• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সম্পদে নারীর উত্তরাধিকার


এম জহিরুল ইসলাম জানুয়ারি ১৪, ২০২১, ০৩:৩৪ পিএম
সম্পদে নারীর উত্তরাধিকার

ঢাকা : নারী-পুরুষের অংশ প্রাপ্তির একটি তুলনামূলক চিত্র : মিসরের জাতীয় ফতোয়া বোর্ড কর্তৃক প্রচারিত এক ফতোয়ায় উত্তরাধিকার সম্পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে। তাতে যে বিস্ময়কর তথ্য এসেছে তার মাধ্যমে অনেকের চোখ খুলে যেতে পারে, বিবেক পেতে পারে নতুন খোরাক। ওই পরিসংখ্যানে নারী কখন পুরুষের অর্ধেক পায়, আর কখন সমান পায়, আর কখন বেশি পায় তার বর্ণনা এসেছে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে।

নারী চার অবস্থায় পুরুষের অর্ধেক পায়

(১) মেয়ে ও নাতনি (ছেলের মেয়ে) ছেলে ও নাতি (ছেলের ছেলে) থাকা অবস্থায়। (২) ছেলে সন্তান এবং স্বামী বা স্ত্রী না থাকলে ‘মা’ বাবার অর্ধেক পায়। (৩) সহোদরা বোন সহোদর ভাইয়ের সঙ্গে ওয়ারিশ হলে। (৪) বৈমাত্রেয় বোন বৈমাত্রেয় ভাইয়ের সঙ্গে ওয়ারিশ হলে।

১০ অবস্থায় নারী পুরুষের সমান পায়

(১) বাবা-মা সমান অংশ পাবে ছেলের ছেলে থাকলে। (২) বৈপিত্রেয় ভাইবোন সব সময় সমান অংশ পায়। (৩) বৈমাত্রেয় ভাইবোন থাকলে সব ধরনের বোনেরা (সহোদরা, বৈপিত্রেয় ও বৈমাত্রেয়) বৈপিত্রেয় ভাইয়ের সমান পাবে। (৪) শুধুমাত্র ঔরসজাত মেয়ে ও মৃতের ভাই একসঙ্গে থাকলে উভয়ে সমান অংশ পাবে (মেয়ে পাবে অর্ধেক আর বাকি অংশ পাবে চাচা)। (৫) ‘নানি’ বাবা ও ছেলের ছেলের সঙ্গে সমান অংশ পায়। (৬) মা ও বৈপিত্রেয় দুই বোন স্বামী ও সহোদর ভাইয়ের সঙ্গে সমান অংশ পায়। (৭) ‘সহোদরা বোন’ স্বামীর সঙ্গে ওয়ারিশ হলে সহোদর ভাইয়ের সমান অংশ পাবে। অর্থাৎ সহোদরা বোনের পরিবর্তে সহোদর ভাই হলে যে অংশ পেত ঠিক সহোদরাও একই অংশ পাবে। অর্থাৎ মূল সম্পদের অর্ধেক পাবে। (৮) বৈমাত্রেয় বোন সহোদর ভাইয়ের সমান অংশ পায় যদি মৃত ব্যক্তির স্বামী, মা, বৈপিত্রেয় এক বোন এবং একজন সহোদর ভাই থাকে। এ অবস্থায় স্বামী মূল সম্পদের অর্ধেক, মা এক-ষষ্ঠাংশ, বৈপিত্রেয় ভাই এক-ষষ্ঠাংশ এবং বাকি এক-ষষ্ঠাংশ পাবে সহোদর ভাই। (৯) নির্দিষ্ট অংশধারী ওয়ারিশ পাওয়ার মতো কেউ না থাকলে নিকটতম রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়রা সমান অংশ পাবে। যেমন : মেয়ের ছেলে, মেয়ের মেয়ে, মামা ও খালা ছাড়া অন্য কোনো ওয়ারিশ না থাকলে তাদের সবাই সমান অংশ পাবে। (১০) তিন প্রকারের মহিলা এবং তিন প্রকারের পুরুষ কখনো সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হয় না। এক্ষেত্রেও নারী-পুরুষ সমান অধিকার ভোগ করছে।

অনেক অবস্থায় নারী পুরুষের চেয়ে বেশি পায়। যেমন : (ক) স্বামী থাকা অবস্থায় একমাত্র কন্যা পাবে অর্ধেক আর স্বামী পাবে এক-চতুর্থাংশ। (খ) দুই কন্যা স্বামীর সঙ্গে হলে। দুই মেয়ে পাবে দুই-তৃতীয়াংশ আর স্বামী এক-চতুর্থাংশ। (গ) কন্যা মৃতের একাধিক ভাইয়ের সঙ্গে হলে বেশি পাবে। (ঘ) যদি মৃত ব্যক্তি স্বামী, বাবা, মা ও দুই কন্যা রেখে যায় তবে দুই মেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ সম্পদ পাবে। কিন্তু ঠিক একই অবস্থায় যদি মেয়ের পরিবর্তে দুই ছেলে থাকত তবে তারা নিশ্চিতভাবে দুই মেয়ের তুলনায় কম পেত। কেননা ছেলের অংশ হলো এখানে অন্যান্য ওয়ারিশদের তাদের নির্ধারিত অংশ দেওয়ার পর যা বাকি থাকে। সুতরাং স্বামী পাবে এক-চতুর্থাংশ, বাবা ও মা উভয়ে পাবে এক-ষষ্ঠাংশ করে এবং বাকি অংশ পাবে দুই ছেলে যা দুই-তৃতীয়াংশ তো নয়ই বরং অর্ধেকের চেয়েও কম। (ঙ) ঠিক একই ধরনের আরেকটি অবস্থা দুই সহোদরা বোনের ক্ষেত্রে। যদি ওয়ারিশদের মধ্যে স্বামী, দুই সহোদরা বোন এবং মা থাকে তখন দুই বোন দুই-তৃতীয়াংশ সম্পদ পায়। কিন্তু ঠিক একই অবস্থায় যদি দুই বোনের জায়গায় দুই ভাই থাকত তখন ওই দুই ভাই মিলে এক-তৃতীয়াংশের বেশি পেত না। (চ) তেমনিভাবে একই অবস্থায় বৈমাত্রেয় দুই বোন বৈমাত্রেয় দুই ভাইয়ের চেয়ে বেশি পায়। (ছ) অনুরূপভাবে যদি ওয়ারিশদের মধ্যে স্বামী, বাবা, মা ও মেয়ে থাকে তবে মেয়ে মূল সম্পদের অর্ধেক পাবে। কিন্তু ঠিক একই অবস্থায় ছেলে থাকলে পেত তার চেয়ে কম। যেহেতু তার প্রাপ্যাংশ হলো অংশীদারদের দেওয়ার পর অবশিষ্টাংশ। (জ) ওয়ারিশ যদি হয় স্বামী, মা ও এক সহোদরা বোন তখন ওই সহোদর বোন অর্ধেক সম্পদ পাবে যা তার স্থানে সহোদর ভাই হলে পেত না। (ঝ) ওয়ারিশ যদি হয় স্ত্রী, মা, বৈপিত্রেয় দুই বোন এবং দুই সহোদর ভাই তখন দূরের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও বৈপিত্রেয় দুই বোন দুই সহোদরের চেয়ে বেশি পাবে। যেহেতু বৈপিত্রেয় বোনদ্বয় পাবে এক-তৃতীয়াংশ, আর দুই সহোদর পাবে অবশিষ্টাংশ যা এক-তৃতীয়াংশের চেয়েও কম। (ঞ) যদি স্বামী, বৈপিত্রেয় বোন ও দুই সহোদর ভাই থাকে সে ক্ষেত্রে বৈপিত্রেয় বোন এক-তৃতীয়াংশ পাবে। অথচ এই দুই সহোদর অবশিষ্টাংশ থেকে যা পাবে তা ওই বোনের এক-চতুর্থাংশেরও কম। (ট) ওয়ারিশ যদি হয় বাবা, মা ও স্বামী এ ক্ষেত্রে ইবনে আব্বাস (রা.)-এর মত অনুসারে মা পাবে এক-তৃতীয়াংশ, আর বাবা পাবে এক-ষষ্ঠাংশ অর্থাৎ মায়ের অর্ধেক। (ঠ) স্বামী, মা, বৈপিত্রেয় বোন ও দুই সহোদর ভাই ওয়ারিশ হলে এক্ষেত্রে ওই বোন দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও সহোদর ভাইদ্বয়ের দ্বিগুণ পাবে।

অনেক সময় নারী মিরাছ পায় কিন্তু তার সমমানের পুরুষ বঞ্চিত হয়। যেমন : (ক) ওয়ারিশ যদি হয় স্বামী, বাবা, মা, মেয়ে ও নাতনী (ছেলের মেয়ে) এক্ষেত্রে নাতনী এক-ষষ্ঠাংশ পাবে। অথচ একই অবস্থায় যদি নাতনীর পরিবর্তে নাতী (ছেলের ছেলে) থাকত তখন এই নাতী কিছুই পেত না। যেহেতু নির্ধারিত অংশীদারদের দিয়ে অবশিষ্টাংশই তার প্রাপ্য ছিল। অথচ এ অবস্থায় কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তাই তার প্রাপ্তির খাতাও থাকে শূন্য। (খ) স্বামী, সহোদরা বোন ও বৈমাত্রেয় বোন থাকা অবস্থায় বৈমাত্রেয় বোন এক-ষষ্ঠাংশ পাবে। অথচ তার স্থানে যদি বৈমাত্রেয় ভাই থাকত তবে সে কিছুই পেত না, যেহেতু তার জন্য নির্ধারিত অংশ নেই। (গ) অনেক সময় দাদি মিরাছ পায়; কিন্তু দাদা বঞ্চিত হয়। (ঘ) মৃত ব্যক্তির যদি শুধুমাত্র নানা ও নানিই ওয়ারিশ হিসেবে থাকে তখন সব সম্পত্তি পাবে নানি। নানা কোনো কিছুই পাবে না।

এ তুলনামূলক আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো-এ বাস্তবতাকে সাব্যস্ত করা : (১) নারী পুরুষের অর্ধেক পায় এই বিধান সব সময়ের জন্য নয়। (২) অংশ পাওয়ার ক্ষেত্রে নারী কোনো অংশেই পুরুষের চেয়ে কম নয়।

মেয়ে কেন ছেলের অর্ধেক পায় : এখানে জোরালো একটি প্রশ্ন থেকে যায় আর তা হচ্ছে ছেলে থাকা অবস্থায় ‘মেয়ে’, ভাই থাকলে ‘বোন’ কেন তার অর্ধেক পাবে? তার মানে কি মেয়ে-সন্তান ছেলে-সন্তানের অর্ধেক মর্যাদা রাখে? এ সংশয় নিরসনের পূর্বে স্মরণ করা প্রয়োজন যে ইসলামী উত্তরাধিকার বিধানে নারী-পুরুষের বিভাজনটি মৌলিক কোনো লক্ষণীয় বিষয় নয়। বরং সামাজিক দায়ভার ও আর্থিক প্রয়োজনীয়তার কারণেই সাধারণত প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তফাত হয়ে থাকে। ছেলে সন্তান মেয়ের দ্বিগুণ পাওয়ার অনেকগুলো যৌক্তিক কারণের মধ্যে কয়েকটি হলো :

(ক) পারিবারিক দায়িত্ব : পরিবারের কর্তা হিসেবে সব খরচপাতি বহন করতে হয় ছেলেকে। বাবা-মার খেদমত, সন্তানদের লালন-পালন এবং আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজখবর নেওয়ার দায়িত্বও মূলত পুরুষের ওপরই অর্পণ করেছে ইসলাম। বিপরীতে মেয়ে এসব দায়িত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। তারপরও ইসলাম তাকে বঞ্চিত করেনি।

(খ) স্ত্রীর যাবতীয় অধিকার : দাম্পত্য জীবনে প্রবেশের পথে পুরুষকে গুণতে হয় স্ত্রীর দেনমোহর বাবদ একটি মোটা অঙ্কের কড়ি। আর বিয়ের পর স্ত্রীর ভরণপোষণ ও যাবতীয় খরচপাতিও এই পুরুষকেই বহন করতে হয়। পক্ষান্তরে মেয়ে বিয়ের আগে থাকে বাবার তত্ত্বাবধানে। তার আদর সোহাগে বড় হয়। বিয়ের সময় স্বামীর কাছ থেকে দেনমোহর পায়। তারপর তার ভরণপোষণের যাবতীয় দায়িত্ব স্বামীর। সাংসারিক খরচ বাবদ একটি পয়সাও তাকে ব্যয় করতে হয় না। সবই স্বামীর দায়িত্ব। তাই তার প্রাপ্ত সম্পদের মূলধন কখনো হ্রাস পায় না। এরপরও তো ইসলাম তাকে বঞ্চিত করেনি। বরং ইসলাম তার সম্পদকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছে অত্যন্ত সুন্দরভাবে।

এসব যৌক্তিক কারণে ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের দাবি হলো, ছেলেকে মেয়ের চেয়ে বেশি দেওয়া। যেহেতু ইনসাফ হলো সুষম বণ্টন, সমান বণ্টন নয়।

পরিশেষে বলতে হয়, ইসলামের উত্তরাধিকার বিধান একটি মানবিক ও ন্যায়সঙ্গত বিধান। যেখানে প্রত্যেক শ্রেণীর ওয়ারিশের তার উচিত প্রাপ্যাংশ লাভের নিশ্চয়তা রয়েছে। সত্য উপলব্ধিকারী অমুসলিম চিন্তাবিদ ‰ostaf lobon ইসলামী উত্তরাধিকার বিধানকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে, কোরআনে বর্ণিত উত্তরাধিকার বিধান বড়ই ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক। এ বিধানকে ফরাসি ও ব্রিটিশ আইনের সঙ্গে তুলনা করে আমার কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে, ইসলামী শরিয়া বা বিধান স্ত্রীদের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এমন সব অধিকার দিয়েছে যার কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না আমাদের আইনসমূহে। হ্যাঁ, আল্লাহর দেয়া বিধানের তুলনা কোনো মানব রচিত বিধানের সঙ্গে চলে না। আল্লাহর বিধান সর্বকালের, সর্বস্থানের এবং সকলের জন্য। আর আল্লাহর আইন অনুসরণেই রয়েছে মানবাতার মুক্তি, শান্তি ও সাফল্যের নিশ্চয়তা।

লেখক : আলেম, সাংবাদিক

 

Wordbridge School
Link copied!