• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
আজ নোয়াখালী মুক্ত দিবস 

হানাদারদের নির্মমতার স্বাক্ষী বধ্যভূমি ৪৮ বছরেও সংরক্ষণ হয়নি


নোয়াখালী প্রতিনিধি ডিসেম্বর ৭, ২০১৯, ১২:৫৭ পিএম
হানাদারদের নির্মমতার স্বাক্ষী বধ্যভূমি ৪৮ বছরেও সংরক্ষণ হয়নি

নোয়াখালী : নোয়াখালী মুক্ত দিবস আজ। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর এই দিনে বৃহত্তর নোয়াখালী সম্পূর্ণ ভাবে হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। মুক্তিসেনারা এইদিন জেলা শহরের পিটিআই’তে রাজাকারদের প্রধান ঘাঁটির পতন ঘটিয়ে নোয়াখালীর মাটিতে উড়িয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় পতাকা। দীর্ঘ ৪৮ বছর শেষ হলেও নোয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে হানাদারদের নির্মমতার স্বাক্ষী বধ্যভূমি অদ্যাবধি সংরক্ষণ হয়নি। 

এনিয়ে নোয়াখালী মুক্ত দিবস এলে বধ্যভূমি সংরক্ষণের কথা সর্বস্তরের মানুষের মনে পড়ে। বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য কমিটি গঠিত হলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। জেলা মুক্তিযোদ্ধা সাংসদ এ বিষয়ে তালিকা নিয়ে মন্ত্রনালয়ে পাঠালেও অদ্যাবধি তার কোন খোঁজ খবর মেলেনি। 

নোয়াখালী জেলার তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডার মেজর হায়দার ও বিএলএফ প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েতের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনী ৩ নভেম্বর রাতে নোয়াখালী অঞ্চল মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। 

৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ আমাদের সি জোনের গুপ্ত চরের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারে পাক্ হানাদার বাহিনী জেলা শহর মাইজদীতে খুবই দ্রুত মুভমেন্ট করছে। 

তাৎক্ষণিক সি জোনের রাজনৈতিক প্রধান আলী আহম্মদ চৌধুরীসহ কমান্ডাররা এক জরুরী বৈঠকে পাক্্ বাহিনী ও রাজাকারদের উপর আক্রমন করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। 

পরিকল্পনা অনুযায়ি নোয়াখালী জেলার তৎকালীন মহকুমা শহর ফেনী ও লক্ষীপুরে আক্রমন শুরু হয়। ৪ ডিসেম্বর মহকুমা শহর গুলো মুক্ত হওয়ার পর জেলা শহর মাইজদীকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধারা। 

ওই দিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানী বাহিনী জেলা শহর ছেড়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে চলে যাওয়ার পথে বিপুলাসারও নাথেরপেটুয়া নামক স্থানে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। সেখানে ব্যাপক যুদ্ধের পর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন করে।

৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা রাত ২টার মধ্যে নোয়াখালী মাইজদী শহর মুক্ত করার জন্য নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নিয়ে নির্দেশ মোতাবেক কাজ করে শুরু করে। 

ওই দিন সন্ধ্যায় তৎকালিন নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মনজুরুল করিম এর কাছে পরদিন নোয়াখালী আক্রমন ও পাক বাহিনী, রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমন সংবাদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট খায়ের আহম্মদ, রফিক উল্যাহ্ মিয়া যায়। 

নির্দেশ মোতাবেক ডিসি পুলিশ বাহিনীকে ৭ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্ম সর্মপনের বিষয়ে নির্দেশ দেয়। লাইনের সমস্থ পুলিশ বাহিনী সকালেই আত্মসর্মপন করে। 

৬ ডিসেম্বর নোয়াখালী মুক্ত দিবসে বিএলএফ কমান্ডার মাহমুদুর রহমান বেলায়েত এবং ডি জোনের কমান্ডার রফিক উল্যাহ তাদের বাহিনীসহ এমএফ, বিএলএফ, এফএফ সবাই একত্রে নোয়াখালী জেলা শহরের বিভিন্ন জায়গায় আক্রমন চালায়।

এসময় সকাল ১০টার মধ্যে পিটিআই ছাড়া মাইজদী ভোকেশনাল, নাহার মঞ্জিল, কোর্ট ষ্টেশন, রৌশন বাণী সিনেমা হল, দত্তেরহাট, কোল্ড ষ্টোরিজসহ রাজাকার ক্যাম্প সবাই আত্মসর্মপন করে।

এদিকে গ্রামাঞ্চলের ক্যাম্পগুলো থেকে শহর এলাকার রাজাকার এসে জড়ো হতে থাকে।  তারা মূলত পিটিআই কে শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তোলে।

সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধাদের ১২টি গ্রুপ একত্রিত হয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় রাজাকার ও পাক বাহিনীর সর্বশেষ ও সবচেয়ে বড় ঘাঁটি হেড কোয়াটার পিটিআই মধ্যে দিঘীর উত্তর পাড়ে হোস্টেলে আক্রমণ চালায়। 

এতে সকলে আত্মসর্মপন করে। এসময় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিল্ডিং বিধ্বংসী বোমা ছিল না বলে তারা ফেনী থেকে  ২য়  মোটার নিয়ে আসে। কিন্তু পিটিআই ক্যাম্প আক্রমন করতে গিয়ে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ।

দু’দিন তুমুল যুদ্ধ শেষে ৭ডিসেম্বর নোয়াখালী জেলার শেষ শত্রু ঘাঁটি পিটিআই ক্যাম্পের পতন ঘটে। 

পিটিআই মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে নোয়াখালী হানাদার মুক্ত করেন। এরপর একটি আনন্দ মিছিল বের হয় সরকারি আবাসিক থেকে হাসপাতাল সড়ক হয়ে পৌর ভবনের সামনে আসলে পিটিআই ক্যাম্প থেকে রাজাকাররা মিছিলের উপর ব্রাশ ফায়ার করে।

সেখানে শহীদ হয় নোয়াখালী কলেজের ৬জনমেধাবী ছাত্র । হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আরো ৩জন মুক্তিযোদ্ধা। 

নোয়াখালী মুক্ত হলেও আজ শহীদ মুক্তি গণহত্যার নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের বধ্যভূমি সংরক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়নি।

বধ্যভূমি সংরক্ষণের বিষয়ে নোয়াখালী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার মোজাম্মেল হক মিলন জানান,‘ মুক্তিযুদ্ধের ৯মাসে নোয়াখালীর বিভিন্ন স্থানে রাজাকার পাক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে অত্যাচার করে হত্যা করে। 
বেগমগঞ্জের গোপালপুর বধ্যভূমি, সোনাপুর,শ্রীপুর ও মহব্বতপুর বধ্যভূমি, বেগমগঞ্জ কালাপোল বধ্যভূমি, চৌমুহনী দীঘির পাড় বধ্যভূমি  কালীবাবুর গ্যারেজ বধ্যভূমি, সদর হাসপাতাল বধ্যভূমি, বেগমগঞ্জের আবীরপাড়া বধ্যভূমি, রশীদপুর, নাওতলা, সোনাইমুড়ি, বেগমগঞ্জের বাট্টাগ্রাম বধ্যভূমিতে কয়েক হাজার লোককে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া।

সেনাবাহিনীর একটি দল নোয়াখালীর এসকল বধ্যভূমি দেখে গিয়েছেন। এগুলো সংরক্ষণ করার জন্য কমিটিও করেছিল। পরে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। 
মুক্তি যুদ্ধকালিন ‘সি জোন’ কমান্ডার মো. মোশারেফ হোসেন জানান,‘ যে জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি সে লক্ষ্য আজও অর্জিত হয়নি। আজ মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। অবিলম্বে নোয়াখালীতে শহীদের বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার আহবান জানান’।

মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহস ও বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৫জানুয়ারি ১৯৭৩সালে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ৬৭৬জন মুক্তিযোদ্ধাকে খেতাব দেয়া হয়। তার মধ্যে নোয়াখালী জেলার ৩৭জন। একজন বীরশ্রেষ্ঠ, চারজন বীর উত্তম, ১৩জন বীর বিক্রম ও ১৯জন বীর প্রতীকও রয়েছে।

ইতিহাসে এদিনকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে মাইজদী পিটিআই এর সম্মুখে স্থাপিত হয়েছে নোয়াখালী মুক্ত দিবসের স্মৃতি স্মারক একটি মুক্ত মঞ্চ তৈরি করা হয়।

এদিকে মুক্ত দিবস উপলক্ষে আজ শুক্রবার মাইজদি পিটিআই সংলগ্ন মঞ্চে দিনব্যাপী জেলা প্রশাসন, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ইউনিট ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদের উদ্যোগে মুক্ত মঞ্চে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিজয় র‌্যালির আয়োজন করা হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এমআইএস/এএস

Wordbridge School
Link copied!