• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা

প্রতারণার ফাঁদে সর্বস্বান্ত গ্রাহক


বিশেষ প্রতিনিধি সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২১, ০৭:৪৪ পিএম
প্রতারণার ফাঁদে সর্বস্বান্ত গ্রাহক

ঢাকা : রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার ব্যবসায়ী সুমন। ই-কমার্স ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের মোটরসাইকেলে বিশাল ছাড় দেখে ৭২ লাখ টাকা লগ্নি করেন। অথচ কোনো পণ্যই পাননি তিনি। উল্টো ই-অরেঞ্জের এমডি ও চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার হয়ে এখন রয়েছে কারাগারে। আর প্রতিষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষক বনানী থানা পুলিশের পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা ভারতে আটক হয়েছেন।  

বিপুল অঙ্কের টাকা হারিয়ে সুমনের এখন পথে বসার উপক্রম। বিভিন্ন ই-কমার্স ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের প্রতারিত গ্রাহকদের বিক্ষোভ সমাবেশ হলেই সুমনকে চোখে পড়ে। সর্বস্ব হারিয়ে তিনি এখন পাগলপ্রায়।

শুধু সুমন নয়, ই-কমার্স ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে পণ্য না পেয়ে লাখ লাখ গ্রাহক এখন প্রতারণার শিকার। বিভিন্ন মামলায় কারাগারে আছেন ইভ্যালিসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্নধাররা। এমন অবস্থায় প্রতারিত গ্রাহকরা টাকা পাবেন কি না তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে গভীর সংশয়।

বর্তমানে প্রতারণা ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, কিউকম, এসপিসি ওয়ার্ল্ড, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল, সিরাজগঞ্জ শপ, নিরাপদ ডটকম, আলাদিনের প্রদীপ, এসকে ট্রেডার্স ও মোটরস, ২৪টিকেট ডটকম, গ্রিনবাংলা, এক্সিলেন্ট বিগবাজার, ফাল্গুনিশপসহ ২৬টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুদক, পুলিশ, র্যাব, সিআইডিসহ অন্তত নয়টি সংস্থা।

এদিকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নামে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এ কথা জানান।

জানা গেছে, ই-কমার্স খাতের ওই ২৬ প্রতিষ্ঠান লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা সংগ্রহ করলেও পণ্য সরবরাহ করেনি। অধিকাংশ কোম্পানির টাকার হদিসও নেই। এমনকি মার্চেন্টদের থেকে পণ্য এনে সেই টাকাও পরিশোধ করেনি। প্রতারণায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাধারণ গ্রাহক। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা (ই-ক্যাব)-র তদন্তে এ চিত্র উঠে এসেছে। 

প্রশ্ন উঠেছে, কোথায় গেল এত টাকা। এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সমপ্রতি এসপিসি ওয়ার্ল্ড ও ধামাকা শপিং নামের দুটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের তদন্ত করতে গিয়ে মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণ পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। পরে প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে অর্থ-পাচারের মামলা করে সিআইডি। যদিও গত জুলাই মাসে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ধামাকা শপিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসিম উদ্দিন চিশতি। আত্মগোপনে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানসহ একাধিক কর্মকর্তা। গতকাল শনিবার প্রতারিত গ্রাহকরা টাকা ফেরতের দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ধামাকার ৬৫০ জন সরবরাহকারীসহ ৩ লাখ গ্রাহক রয়েছে। ধামাকা শপিং ডটকমে উদ্যোক্তা বা সরবরাহকারীদের ২০০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। 

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ধামাকা শপিং ডটকম সেলার অ্যাসোসিয়েশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম। সরবরাহকারীদের টাকা পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে ফেরতের দাবি করা হয়। এ সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করলে প্রতিষ্ঠানটির এমডি ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন তারা।

সমপ্রতি ৪৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আটক করা হয়েছে ই-অরেঞ্জের একাধিক কর্মকর্তাকে। সামপ্রতিক সবচেয়ে আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল এবং চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গত বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) । এরপর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, অর্ধেক দামে পণ্য দেওয়ার নামে হাজার হাজার ক্রেতার কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা সংগ্রহ করে পণ্য দেওয়া হচ্ছে ২০-৩০ জনকে। সেই পণ্য হস্তান্তরের বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করে আবারো টাকা সংগ্রহ করা হয় হাজার হাজার ক্রেতা থেকে। ফের পণ্য দেওয়া হচ্ছে ২০-৩০ জনকে। দ্রুত বড় অঙ্কের টাকা সংগ্রহে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকারের মতো দামি পণ্যে দেওয়া হচ্ছে সর্বাধিক ছাড়। এভাবে দফায় দফায় লাখো ক্রেতার কাছ থেকে হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে দেশের বাইরে। সংগৃহীত টাকার একটা অংশ সরিয়ে ফেলা হচ্ছে নিজেদের অন্য ব্যবসায় বা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে। নিজের ও স্বজনের নামে কিনছেন আলিশান বাড়ি, দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (ফাইন্যানসিয়াল ক্রাইম) মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ইতোমধ্যে আমরা এসপিসি ওয়ার্ল্ড ও ধামাকা শপিংয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত করে মানি লন্ডারিংয়ের তথ্য পেয়ে মামলা করেছি। প্রাথমিক তদন্তে ধামাকা শপিংয়ের বিরুদ্ধে ৮৯ কোটি টাকা লন্ডারের তথ্য পাই। আরো টাকা তারা ভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করেছে। আইনানুযায়ী, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ টাকা স্থানান্তর করতে পারে না।

সূত্র মতে, অভিযুক্ত বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ কয়েক হাজার কোটি টাকার। এরমধ্যে ই-কমার্সের নামে প্রতারণার অভিযোগে দেশে প্রথম আলোচিত কোম্পানি ইভ্যালি। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছ থেকে অন্তত ১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পণ্য সরবরাহ না করার তথ্য দিয়েছে র্যাব।

র‌্যাবর লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র‌্যাবর জিজ্ঞাসাবাদে ইভ্যালির সিইও মো. রাসেল জানিয়েছেন, তার দেনা এখন হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ কোম্পানিটি কোন ব্যবসায়িক লাভ করতে পারেনি। গ্রাহকের অর্থ দিয়েই যাবতীয় ব্যয় ও খরচ নির্বাহ করায় দেনা বেড়েছে। ইভ্যালির বিভিন্ন ব্যাংক এ্যাকাউন্টে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ টাকা রয়েছে। এছাড়া কয়েকটি গেটওয়েতে গ্রাহকের ৩০-৩৫ কোটি টাকা আটক হয়ে আছে, ওই অর্থ কোম্পানির নয়।

সমপ্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক হাফিজুর রহমানের দপ্তরে ইভ্যালির পাঠানো চিঠিতে দেখা যায়, গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির চলতি দায় ৫৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে মার্চেন্ট বা পণ্য সরবরাহকারীরাই পাবেন ২০৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। আর গ্রাহকদের পাওনা ৩১১ কোটি টাকা। এ রকম আরো দুটি প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ ও ধামাকা শপিংয়ের বিরুদ্ধেও একই রকম অভিযোগ ওঠে। ই-অরেঞ্জের শীর্ষ পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রাজধানীর শিল্পাঞ্চল থানায় ৬৬৩ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা হয়। আবার প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ৩৭ গ্রাহকের পক্ষে গত ১৬ আগস্ট ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা করেন তাহেরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি।

সিআইডির অনুসন্ধানে দেখা যায়, ‘ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড’ এর নামে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে গত বছরের অক্টোবরে ‘ধামাকা শপিং’ নামে ই-কমার্স ব্যবসা চালু করে প্রতিষ্ঠানটি। স্বল্পমূল্যে মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটরসহ নানা পণ্যের প্রলোভন দেখিয়ে তিন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে ৮০৩ কোটি ৫১ লাখ ৯১ হাজার ৩৬৩ টাকা নেয়া হয়। শুরুতে কিছু গ্রাহককে পণ্য দিলেও পরে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া প্রায় ৬০০ সরবরাহকারীর অন্তত ২০০ কোটি টাকার পণ্য নিয়েও কোনো মূল্য পরিশোধ করেনি। 

গত সপ্তাহে ইনভেরিয়েন্ট টেলিকমের এমডিসহ ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করে সিআইডি। এসপিসি ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধেও ই-কমার্সের আড়ালে মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণ পেয়ে মামলা করেছে সিআইডি। কিউকম অনলাইন শপিং মলের বিরুদ্ধে মোটরসাইকেলের বাম্পার অফার দিয়ে বিপুল পরিমাণে অর্থ সংগ্রহ করে পণ্য না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সাইক্লোন, ডাবল ভাউচার, সিগনেচার কার্ড, বিগ বিলিয়ন রিটার্নসসহ চটকদার নানা অফার দিয়ে গ্রাহককে লোভে ফেলেছে এসব প্রতারক প্রতিষ্ঠান। ৫০০ টাকার গ্রসারি পণ্যে ১০-১৫ শতাংশ ছাড় দিলেও দ্রুত অর্থ সংগ্রহে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, ফার্নিচারের মতো দামি পণ্যে দেওয়া হয়েছে ৭০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়। অল্প সময়ে অস্বাভাবিক লাভের আশায় মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। সঞ্চয় ভেঙে টাকা জমা দিয়েছে ই-কর্মাস প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে। হাতে গোনা কিছু মানুষ পণ্য বা টাকা ফেরত পেলেও অধিকাংশ ক্রেতাই হয়েছেন প্রতারিত।

এ ব্যাপারে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ইক্যাবের ভূমিকা জানতে চাইলে সংগঠনটির সহসভাপতি মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন বলেন, আমরা আগে থেকেই অভিযুক্ত ১৭টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করছিলাম। সমপ্রতি আরো ৯টি যোগ হয়েছে। এগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কেউ কেউ সময় চেয়েছে গ্রাহকের টাকা ফেরত বা পণ্য সরবরাহের জন্য। আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছি। ইতোমধ্যে আমরা ই-অরেঞ্জ, ২৪টিকেট.কম, গ্রিনবাংলা ও এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড এগ্রোফুড এ্যান্ড কনজুমার লিমিটেডের সদস্য পদ স্থগিত করেছি। তবে আমরা শুধু সতর্ক করা, সদস্যপদ স্থগিত বা বাতিল করতে পারি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, নীতিমালা করা হয়েছে। তবে এটা কেউ অমান্য করছে কিনা সেটা নজরদারি করা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে কঠিন। এ জন্য ই-ক্যাবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নেব। এ ছাড়া মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি দেখবে দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!