• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

নীরবে-নিভৃতে হতাশা কুড়ে খাচ্ছে পোশাক শ্রমিকদের 


এম.এস. রুকন, গাজীপুর নভেম্বর ১৪, ২০২৩, ১১:২৪ এএম
নীরবে-নিভৃতে হতাশা কুড়ে খাচ্ছে পোশাক শ্রমিকদের 

ফাইল ছবি

গাজীপুর: দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল ও বৈদেশিক রেমিট্যান্স উৎপাদনের অন্যতম প্রাণ কেন্দ্র তৈরি পোশাক শিল্প। তবে এত বড় গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর হওয়া স্বত্বেও এ শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত লাখ-লাখ পোশাক শ্রমিকদের মনের ভিতরে নীরবে-নিভৃতে হতাশা কুড়ে-কুড়ে খাচ্ছে।

সরেজমিনে, সোমবার (১৩ নভেম্বর) দিনব্যাপী দেশের সর্ববৃহৎ শিল্পাঞ্চল গাজীপুরের অর্ধশতাধিক পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে সোনালীনিউজ এর প্রতিনিধি এ অদৃশ্য তথ্য জানতে পেরেছে। 

গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের পোশাক শ্রমিককেরা জানিয়েছেন, তাদের পোশাক শ্রমিকদের জন্য সরকার প্রতি পাঁচ বছর পরপর নতুন মজুরি ঘোষণা করেন। এর দ্বারা বাহিকতায় এবারও চলতি মাসে পোশাক শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি ঘোষণা করেছে। তবে মজুরি ঘোষণার পূর্বে থেকেই পোশাক শ্রমিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। যদি বর্তমান দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতি বিবেচনা করে নতুন মজুরি বাড়ানো না হয়। অর্থাৎ শ্রমিকদের দাবি, ২৫ হাজার বেতন না করা হয়। তাহলে এই নতুন মজুরি মানবেনা পোশাক শিল্প কারখানার শ্রমিককেরা। 

শ্রমিকদের ভাষ্যমতে, পোশাক শিল্প কারখানার মালিক পক্ষ ও সরকারের মজুরি বোর্ড শ্রমিক ফেডারেশন ও শ্রমিকদের সেই করা উপেক্ষা করে তারা একটা বাস্তবহীন বেতন বৃদ্ধি করে নতুন মজুরি ঘোষণা করেছে। 

পোশাক শ্রমিকরা বলছেন, এই মজুরি ঘোষণার তিন ঘন্টার মধ্যে গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের পোশাক শ্রমিককদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তারা ঘোষিত নতুন মজুরি প্রত্যাখান এবং সময় উপযোগী ২৫ হাজার টাকা বেতন করার দাবিতে রাজপথে উত্তাল শ্রমিক বিক্ষোভ আন্দোলন গড়ে তুলেন গাজীপুরের কোনাবাড়ী ও মৌচাক শিল্প এলাকার পোশাক শ্রমিককেরা। 

এর পর আন্দোলনের দাবানল পুরো গাজীপুর শিল্পাঞ্চল ছাড়িয়ে আশেপাশের শিল্পাঞ্চল গুলোতেও একই দাবিতে তীব্র আন্দোলন শুরু করে শ্রমিকরা। 

এই আন্দোলন চলাকালীন সময়ে এক পর্যায়ে পোশাক শ্রমিক-পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। এ সময়ে অন্তত তিন জন শ্রমিককের মৃত্যু হয়েছে। 

পুলিশ ও শ্রমিকদের তথ্যে জানা গেছে, সর্বশেষ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে করা বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ পোশাক শ্রমিক মো: জামাল উদ্দিন (৪০) মারা গেছেন। গাজীপুরের কোনাবাড়ীর জরুন এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।

শনিবার (১১ নভেম্বর) দিনগত রাত একটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জামাল উদ্দিন।

এক দিকে শত-শত শ্রমিকরা আহত হয়ে বিছানা পড়ে আছে। অন্যদিকে চিকিৎসার অর্থ জোগান দিতে পারছে অনেক পরিবার। এই যখন অবস্থা চলছে পোশাক শিল্পে জড়িত শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থা। তখন কারখানা মালিকরা ঘোষণা দিয়েছেন কোন কারখানায় নতুন কোন শ্রমিক নিয়োগ দিবেন না। আন্দোলনকারী শ্রমিকদের মতে, এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, মরার উপরে খাড়ার গাঁ। চলমান বেতন বাড়ানোর আন্দোলনে জড়িত শত-শত পোশাক শ্রমিকরা। যদি কোন কৌশলে এসব আন্দোলনকারী শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত কিংবা ছাটাই করা হয়। তাহলে আর কর্মে যোগদান করতে পারবেন না। 

তখন বেকার হয়ে হন্যেহয়ে ঘোরে বেড়াতে হবে। পরিবার পরিজন নিয়ে চলা যাবেনা। ছেলে মেয়ের পড়া লেখার খরচ যোগাতে না পারায় বন্ধ হয়ে যেতে পারে শিক্ষা কার্যক্রম। এছাড়াও পরিবারের কেউ হঠাৎ গুরুত্ব অসুস্থ হলেও তাকে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা বন্ধ হয়ে যাবে। এ ধরনের নানা প্রকার ক্ষতির দিক বিবেচনা করে বিশাল হতাশয় নিমজ্জিত গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের পোশাক শ্রমিকরা। দুশ্চিন্তা শ্রমিকদের এতটাই জেকে বসেছে নীরবে-নিভৃতে হতাশা কুড়ে-কুড়ে খাচ্ছে পোশাক শ্রমিকদের। 

গাজীপুরের অন্যতম শিল্প কারখানা গ্রুপ ডিবিএল, গ্রুপের শ্রমিক সোহান মিয়া, পলমল গ্রুপের মিন্টু, রেনেসাঁ গ্রুপের আতিকুর রহমান, উর্মি গ্রুপের সজল এবং মেট্টো গ্রুপের সবুজ হোসেন বলেন, আমরা মনে করে ছিলাম মালিকেরা অনেক দক্ষ ও বুদ্ধি মান। তারা যৌক্তিক ভাবে ৭ নভেম্বর বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব মজুরি বোর্ডে উপস্থাপন করবেন। 

কিন্তু আমরা বাস্তবে কি দেখলাম রক্ত চোষার মতো বেইনসাফ করলেন তারা। মনগড়া একটা বেতন প্রস্তাব করলেন এবং সরকারও তাদের সেই প্রস্তাবকে সমর্থন করলেন। যার কারণে শুধু গাজীপুর শিল্পাঞ্চল জুড়েই না সারা দেশেই শিল্পাঞ্চল গুলোতে বেতন বাড়ানোর দাবিতে তীব্র আন্দোলন শুরু হলো। আমাদের এই আন্দোলনে কখনো যেতে হতো না। যদি যৌক্তিক বেতন বাড়ানোর হইতো। শ্রমিকরা বলছেন, এখন আন্দোলন করে আমরা কি পেলাম নিজেরা নিজেকে প্রশ্ন করি। এক পেলাম গুলি, মামলা, হয়রানি আর অকালে হারাইলাম কয়েকজন প্রিয় সহকারী শ্রমিক। 

স্বাধীন গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশরেনর কেন্দ্রীয় সভাপতি মো: শাকিল আহমেদ বলেন, আমরা আশাবাদী হয়ে উঠে ছিলাম। আমরা ভেবে ছিলাম ৭ নভেম্বর মজুরি বোর্ডের সভায় যে বেতন প্রস্তাব মালিকেরা করবেন। এটা সময় উপযোগী হবে এবং শ্রমিকরা মেনে নিবে। কিন্তু দেখতে পেলাম মালিকদের বিবেকহীন নীতি। যার কারণে আজ গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা অর্ধশত সমস্যার বেড়া কলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। 

তিনি আরও বলেন, আরেকটা বিষয় গেল কয়েক দিনের শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে যে শ্রমিক নিহত হয়েছে। তাদের জন্য শোক প্রকাশ করছি এবং যারা আহত হয়েছে তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছি। তিনি বলেন, এই মহূর্তে এ বিষয়ও বড় হয়েছে দাঁড়িয়েছে। মামলা ও আহত শ্রমিকদের নিয়ে কি করতে চান। এ ব্যাপারেও মালিককেরা একটা ঘোষণা দিবেন শ্রমিকরা আশাবাদী।  

তিনি বলেন, নিহত শ্রমিক পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতি পূরণ এবং যারা আহত হয়েছে তাদেরকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা কারখানা মালিকদের দায়িত্ব। এই শ্রমিক নেতা আরও বলেন, আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। অনেকেই পোশাক শ্রমিকদের ইন্ধন দিয়ে পোশাক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে। আমরা এ ব্যাপারে শ্রমিকদের সচেতন করছি। 

সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের টঙ্গী আঞ্চলিক কমিটির সংগঠক শেখ রুবেল বলেন, আমরা ভেবে ছিলাম ৭ নভেম্বর মজুরি বোর্ডের সভায়। সুন্দর একটি বেতন প্রস্তাব করবেন মালিকেরা। কিন্তু আমাদের সেই আত্মবিশ্বাসের  ধারণা ও চিন্তা ভূল প্রমাণ করে দিয়েছেন তারা  নীতি বিহীন বেতন প্রস্তাব করার মধ্য দিয়ে। তিনি বলেন, যাই হোক আমরা আর মরতে চাই না। বেতন নাই বা বাড়ুক শ্রমিকরা বেঁচে থাকতে চায়। তাই কারখানা মালিকদের প্রতি অনুরোধ আপনারা আর শ্রমিকদের গুলি করাবেন না। শ্রমিকদের নামে নামে -বেনামে মিথ্যা হয়রানি মূলক মামলা দিয়ে হয়রানির করাবেন না। 

তিনি আরও বলেন, সাধারণ শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে বেতন বাড়ানোর জন্য স্লোগান দিয়েছে। তারা কোন ভাংচুর জ্বালাও পুড়াও করেনি। যারা করেছে তারা বহিরাগত। তিনি বলেন, আমাদের সংগঠনের কোনো নেতৃবৃন্দ চলমান পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনে জড়িত নয়।  

এ দিকে জানা যায়, পোশাক শ্রমিকের মজুরি বাড়ানোকে কেন্দ্র করে গাজীপুরে ১২৩টি কারখানায় কমবেশি ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালানো হয়েছে। বিভিন্ন থানায় দায়েরকৃত ২২টি মামলায় এ পর্যন্ত ৮৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। 

এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শিল্প পুলিশের ডিআইজি মো: জাকির হোসেন খান। সোনালীনিউজের প্রতিনিধি ডিআইজির কাছে জানতে চায়। এত সংখ্যক মামলা হয়েছে নামে-বেনামে কয়েক হাজার পোশাক শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে। এ নিয়ে শ্রমিকরা অনেক গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। পরে ডিআইজি বলেন, এখানে কোন দুশ্চিন্তার কারণ নেই। যারা দু'শ কৃতি কারী এবং সরাসরি ভাংচুরের সঙ্গে জড়িত কেবল তাদেরকেই ধরা হবে। 

গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলনের এ পরিস্থিতিতে জেলার পুলিশ প্রশাসনও অনেক বিপাকে পড়েছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার মো:মাহবুব আলম বলেছেন, আমরা শোনেছি ৭ নভেম্বর মজুরি বোর্ডের সভায় পোশাক শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ১২ হাজার টাকা করা হয়েছে এবং ইতিমধ্যে এটা গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে সরকার। এখন যাতে আর কেউ উসকানি দিয়ে শ্রমিক অসন্তুষ্ট ছড়িয়ে দিতে পারে সেদিকে পুলিশ সতর্ক রয়েছে। তিনি আরও বলেন, শ্রমিক অসন্তাষ সৃষ্টির পেছনে শ্রমিকদের ইন্ধন দেওয়ার একটি মহল রয়েছে। এ তথ্য পাওয়ার পর পুলিশ ইন্ধনদাতাদের খুঁজছে।

বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, ৭ নভেম্বর মজুরি বোর্ডের সভায় নির্ধারিত যে বেতন বাড়ানোর হয়েছে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকেই নতুন কাঠামোয় মজুরি দেওয়া হবে। ফলে এখন কোন ধরনের আন্দোলন, সহিংসতা ও ভাঙচুর অগ্রহণযোগ্য। এগুলো কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশ ও শিল্পের স্বার্থে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা প্রয়োগ করবেন পোশাক মালিকরা।

তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে কারখানার নিরাপত্তার স্বার্থে অনেক কারখানার মালিকরা উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। এটা কারো জন্যই মঙ্গল জনক নয়। 

উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে সরকার আন্দোলনের মধ্যেও পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২৫০০ টাকা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। 

গেজেটের তথ্য অনুযায়ী, গ্রেড-১ এর শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হবে ১৪ হাজার ৭৫০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি আট হাজার ২০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া চার হাজার ১০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৪৫০ টাকা এবং খাদ্য ভাতা এক হাজার ২৫০ টাকা।

গ্রেড-২-এর শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হবে ১৪ হাজার ১৫০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি সাত হাজার ৮০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া তিন হাজার ৯০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৪৫০ টাকা এবং খাদ্য ভাতা এক হাজার ২৫০ টাকা।

গ্রেড-৩-এর শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হবে ১৩ হাজার ৫৫০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি সাত হাজার ৪০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া তিন হাজার ৭০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৪৫০ টাকা এবং খাদ্য ভাতা এক হাজার ২৫০ টাকা।

গ্রেড-৪-এর শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হবে ১৩ হাজার ২৫ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি সাত হাজার ৫০ টাকা, বাড়ি ভাড়া তিন হাজার ৫২৫ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৪৫০ টাকা এবং খাদ্য ভাতা এক হাজার ২৫০ টাকা।

একইভাবে গ্রেড-৫-এর শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি হবে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি ছয় হাজার ৭০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া তিন হাজার ৩৫০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৪৫০ টাকা এবং খাদ্য ভাতা এক হাজার ২৫০ টাকা।

সোনালীনিউজ/এমএস/এসআই

Wordbridge School
Link copied!