• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রমাবনতির ধারা অব্যাহত


বিশেষ প্রতিনিধি জুলাই ৪, ২০২১, ০১:০৯ এএম
ক্রমাবনতির ধারা অব্যাহত

ঢাকা : দেশে করোনা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির ধারা অব্যাহত আছে। হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। দেখা দিয়েছে অক্সিজেনের সংকট। আইসিইউতে শয্যা না পেয়ে মৃত্যুর বিষয়টি মনুষ ছেড়ে দিচ্ছে নিয়তির ওপর। অগ্রিম কবর খনন করে রাখা হয়েছে কবরস্থানে। স্বাস্থ্যখাতে এরকম অব্যবস্থাপনায় জাতীয় সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পড়েছেন তীব্র সমালোচনার মুখে। তবে দেশের কিছু জেলায় করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে বলে জানা গেছে।

দেশে গত কয়েকদিন ধরে করোনা সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। শতাধিক মৃত্যুর ধারা অব্যাহত আছে বেশ কয়েকদিন ধরে।

শনিবার (৩ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় এ ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে আরো ১৩৪ জনের প্রাণ। গত ২৫ জুন থেকে (২৬ জুন ছাড়া) এ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই শতাধিক মৃত্যুর তথ্য মিলেছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমণ ধরা পড়েছে ৬ হাজার ২১৪ জনের শরীরে।  দেশে এ পর্যন্ত করোনা ধরা পড়েছে ৯ লাখ ৩৬ হাজার ২৫৬ জনের শরীরে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৪ হাজার ৯১২ জনের।

এদিকে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বৃদ্ধির পাশাপাশি হাসপাতালগুলোতেও দেখা দিয়েছে শয্যা সঙ্কট। খালি নেই আইসিইউ। অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।

শনিবার (৩ জুলাই) জাতীয় সংসদে এ নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তীব্র সমালোচনা করেছেন সংসদ সদস্যরা।  সাতক্ষীরা ও বগুড়ায় অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।

বগুড়ার বিএনপির সংসদ জি এম সিরাজ বলেন, অক্সিজেনের অভাবে বগুড়ায় ২ দিনে ২৪ জন মারা গেছেন। কোভিডের জন্য নির্ধারিত মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল ২৫০ বেডের। এর মধ্যে আইসিইউ বেড আছে আটটি। কিন্তু হাই-ফ্লো নাজাল ক্যানুলা আছে মাত্র দুটি। ফলে বাকি আইসিইউ বেড কোনো কাজেই লাগছে না।

তিনি জানান, বগুড়ায় ৩টি হাসপাতালের ৪৫০টি বেড রোগীতে ঠাসা। নতুন রোগী ভর্তি হতে পারছেন না। প্রতিটি হাসপাতালে ২০টি হাই-ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহের দাবি জানান তিনি।

জাপার কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, সাতক্ষীরায় অক্সিজেনের অভাবে এক ঘণ্টায় সাতজন ছটফট করে মারা গেছেন। জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে বলেন, ৩৭টি জেলায় অক্সিজেন নেই। মানুষ মারা যাচ্ছে।

আমাদের জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো বিভিন্ন প্রতিবেদনেও ফুটে উঠেছে দেশব্যাপী করোনার ভয়াবহতার চিত্র।

রংপুর প্রতিনিধি জানান, এই বিভাগে গত কয়েকদিন ধরেই বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) চাহিদাও। এই বিভাগের করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নেই। স্বজনরা আইসিইউ শয্যার জন্য ছোটাছুটি করেও না পেয়ে মৃত্যুর বিষয়টি ছেড়ে দিচ্ছে নিয়তির ওপর।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ফোকাল পার্সন ডা. মহিউদ্দিন খান মুন জানান, করোনা ইউনিটে গত ২৪ ঘণ্টায় ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রতিনিয়ত এখানে রোগীর চাপ বাড়ায় করোনা ইউনিটের আইসিসিইউর আসন সংখ্যা ১৩টি থেকে বাড়িয়ে ২০টি এবং সাধারণ ওয়ার্ড ২১০টি থেকে বাড়িয়ে ২৪২টি করা হয়েছে। বর্তমানে আইসিইউর ২০টি আসনের সবগুলোই রোগীতে পূর্ণ রয়েছে এবং সাধারণ ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন ২৬০ জন।

এদিকে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৩৬৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৭২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। জেলায় শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

বগুড়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গত ২৪ বগুড়ায় করোনা সংক্রমণ আরো বেড়েছে। সংক্রমণ হার পৌঁছেছে ৩৬। বগুড়ার স্বাস্থ্য বিভাগের মুখপাত্র ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান তুহিনের জানান, রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শনিবার আরো ৭০টি শয্যা বাড়ানো হয়েছে।

সংক্রমণের আশঙ্কাজনক অবস্থানে আছে যশোরও। এখানেও হাসপাতালে বাড়ানো হয়েছে সিটের সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় যশোর জেনারেল হাসপাতালে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

যশোরের ২৫০ শয্যা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের ১৪০ সিটের বিপরীতে ২০২ জন ভর্তি আছে। যেসব রোগী হাসপাতালে আনা হচ্ছে তারা খুব মুমূর্ষু অবস্থায় আসছে এবং ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে মারা যাচ্ছে।

এদিকে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে শনিবার ঘোষিত করোনা টেস্টের ফলাফলে ২৫০ জনের নমুনায় কোভিড-১৯ পজিটিভ পাওয়া গেছে। ৭১৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করে এই ফল পাওয়া যায়। শনাক্তের হার ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ।

আমাদের পাবনা প্রতিনিধি কানু সান্যাল জানান, সংক্রমণ অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে পাবনার শহর থেকে অজপাড়াগাঁয়ে। প্রতিদিনই আক্রান্তের নতুন রের্কডে ভয়াবহ করে তুলছে পাবনার করোনা পরিস্থিতি। গত ২৪ ঘণ্টায় পাবনায় ২৪৪ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা স্বাস্থ্যবিভাগ।

উচ্চ সংক্রমণ অব্যাহত আছে গোপালগঞ্জেও। জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬৭ নমুনায় শনাক্ত হয়েছে ৯১ জন। শনাক্তের হার ৫৪ দশমিক ৪৯ ভাগ। গোপালগঞ্জে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে দুই মহিলাসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৫৯ জনে।

জামালপুর প্রতিনিধি জানান, জামালপুরে প্রতিদিন বেড়েই চলছে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা। নতুন করে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নার্সসহ ৪৮ জন আক্রান্ত হয়েছে। এনিয়ে জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ালো ২৯৭০ জনে। একদিনে নমুনা পরীক্ষার হিসাব অনুযায়ী আক্রান্তের হার ১৯.৫১ শতাংশ।

দিনাজপুর জেলা প্রতিনিধি শাহাদৎ হোসেন শাহ্ জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় দিনাজপুরে করোনাভাইরাস ও উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ১৬ জন। মেডিকেল কলেজে আরো একটি পিসিআর ল্যাব স্থাপনের কাজ চলছে। গতকাল শনিবার পর্যন্ত এখানে সিনোফার্ম ভ্যাকসিন নিয়েছেন ১২২৫ জন।

তবে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির মধ্যে থাকলেও সীমান্তবর্তী কিছু জেলায় করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণের হার কিছুটা কমেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

সর্বশেষ ফলাফলে সাতক্ষীরায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬৪ জনের শরীরে নমুনা পরীক্ষায় ২৯ জনের  করোনা পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে। যা পরীক্ষা বিবেচনায় হার ১৭.৬৯ শতাংশ। যা গত একমাসের মধ্যে সর্বনিন্ম সংক্রমণ হার। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় করোনায় কেউ মারা যায়নি । জেলায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ৭৮ জন।

জেলা সিভিল সার্জনের মতে, যদি লকডাউন এমন কঠোরভাবে চলে তাহলে ২ সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণের হার ২% এ নেমে আসবে।

এদিকে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগেও পূর্বদিনের তুলনায় গতকাল মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কম ছিল বলে খবর পাওয়া গেছে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টার মধ্যে তাদের মৃত্যু হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার একই সময় পর্যন্ত ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় মারা যান ২২ জন। রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

অন্যদিকে খুলনা বিভাগে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই সময়ে নতুন করে ৫৩৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক রাশেদা সুলতানা শনিবার এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, এখানেও করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে এখানে ১৭ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়াও গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে আরো ৩ জন। এ নিয়ে জেলায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ১ শ জনে।                                                                                       

এদিকে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে রাজধানী রায়েরবাজার কবরস্থানে অগ্রিম কবর খনন করে রাখা হয়েছে। রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধের ঠিক পেছনে রায়েরবাজার  কবরস্থানের ৮ম ব্লকে এরকম ২৫টি কবর তৈরি করে রাখা হয়েছে।

কবরস্থানটির সিনিয়র মোহরার আব্দুল আজিজ বলেন, আমরা সব সময় লাশ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত। তবে আগের তুলনায় এখানে তেমন একটা করোনায় মারা যাওয়া লাশ আসছে না। গত জুন থেকে ১২টি লাশ দাফন হয়েছে।

এছাড়া কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনও করোনায় বা করোনা সন্দেহে মৃতদের লাশ সৎকারের ধারা অব্যাহত রেখেছে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন ঢাকায় এ পর্যন্ত করোনায় বা করোনা সন্দেহে মৃত ২৮২ জনের, উত্তরাঞ্চলে ৩২ জনের, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে ৩১ জনের এবং বরিশাল বিভাগে ২৩ জন করোনা আক্রান্ত বা করোনা সন্দেহে মৃতকে যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় দাফন করেছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!