• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনার হিড়িক


বিশেষ প্রতিবেদক এপ্রিল ২, ২০২১, ১২:৪৮ এএম
অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনার হিড়িক

ঢাকা : প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। তাই উপসর্গহীন ও মৃদু উপসর্গের করোনা রোগীদের বাড়িতে থেকে চিকিৎসার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিমিটারসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনে বাড়িতে মজুতের হিড়িক শুরু হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা যায়, কিছু মানুষ আতঙ্কিত হয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার, পালস্ অক্সিমিটার কেনার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন বিভিন্ন মার্কেট ও সরবরাহ প্রতিষ্ঠানে। আর এই সুযোগে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী মজুত করছেন আগামীতে বেশি দামে বিক্রির জন্য। এরই মধ্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রির প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এসব বেচাকেনায় মানা হচ্ছে না কোরো বিধিনিষেধ। চিকিৎসকের পরামর্শপত্র ছাড়াই দেদার বিক্রি হচ্ছে সিলিন্ডার।

কয়েকজন ক্রেতা জানান, স্বজনদের মধ্যে ভবিষ্যতে কে করোনা আক্রান্ত হবেন, কার অবস্থা সংকটাপন্ন হবে, এমন শঙ্কায় আগেভাগেই অক্সিজেন সিলিন্ডারের খোঁজ করা হচ্ছে। তবে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও চড়া। এজন্য অনেকেই অক্সিজেন সিলিন্ডার না কিনেই বাড়ি ফিরেছেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ ছাড়া বাড়িতে অক্সিজেন ব্যবহারে রোগীর ঝুঁকি আরো বাড়তে পারে। এমনকি অন্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

এদিকে করোনা সংক্রমণ বাড়ায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলো। গত কয়েকদিন ধরে বেসরকারি হাসপাতালেও শয্যা মিলছে না। করোনা উপসর্গ নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৩ থেকে ৪ চারজন চিকিৎসা নিতে আসছেন। এর মধ্যে গুরুতর রোগীই বেশি।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বুধবার রাত ৮ থেকে বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) সকাল ৮ পর্যন্ত করোনা ইউনিটে চিকিৎসা নিতে এসেছেন ৩৯ জন। এর মধ্যে ভর্তি করতে হয়েছে ২৬ জনকে। তবে প্রচুর চাহিদার কারণে গত এক বছরে হোম সার্ভিস হিসেবে অক্সিজেন সিলিন্ডার ডেলিভারির বেশকিছু প্রতিষ্ঠান হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে তারা দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ দামেও বিক্রি করছে একেকটি সিলিন্ডার। পাশাপাশি স্বল্প সময়ের জন্য ভাড়াও দেওয়া হচ্ছে। সিলিন্ডারের পাশাপাশি পোর্টেবল অক্সিজেন ক্যান, পোর্টেবল ভেন্টিলেটর এবং শরীরে অক্সিজেন লেভেল পরিমাপের জন্য ‘পালস অক্সিমিটার’ও দেদার বিক্রি হচ্ছে।

অন্যদিকে রাজধানীতে অক্সিজেন সিলিন্ডার হোম ডেলিভারি দেওয়ার জন্য বেশকিছু অনলাইন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং ফেসবুক পেজ চালু হয়েছে। এগুলোতে সিলিন্ডারের পরিমাণ, দাম এবং জরুরি নম্বর দেওয়া আছে। এ ধরনের একটি ফেসবুক পেজ ‘এমসিএল ভার্চুয়াল হাসপাতালে’র অ্যাডমিন মাহবুব আলম জানান, গত দুই সপ্তাহে অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা বেড়ে গেছে। এতে দামও কিছুটা বাড়ছে। এক বছর আগে এক হাজার ৫০০ লিটার পরিমাণের সিলিন্ডারের দাম সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা ছিল, সেটা এখন ২৬ হাজার ৫২২ টাকা। এ দাম আরো বাড়তে পারে।

তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এখনই সিলিন্ডার সংকট দেখা দিয়েছে। কারণ অনেকে করোনা আতঙ্কে সিলিন্ডার কিনে মজুত করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা অক্সিজেন সিলিন্ডার ভাড়া দেওয়ারও ব্যবস্থা চালু করেছেন। জরুরি প্রয়োজনে খুব কম সময়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করা হবে, রোগীর প্রয়োজন শেষ হলে আবার ফেরত নিয়ে আসা হবে। ভাড়া ব্যবস্থা জনপ্রিয় হলে অযথা সিলিন্ডার মজুত করার প্রবণতা কমবে।

অনলাইনে দেখা যায়, সিলিন্ডারের পাশাপাশি ১২ লিটারের পোর্টেবল অক্সিজেন বারও বিক্রি হচ্ছে। অনলাইনে অক্সিজেনের পরিমাপের ফলোমিটারের দামও আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে। কয়েকটি অনলাইন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান থেকে জানা গেছে, অক্সিজেন ব্যবহারের সময় পরিমাপের জন্য ব্যবহূত ফলোমিটারও সংকট হয়ে গেছে। দেড় হাজার টাকার ফলোমিটার এখন বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এটা আরো বাড়তে পারে।

এর আগে, গত বছর করোনার প্রকোপ বাড়া শুরু করলে, তখন বাজারে অক্সিজেন সিলিন্ডারে সংকট তৈরি হয়। তবে এবারে সেই শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন দোকানিরা। ‘অক্সিজেন ঢাকা ডট কম’-এর স্বত্বাধিকারী জিয়েম মোল্লা বলেন, এখনো বাজারে সিলিন্ডারের তেমন সংকট নেই। বাজারের পাশাপাশি, অনলাইনেও চাহিদা বাড়ছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের। চব্বিশ ঘণ্টা হোম ডেলিভারি, সিলিন্ডার রিফিলের সুবিধা নিচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু যেহেতু  চাহিদা বাড়ছে, তাই দামও ঊর্ধ্বমুখী।

তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়াই অক্সিজেন সিলিন্ডারের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারে প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুনশি বলেন, অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহারের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। শ্বাসকষ্ট হলে কখন কীভাবে অক্সিজেন ব্যবহার করতে হবে, তা অনেকেই জানেন না। প্রয়োজন ছাড়া অক্সিজেন ব্যবহারে শরীরে অন্য সংক্রমণ হতে পারে। এছাড়া বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুত রাখার নির্দিষ্ট নিয়মও রয়েছে। মেয়াদ উত্তীর্ণ সিলিন্ডারের অক্সিজেন শরীরে গেলে অসুস্থতা বাড়তে পারে।

আইইডিসিআর’র উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন জানান, এভাবে অক্সিজেন ব্যবহার শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, এ অক্সিজেন ব্যবহার রোগীর কোনো কাজেই আসে না। রোগীর কতটুকু অক্সিজেন প্রয়োজন সেটা না বুঝে অক্সিজেন দেওয়া হলে তা রোগীর ক্ষতির কারণ হতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, অক্সিমিটার যে কেউ বাড়িতে রাখতে পারেন। তবে প্রয়োজন ছাড়া অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখার যৌক্তিকতা নেই। স্বাস্থ্য সামগ্রীর দাম কোথাও অন্যায়ভাবে বেশি নেওয়া হলে প্রশাসন নিশ্চয় ব্যবস্থা নেবে।

এদিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে আইসিইউ বেডের সংকটও তীব্র হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকায় করোনার জন্য নির্ধারিত সরকারি ব্যবস্থাপনার ১০টি হাসপাতালের ১০৮টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার ১০৩টিতে রোগী ভর্তি ছিলেন। এসব হাসপতালে মোট ৫টি আইসিইউ ফাঁকা রাখা হয়েছে খুব মারাত্মক রোগীর জন্য।

বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকালও কোনো আইসিইউ ফাঁকা ছিল না। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১টি এবং রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল এবং মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে ২টি আইসিইউ ফাঁকা ছিল।

এ অবস্থায় হাসপাতালে সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার দ্রুত জোরালো পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহারের চেয়ে, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা জানার জন্য পালস অক্সিমিটার ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। রোগীর অক্সিজেন ঘাটতি তৈরি হলে, সাথে সাথে হাসপাতালে বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা নেওয়ার উপদেশ তাদের।

অন্যদিকে প্রায় এক বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি দেশের প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা। গত বছরের ২ জুন একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে প্রতিটি হাসপাতালে ভেন্টিলেটর স্থাপন এবং উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা বাড়াতে বলেন তিনি। এ জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার নির্দেশও দেন। এর আগে গত বছরের ২৭ এপ্রিল দেশের সব জেলায় আইসিইউ স্থাপন করা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, সপ্তাহখানেকের মধ্যে জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট করার মতো যন্ত্রপাতি, শয্যার ব্যবস্থা করা সম্ভব। কিন্তু আইসিইউ পরিচালনা করতে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, নার্স প্রয়োজন। জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট করার মতো লোকবলের অভাব রয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!