• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চালের বাজার পর্যবেক্ষণে নেই সরকারি উদ্যোগ


শেখ আবু তালেব, জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জুলাই ২৩, ২০১৭, ১২:২৩ পিএম
চালের বাজার পর্যবেক্ষণে নেই সরকারি উদ্যোগ

ঢাকা: হাওর অঞ্চলে আকস্মিক বন্যায় নষ্ট হয়েছে ধান। খাদ্যমন্ত্রীর দেয়া হিসাবে পুরো দেশে যে পরিমাণ ধান উৎপাদিত হয়ে তার মাত্র ৩ শতাংশ আসে হাওর থেকে। এই তিন শতাংশ ধান নষ্ট হওয়ার প্রভাবে চালের বাজার এতো চড়া হওয়ার কোনো কারণ খুজেঁ পায়নি সরকার ও বিশ্লেষকরা। কিন্তু হঠাৎ করেই চালের বাজারে লেগেছে আগুন। স্বল্প আয়ের মানুষের ভরসা মোটা চালের দামই বেড়েছে ১৪ টাকার বেশি। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চালের বাজারের গতি পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রেণে আগ্রহ নেই সরকারি সংস্থাগুলোর।

গত এক বছরে চালের দাম হয়েছে দ্বিগুনের বেশি। আর দশ বছরে বেড়েছে আড়াইগুনের বেশি। মুল্যস্ফীতির সরকারি হিসাবে যা দেড়গুনের কাছাকাছি থাকার কথা। ব্যবসায়ীদের মতে, চালের বাজার পর্যবেক্ষণে সরকারের আগ্রহ কম। চাল যত না কম, তার চেয়ে বেশি রয়েছে সিন্ডিকেটের প্রভাব।

চাল নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ মজুদ না থাকার সুযোগ নিয়েছে ব্যাবসায়ী সিন্ডিকেট। এজন্য হঠাৎ করেই বাজারে মোটা চালের দাম গত দেড় মাসে কেজি প্রতি ১৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে বড় চালের আড়ৎ বাদামতলী ও বাবুবাজারে বিভিন্ন প্রকারের বস্তা প্রতি (৫০ কেজি) মোটা চালের দাম বেড়েছে ৬০০ টাকা ও সরু চালের দাম বস্তা প্রতি বেড়েছে ৬৫০ টাকা পর্যন্ত। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল ৩৮ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০, ৫১ ও ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন ব্রান্ডের চিকন চাল ৫০ টাকার বদলে বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকা কেজি প্রতি।

বাজারে নতুন চাল আসার পরেও দাম কমেনি সেভাবে। বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার সমর্থক কয়েকটি সিন্ডিকেট। অতিরিক্ত মুনাফা করতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগ-সাজশ করে বিভিন্ন জায়গায় ধানের মজুদ করেছে তারা। কৃষকের গোলায় না থাকায় মিলাররা পর্যন্ত ধান পাচ্ছেন না। কৃত্রিম সংকটে ৮০০ টাকা মনের ধান মিলাররা কিনছেন ১১৫০ টাকায়। সংশ্লিষ্ঠরা বলছেন, দলীয় সমর্থক হওতায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাজার পর্যবেক্ষণ করছে না সরকারি কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টন। চলতি অর্থবছরের ৪ জুন পর্যন্ত সরকারিভাবে ৩.৯৩ লাখ মেট্রক টন ও বেসরকারিভাবে ৫০.০৫ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আমদানি করেছে সরকার। চলতি অর্থবছরে সরকার মে মাস পর্যন্ত ১.১৫ লাখ টন চাল আমদানি করেছে। সর্বশেষ সরকারি গুদামে চালের মজুদ রয়েছে এক লাখ ৯১ হাজার মেট্টিক টন। যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

সিন্ডিকেটের কবলে চালের বাজার : গতবছরও এ চক্রটি সক্রিয় ছিল। সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের আগে কৃত্রিম সংকট করে দাম বাড়িয়েছিল। পরবর্তীতে সরকারকেও বেশি দামে ধান সংগ্রহ করতে বাধ্য করেছে চক্রটি। সরকার ঘোষণা দিয়েছিল বেশি দামে ধান কেনায় কৃষকরা লাভবান হবে। বাস্তবে দেখা গিয়েছে, সিন্ডিকেটের দেয়া স্লিপ ছাড়া একটি চালও গুদামে ঢুকেনি। এবারো চাল নিয়ে সেই কূট কৌশলই করে তারা। চালের সংকট দেখিয়ে আরো বেশি মুনাফা করেছে চক্রটি।

সূত্র জানিয়েছে, এবার এ চক্রটি প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে এবার। সরকারের গুদামে চাল না থাকার সংকটকে কাজে লাগিয়েছে চক্রটি। পরে সরকার চাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয়ার পরে আমাদানি হওয়ার আগেই কেজি প্রতি ২ টাকা কমে গিয়েছে। এবছর সরকার প্রতি কেজি ধান ২৪ টাকা ও প্রতি কেজি চাল ৩৪ টাকা দরে কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ী ও চাল মিল মালিকরা দাবি জানিয়েছেন, চালের মূল্য প্রতি কেজিতে অন্ত ৩৬ টাকা দিতে হবে।

কারওয়ান বাজারের চালের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, চালের দাম সরকার চাইলেই কমাতে পারে। একটা সিন্ডিকেট পুরো দেশের চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে গুদামে মজুদ করেছে এই সিন্ডিকেটটি। এখন মিলাররা চাল বানাতে ধান পাচ্ছেন না। এ সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে পারলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় চাল সরবরাহকারী জেলা নওগাঁ রাইস মিল মালিকদের সংগঠনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, ধানের দাম বেড়েছে। প্রতি হাটে লোক পাঠাচ্ছি বেশি দাম দিলেও ধানের যোগান কম। ৮০০ টাকা মনের ধান এখন ১১৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আমরা কেজি প্রতি ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা লাভ করেই চাল ছেড়ে দেই। এখন ধানের দাম বাড়ায় বেশি দামে চাল দিতে হচ্ছে। ধানের দাম কেন বাড়ছে, এর উত্তরে তিনি বলেন, সেটা খাদ্য মন্ত্রণালয় ও সরকার বলতে পারবে।

চালের দাম বেশি নিয়ে সরকারের অসহায়ত্বের কথা ফুটে উঠে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর কথায়। তিনি বলেন, আমাদের দেশপ্রেমের ঘাটতি রয়েছে। কিছু ব্যবসায়ী সুযোগ পেলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। এদের বিরুদ্ধে আইন করা দরকার। আমরা আইন না থাকলে সরকার কিছুই করতে পারে না।

দশ বছরে দাম আড়াইগুণ : দশ বছরের পাঁচ ধরনের চালের দাম নিয়ে তথ্য বিশ্লেষণ করেছে ভোক্তা অথিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংস্থাটির গবেষণা বলছে, ১০ বছর আগে বাজারের সবচেয়ে কম দামি চাল ছিল বিআর ১১/৮। ২০০৬ সালে প্রতি কেজি বি আর ১১/৮ চাল বিক্রি হয়েছিল ১৮ টাকা ২৫ পয়সায়, যার দাম গত বছর ছিল ৩৫ টাকা ৪১ পয়সা। এখন সেই চাল গত মাসে বিক্রি হয়েছে কেজি প্রতি ৩৮-৪০ টাকা দরে। প্রতি কেজি স্বর্ণা ও পারিজা চাল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা, বিআরআটাশ ও ঊনত্রিশ ৪৩-৪৪ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল। মিনিকেট এক নম্বর ৫২ থেকে ৫৪ টাকা, নাজিরশাইল ৫০ থেকে ৫২ টাকা, দেশি বাসমতি ৫৮ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এক মাসের ব্যবধানেই সকল প্রকার মোটা চাল ৫০ টাকা ও চিকন চাল ৫৯-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে তিনটি সরকার ছিল। ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। ওই সময়ে চালের দাম যা ছিল গত ১০ বছরে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকেই বাড়তে থাকে চালের দাম। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় বসলে বর্ধিত দামের চেয়ে পাঁচ ধরনের চালের দাম কিছুটা কমে যায়। কিন্তু বছর খানেক পরেই দ্রু বাড়তে থাকে। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পরে ক্ষমতা নেয়ার সারে তিন বছর শেষে এখন বেড়েছে সব ধরনের চালের দাম।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি ভাষ্যে মুল্যস্ফীতি গত বছর ধরেই ছয় শতাংশের নিচে ছিল। যা বতমানে সাড়ে পাঁচ শতাংশ। সে হিসাবে ১৯ টাকার চাল সর্বোচ্চ ২৭-২৮ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে আড়াইগুন বেশি দরে ৫২ টাকায়। গত কয়েক বছর দেশে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়নি। চালের উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। চালের প্রচুর মজুদ থাকার কথা। হরতাল বা অন্য কোনো কারণে পরিবহনেও সমস্যা হয়নি। তবু চালের দাম বাড়ছেই। গত দশ বছরে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। চালের দাম বাড়ার পিছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি থাকার কথা স্বীকার করেছেন চালকল মিল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কেএম লায়েক আলী। গত ১ জুন খাদ্যমন্ত্রীর সাথে বৈঠকশেষে সাংবাদিকদের বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে চালের দাম বাড়াতে পারে। তবে মিলারদের কাছে চালের কোনো মজুদ নেই।

প্রয়োজন অভিযান : কৃষক, মিল মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে কারা কৃত্রিমভাবে চালের দাম বাড়াচ্ছে তা দেখতে সরকারের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে বাজার পর্যক্ষেণ করা দরকার। চালের সরবরাহ, চাহিদা, উৎপাদন ও খরচ কোন পর্যায়ে কেমন হচ্ছে তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার দাবি করেছেন বিশ্লেষকরা। একইসঙ্গে তারা মনে করছেন, সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে পারলেই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এতে জনগণ যেমন উপকৃত হবে, তেমনি সরকারের ইমেজও ঠিক থাকবে বলেই তারা মনে করছেন।

সোনালীনিউজ/তালেব

Wordbridge School
Link copied!