• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
রানা প্লাজা ধসের পাঁচ বছর

ঘুরে দাঁড়িয়েছে পোশাক শিল্প


নিজস্ব প্রতিবেদক এপ্রিল ২৫, ২০১৮, ১২:১২ এএম
ঘুরে দাঁড়িয়েছে পোশাক শিল্প

ঢাকা : গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার দামালপুর গ্রামের আফরোজা খাতুন। কাজ করতেন সাভারের রানা প্লাজায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায়। জীবিকার তাগিদ আর ভবন মালিকের চাপে ঢুকেছিলেন ফাটল ধরা ভবনে। কারখানা চালু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ধসে পড়ে ভবনটি। দুই দিন পর তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন হাসপাতালে। মারাত্মক আহত এ পোশাক শ্রমিক আর কাজে ফিরতে পারেননি। এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন সাভারের পক্ষাঘাত পুনর্বাসন কেন্দ্রে (সিআরপি)। সেই ট্র্যাজেডির পর কেটে গেছে পাঁচ বছর। এ সময়ের মধ্যে আফরোজা খাতুনদের জীবনের অন্ধকার দূর না হলেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের পোশাক শিল্প।

উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১২ সালের শেষের দিকে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক প্রাণহানির ঘটনায় সঙ্কটে পড়ে দেশের পোশাক শিল্প। পরের বছরের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে হাজারেরও বেশি শ্রমিক নিহত হলে পোশাক শিল্পে নেমে আসে মহাবিপর্যয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ থেকে রফতানি আদেশ প্রত্যাহার করে নেয় কয়েকটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্র স্থগিত করে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি)। তবে বিদেশি ক্রেতাদের তাগিদ ও চাপ এবং নিজেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছে পোশাক শিল্প। নিরাপত্তার পাশাপাশি নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর প্রথম চাপ আসে সাব কন্ট্রাক্টে কাজ করা ছোট কারখানাগুলোর ওপর। এ সময়ে প্রায় আড়াইশ’ ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়ে লক্ষাধিক শ্রমিক। এর ধারাবাহিকতায় ছোট ও মাঝারিমানের কারখানা থেকে রফতানি আদেশ প্রত্যাহার শুরু হয়। ক্রেতা ধরে রাখতে ৬৭ শতাংশ কারখানায় অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করা হয়।

তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ইএবির প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, এ মুহূর্তে কাজের পরিবেশ ও শ্রমমান উন্নয়নের বিষয়টি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কমপ্লায়েন্সের বিভিন্ন শর্ত পূরণ করাটা অনেক ব্যয়বহুল। পরিদর্শনে ভবন দুর্বল প্রমাণিত হলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

বিজিএমইএর সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর উদ্যোক্তাদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। এর ফলে উন্নত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। বাংলাদেশ এখন সবুজ শিল্পায়নে অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছে। লিড সার্টিফাইড ১০টি কারখানার মধ্যে ৭টির অবস্থান বাংলাদেশে। ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল থেকে দেশের ৬৭ কারখানা লিড সনদ পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৩টি প্লাটিনাম কারখানা। আরো ২৮০টি কারখানা সনদ পাওয়ার পাইপলাইনে আছে।

এ বিষয়ে শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, হাজারখানেক শ্রমিকের জীবনের বিনিময়ে দেশের পোশাক শিল্প এক ধাপ এগিয়েছে। তবে এতে মালিকপক্ষই লাভবান হচ্ছেন। বিদেশি ক্রেতাদের কাছে দেশের পোশাক শিল্পের ইতিবাচক অবস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। তবে এ খাতের উন্নতি ধরে রাখতে কয়েক লাখ শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। এ সময়ে ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো হলেও অনেক কারখানা ওভারটাইম দিচ্ছে না।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে পোশাক রফতানিতে ৯ দশমিক ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে আয় হয়েছে ২ হাজার ২৮৩ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। এ সময়ে দেশের মোট রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৪৫ কোটি ১৫ লাখ ডলারে। এ হিসাবে মোট রফতানির ৮৩ দশমিক ১৮ শতাংশ এসেছে পোশাক শিল্পের হাত ধরে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে পোশাক রফতানিতে আয় ছিল ২ হাজার ৯২ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। ৯ মাসে আয় বেড়েছে ১৯০ কোটি ৫৬ লাখ ডলার।

ইপিবি কর্মকর্তা ও পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের বড় দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ নেতারা জানিয়েছেন, প্রতিযোগী অন্যান্য দেশও এ সময়ে অনেক এগিয়েছে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে ভারত, চীন ও পাকিস্তানে রফতানিকারকদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও শ্রীলঙ্কার উদ্যোক্তারা কম সুদে ঋণ পাচ্ছেন।

বিপরীত ধারায় বাংলাদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের চাপে অবকাঠামো সংস্কারে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে এখনো কিছু ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।

জানা যায়, ব্যবসায় মুনাফার কথা বিবেচনা করেই আশির দশকে বাংলাদেশে আসেন বিদেশি ক্রেতারা। প্রথমবার মাত্র ১২ হাজার ডলারের পোশাক রফতানি হলেও গত অর্থবছর এ খাতে আয় হয়েছে ২ হাজার ৮১৪ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। অবশ্য গতবার পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্র পূরণ হয়নি। ৩ হাজার ৩৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২২২ কোটি ৯২ লাখ ডলার কম আয় হয়েছিল। গত অর্থবছর পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ২২ শতাংশ। ১৯৮১ সালে মোট রফতানি আয়ের দশমিক ১ শতাংশ আসত পোশাক শিল্পের হাত ধরে। বর্তমানে রফতানি আয়ের ৮৩ শতাংশের বেশি আসছে এ খাত থেকে।

বাধা অর্থ সঙ্কট : বিদেশি ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পরিদর্শনে চিহ্নিত পোশাক কারখানাগুলোর সংস্কার কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অর্থ সঙ্কটে। একই ভবনে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদ্যমান কারখানা স্থানান্তর জরুরি হয়ে পড়েছে। এসব শর্ত পূরণে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পক্ষে এ অর্থের জোগান দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন পোশাক শিল্প খাতের মালিকরা।

রয়েছে অনেক উদ্যোগ : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে আইএলওর সহায়তায় প্রণয়ন করা হয় ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান। এ বিষয়ে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ ও আঞ্চলিক সংস্থা। জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ও বিশ্বব্যাংকের সহায়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) স্বল্প সুদে ঋণ দেয়। একই সময়ে আইএলও ও আইএফসি যৌথভাবে প্রণয়ন করে বেটার ওয়ার্ক কর্মসূচি। এসব কিছুর প্রভাবে পোশাক খাতে অবকাঠামোগত পরিবর্তন শুরু হয়।

এ সময়ে বাংলাদেশের পোশাক কারখানা পরিদর্শন করতে ইউরোপভিত্তিক ক্রেতারা গঠন করে অ্যাকর্ড অন বিল্ডিং অ্যান্ড ফায়ার সেফটি ইন বাংলাদেশ নামের প্ল্যাটফরম। আর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রেতারা গঠন করেন অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি। এ দুটি জোট বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করে ত্রুটি চিহ্নিত এবং তা সংস্কারের সুপারিশ করেছে। সে অনুযায়ী কাজও এগিয়ে চলছে।

সামনে উজ্জ্বল দিন : বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এতদিনে রৌদ্রোজ্জ্বল। দুর্নামের পরও মূলত কম দামে পোশাক সরবরাহ করায় ক্রেতারা সরে যায়নি। বরং আরো আগ্রহী হয়ে উঠছে দিন দিন। আর স্বল্প দামে পোশাক উৎপাদনের পেছনে রয়েছে কম বেতনে শ্রমিক প্রাপ্তির নিশ্চয়তা।

অবশ্য পোশাক খাতের উন্নতি হলেও এর সুফল মালিকদের পকেটে যাচ্ছে বলে মনে করেন গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু। বাংলাদেশের খবরকে তিনি বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর শ্রমিক নিপীড়ন আরো বেড়েছে। বেতন বোনাসসহ ন্যায্য পাওনা চাইলেই নেমে এসেছে নির্যাতন। মালিক, সরকারদলীয় সংগঠন ও কিছু এনজিও নিজেদের পছন্দে নামেমাত্র ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করেছে। এসব ইউনিয়ন শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ ভূমিকা রাখতে পারছে না।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ১ হাজার ১৩৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। নিহতদের অধিকাংশই ওই ভবনের পাঁচ কারখানার শ্রমিক। এ ঘটনায় ২ হাজারের বেশি আহত হয়েছিলেন। আজ রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে মালিক ও শ্রমিক পক্ষ।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!