েক মাসে রাজনীতির মাঠে যে রূপান্তর ঘটেছে, তা উত্তর-২০০৮ পর্বের যেকোনো পরিবর্তনের চেয়ে গভীর এবং বিস্তৃত। দীর্ঘদিনের দুই মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক এখন তীব্র বাকযুদ্ধ, সন্দেহ আর প্রতিযোগিতার নতুন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে এই দ্বন্দ্ব রাজনীতিকে নতুন মেরুকরণে ঠেলে দিয়েছে।

গত ১৫ বছর মানুষ দেখেছে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দ্বিমুখী উত্তাপ। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ার পর রাজনৈতিক আলোচনা দখল করে নিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের পাল্টাপাল্টি মন্তব্য। বিশ্লেষকদের মতে, দুই দলের লড়াই এখন আর আদর্শে সীমাবদ্ধ নয়; বরং আগামী নির্বাচনে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই হয়েছে মূল প্রতিযোগিতা। বিএনপি চায় একক ক্ষমতা নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারের পথে যেতে। অন্যদিকে জামায়াত অতীতের জোটসঙ্গীর পরিচয় ঝেড়ে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে আসতে চায়।

এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে ৭ ডিসেম্বর বিএনপির ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ কর্মসূচিতে ভার্চ্যুয়ালি দেওয়া তারেক রহমানের বক্তব্যে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত নেতাদের ভূমিকা স্মরণ করে দলটির ওপর তীব্র সমালোচনা করেন। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়েও তিনি কঠোর সতর্কবার্তা দেন এবং অভিযোগ তোলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ব্যক্তি বা দল প্রোপাগান্ডায় আওয়ামী লীগের ভূমিকার পুনরাবৃত্তি করছে।

পরদিনই ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নে পাল্টা জবাব দেন জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ধর্ম তারা ধারণ করে, ব্যবহার করে না। ইঙ্গিত দেন, নির্বাচনের সময় যারা আকস্মিক ধার্মিকতা দেখায়, ধর্মকে ব্যবহার করে তারাই। এই মন্তব্য দুই দলের মধ্যে উত্তাপ আরও বাড়ায়।

বিতর্ক এরপর তৃণমূলেও ছড়িয়ে পড়ে। সিলেটের সমাবেশে জামায়াতের আমির অভিযোগ করেন, একটি দল চাঁদাবাজির কারণে ঘৃণিত হয়েছে, আরেকটি তার চেয়েও বেশি শক্তি নিয়ে একই পথে হাঁটছে। দখলদারিত্ব থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ-সবই তিনি বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে তুলে ধরেন। বিএনপির নেতারা পাল্টা বলেন, তারা কোনো মিথ্যা প্রচার করছে না, ইতিহাসভিত্তিক সত্যই মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছে।

এই উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের ফাঁকে ফাঁকে তৃতীয় এক যুদ্ধক্ষেত্র গড়ে উঠেছে-সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপিকে এখন একসঙ্গে মোকাবেলা করতে হচ্ছে দুই দিকের সাইবার আক্রমণ। বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতারা এবং তাদের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা বিএনপির বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। একইসঙ্গে জামায়াতের শক্তিশালী সাইবার ইউনিটও বিএনপির অতীতের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং দলীয় সমস্যা তুলে ধরে ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। বিএনপি মনে করছে, অনলাইন প্রচারণার এই চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নির্বাচনে দলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

রাজনীতির মাঠের আরেকটি আলোচিত বিষয় হলো আওয়ামী লীগের তৃণমূল সমর্থকদের টার্গেট করে জামায়াতের প্রচারণা। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগবিরোধী অবস্থান থাকার পরও এখন দলটি এমন সব বক্তব্য দিচ্ছে যা আওয়ামী লীগের সমর্থকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। গোপালগঞ্জের মতো আওয়ামী লীগ-দুর্গেও জামায়াতের তৎপরতা নজরে এসেছে। তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের আইনি সহায়তা দিচ্ছে, নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছে, এমনকি মামলা–সংক্রান্ত উদ্যোগেও জড়িত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ ভোটাররা অপরাধী নন। তারা এখন দেখছেন কে সৎ, কার কাছে তাদের জান-মাল নিরাপদ। তার বক্তব্যে স্পষ্ট-জামায়াত নিজেকে বিকল্প নিরাপদ শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে।

এতকিছুর মাঝে বিএনপিও চুপ নয়। নাটোরে এক সমাবেশে রুহুল কুদ্দুস দুলু অভিযোগ করেন, জামায়াত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করছে। তার দাবি, আওয়ামী লীগের শাসনামলে যারা বিএনপির ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, জামায়াত এখন তাদের সঙ্গেই সখ্য গড়ে তুলেছে।

এ অভিযোগ অনেক বিশ্লেষকের কাছেই অমূলক নয়। গত বছর আওয়ামী লীগের ওপর নির্যাতনকে ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা জামায়াতের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক কৌশলের অংশ বলেই তারা মনে করেন।

অন্যদিকে বিএনপির অভ্যন্তরে রয়েছে নেতৃত্ব সংকট। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে সংকটজনক অবস্থায়। তারেক রহমান ১৭ বছর নির্বাসনে আছেন; ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর তিনি দেশে ফিরতে পারেন। তাতে দলীয় কর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা বাড়বে ঠিকই, কিন্তু তার সামনে অপেক্ষা করছে কঠিন চ্যালেঞ্জ-দল পুনর্গঠন, নির্বাচনী লড়াই, জামায়াত ও আওয়ামী লীগের অবশিষ্ট কাঠামোর রাজনৈতিক মোকাবেলা।

বাংলাদেশের রাজনীতি তাই এখন এক জটিল সন্ধিক্ষণে। বছরের পর বছর জমে থাকা পরিচিত সমীকরণ ভেঙে নতুন মেরুকরণ তৈরি হচ্ছে। বিএনপিকে আর শুধু আওয়ামী লীগকে প্রতিপক্ষ ধরে এগোতে হচ্ছে না; পুরোনো জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীকেও এখন প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করতে হচ্ছে। এই ত্রিমুখী লড়াই কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা নির্ভর করছে নির্বাচনের প্রাক্কালে দলগুলোর কৌশলগত অবস্থান আর ভোটারের মনস্তত্ত্বের ওপর।

তবে এটুকু নিশ্চিত-আগামী জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যুক্ত করতে যাচ্ছে, যেখানে অতীতের সব জোট-সমীকরণ নতুনভাবে মূল্যায়নের মুখোমুখি হবে।

এসএইচ 

Wordbridge School
Link copied!