• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী যত ঈদগাহ


নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ১৭, ২০১৮, ১১:৪৪ এএম
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী যত ঈদগাহ

ঢাকা : ঈদগাহ ইসলামী সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত প্রসিদ্ধ একটি শব্দ। যা দিয়ে ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার নামাজ আদায়ের জন্য খোলা আকাশের নিচে বড় ময়দানকে বোঝানো হয়। সুন্নত অনুযায়ী ঈদের দিন সকালে মুসলমানরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে, সাধ্যমতো নতুন পোশাক পরে ঈদগাহে জমায়েত হন। ঈদের নামাজ মসজিদে পড়লেও হবে কিন্তু ঈদগাহে নামাজ পড়া সুন্নত। ঈদের মাঠে জমায়েত হওয়ার মাধ্যমে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি পায়।

বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশের মতো বাংলাদেশেও অনেক ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহ রয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী ঈদগাহগুলোর পরিচিতি এবং কখন কোথায় ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয় তার সময়সূচি নিয়ে আজকের আয়োজন-

গোর-এ-শহীদ বড় ময়দানের ঈদগাহ, দিনাজপুর

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহটি দিনাজপুরের গোর-এ-শহীদ বড় ময়দানের ঈদগাহ। গত বছর ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়ার মধ্য দিয়ে এই ঈদগাহটি উদ্বোধন হয়েছে। এর কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। ঈদগাহটি তৈরি করা হয়েছে মোগল স্থাপত্যরীতিতে। মেহরাবের উচ্চতা ৫৫ ফুট। ৫২ গম্বুজবিশিষ্ট এই ঈদগাহে রয়েছে দুটি মিনার, যাদের প্রতিটির উচ্চতা ৬০ ফুট। মাঝের গেট দুটি ৪৭ ফুট করে চওড়া। এতে খিলান আছে ৩২টি। ঈদগাহ তৈরিতে রড, সিমেন্ট, বালু ছাড়াও সিরামিক টাইলস ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি গম্বুজে আছে বৈদ্যুতিক সংযোগ। সন্ধ্যার পর থেকেই মিনারে আলো ঝলমল করে ওঠে। ঈদগাহটি পরিকল্পনা ও অর্থায়ন করেছেন দিনাজপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম। ইসলামী ভাবগাম্ভীর্যে সমৃদ্ধ ইরাকের মসজিদে নববি, কুয়েত, ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের স্থাপনার আদলে এর আকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই ঈদগাহ নির্মাণে প্রায় কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এই ঈদগাহে ৭ লাখ মুসলি­ একসঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে পারবেন। ২০১৭ সালে গোর-ই শহীদ ময়দানে ঈদের প্রথম জামাতে প্রায় চার লাখ লোকের সমাগম হয়।

কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঈদগাহে একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন দেড়লাখ থেকে দুই লাখ। তবে এখন মাঠের বাইরে রাস্তাঘাটে, বাড়িঘরের উঠানেও জামাত হয়। তাতে তিন লাখ পর্যন্ত লোক সমাগম হয়। শোলাকিয়া ঈদগাহের আয়তন সাত একর। অন্যদিকে দিনাজপুর গোর-ই শহীদ বড় ময়দানের আয়তন সাড়ে ১৪ একর, প্রায় দ্বিগুণ। সে হিসাবে এটি অবশ্যই দেশের সবচেয়ে বড় ঈদগাহ। তবে একসঙ্গে কত লোক ঈদের নামাজ পড়বে তা-ই এবার দেখার বিষয়। এবার দিনাজপুরে এ ঈদগাহের দিকে নজর থাকবে সবার। এ ঈদগাহের এক পাশে রয়েছে তেভাগা আন্দোলনের কৃষক নেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশের সমাধিস্থল। এই ইদগাহে ঈদের নামাজ সকাল ৮টায় অনুষ্ঠিত হয়।  

শোলাকিয়া ঈদগাহ, কিশোরগঞ্জ

উপমহাদেশের বিখ্যাত শোলাকিয়া ঈদগাহটি নির্মাণ করেছিলেন সুফি সৈয়দ আহমেদ। ইসলামের ঐশী বাণী প্রচারের জন্য সুদূর ইয়েমেন থেকে আগত সুফি সৈয়দ আহমেদ তার নিজস্ব তালুকে ১৮২৮ সালে নরসুন্দা নদীর তীরে ঈদের জামাতের আয়োজন করেন। ওই জামাতে তিনি নিজেই ইমামতি করেছিলেন।

অনেকের মতে, সেদিনের জামাতে প্রায় সোয়া লাখ লোকের জমায়েত হয়। ফলে এর নাম হয় ‘সোয়া লাখি’। পরে উচ্চারণের বিবর্তনে শোলাকিয়া নামটি প্রচলিত হয়ে যায়। ১৯৫০ সালে স্থানীয় দেওয়ান মান্নান দাদ খাঁ এই ময়দানকে অতিরিক্ত ৪.৩৫ একর জমি দান করেন। কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে নরসুন্দর নদীর তীরে এ ঈদগাহ ময়দানটি অবস্থিত। এই ঈদগাহটি আজ বাংলাদেশেরই একটি গৌরব ও ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ ছুটে যান এখানে শুধু একসঙ্গে বৃহৎ একটি জামাতে অংশ নিতে।

বর্তমানে এখানে একসঙ্গে তিন লক্ষাধিক মুসলি­ জামাতে নামাজ আদায় করতে পারেন। নামাজ শুরুর আগে শর্টগানের ফাঁকা গুলির শব্দে সবাইকে নামাজের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সঙ্কেত দেওয়া হয়। মূল ঈদগাহটি সাত একর জায়গায়। মাঠে ২৬৫ সারির প্রতিটিতে ৫০০ করে মুসলি­ দাঁড়ানোর ব্যবস্থা আছে। ফলে মাঠের ভেতর সব মিলিয়ে এক লাখ বত্রিশ হাজার ৫০০ মুসলি­ নামাজ আদায় করতে পারেন।

তবে ঈদুল ফিতরের সময় দেখা যায়, আশপাশের সড়ক, খোলা জায়গা, এমনকি বাড়ির উঠানেও নামাজ আদায় করেন মুসলি­রা। এভাবে সর্বমোট প্রায় তিন লাখ মুসলি­ ঈদের নামাজ পড়ে থাকেন। মুসলি­র এই সংখ্যা প্রতিবছর বেড়ে চলেছে। শোলাকিয়া ঈদগাহর ব্যবস্থাপনার জন্য ৫১ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি রয়েছে। ঈদের নামাজের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ড এই কমিটি করে।  বর্তমানে শোলাকিয়ার পূর্বপ্রান্তে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে।

এই ঈদগাহ মাঠটি চারপাশে উঁচু দেওয়াল ঘেরা হলেও মাঝেমধ্যেই ফাঁকা রাখা হয়েছে যেন মানুষ মাঠে প্রবেশ ও বের হতে পারে। এর পশ্চিম সীমারেখা উত্তর-দক্ষিণে ৩৩৫ ফুট এবং পূর্ব সীমারেখা উত্তর-দক্ষিণে ৩১৪ ফুট এবং উত্তর সীমারেখা পূর্ব-পশ্চিমে ৭৮৮ ফুট ও দক্ষিণ সীমারেখা পূর্ব-পশ্চিমে ৯৪১ ফুট দীর্ঘ। মাঠের ভেতরে পশ্চিম দিকের শেষ প্রান্তে রয়েছে একটি ছোট মসজিদ। এটির দোতলায় বসে ঈদের জামাতে দোয়া পরিচালনা করেন ইমাম।

মিনার সংস্কার, মাঠে প্রবেশের প্রধান তোরণ নির্মাণ, ৪৫টি ওজুখানা, ১৫টি প্রস্রাবখানা ও পাঁচটি টয়লেট নির্মাণ এবং মাঠের মিম্বরটি সংস্কার করা হয়। ঐতিহ্যবাহী এই ঈদগাহে ঈদের প্রধান নামাজের জামাত সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয়।  

জাতীয় ঈদগাহ, ঢাকা

স্বাধীনতার আগে থেকেই হাইকোর্টের পাশের জায়গাটি ছিল ঝোপ জঙ্গলে পূর্ণ। সেই জায়গায় একটি পুকুরও ছিল। ১৯৮১-৮২ সালের দিকে ঝোপ-জঙ্গল কিছুটা পরিষ্কার করা হয়। হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে রয়েছে একটি মাজার। সেই মাজারে ওরসের আয়োজন হতো ওই পুকুর পারে। সেই সূত্রে জায়গাটি একটু পরিচিত হয়ে উঠলে সেখানে ছোট পরিসরে শামিয়ানা টাঙিয়ে ঈদের নামাজ পড়ানো শুরু হয়। ১৯৮৫ সালের দিকে পুকুরটি ভরাট করে ফেলে কর্তৃপক্ষ। পরে ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে ওই ঈদগাহকে জাতীয় ঈদগাহ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। বর্তমানে বাংলাদেশ হাইকোর্টের অধীন ঈদগাহটি পরিচালিত হলেও তার দেখভাল করে গণপূর্ত বিভাগ।

২০০০ সালে দুই ঈদেই ঈদগাহ প্রস্তুতের দায়িত্ব পায় ঢাকা সিটি করপোরেশন। এখন সেই দায়িত্ব পালন করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। চারদিকে লোহার প্রাচীর দেওয়া বিশাল মাঠটিতে রয়েছে একটি মূল ফটকসহ কয়েকটি ফটক। কেবলার দিকে রয়েছে একটি মেহরাব। মেহরাবটি মূলত পাঁচটি মিনারে তৈরি। জাতীয় ঈদগাহে একটি জামাতে অন্তত একলাখ মুসলি­ একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে। সেখানে একই জামাতে নারীদের নামাজ আদায়ের জন্য থাকে ভিন্ন ব্যবস্থা থাকে। প্রায় ২০ হাজার নারী একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে। ঈদের দিন রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারীরা এখানে নামাজ পড়তে আসে। এই ইদগাহে ঈদের নামাজ সকাল সাড়ে ৮টায় অনুষ্ঠিত হয়।  

মোগল ঈদগাহ, ধানমন্ডি

১৬১০ সালে সুবে বাংলার রাজধানী হয় ঢাকা। সুবেদারের বাসস্থান এবং অন্য রাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যালয়ও ছিল এখানে। যুক্তিযুক্তভাবেই ঢাকায় তখন মোগলদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছিল বেশ। সেই সময় তাদের জন্য বাংলাদেশের প্রাচীন ঈদগাহটি তৈরি হয়েছিল ঢাকার ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার সাতমসজিদ রোডে। বাংলার সুবেদার শাহ সুজার প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম ১৬৪০ সালে এটি তৈরি করেন। সেই আমলে ঈদের দিন এই ঈদগাহটিতে শুধু মোগলরাই যেতেন। সাধারণ মানুষের স্থান সেখানে হতো না। সুবেদার, নাজিম ও অন্য মোগল কর্মকর্তারা নামাজ পড়তেন এখানে।

ইংরেজ আমলে জরাজীর্ণ ও জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় ছিল ঈদগাহটি। মুনশী তায়েশের বর্ণনা থেকে জানা যায়, উনিশ শতকের শেষের দিকে শহরের মুসলমানরা এখানে ঈদের নামাজ পড়ত, সেই সঙ্গে আয়োজন করা হতো মেলা। এই ঈদগাহটিতেও বাংলাদেশের অন্য মোগল স্থাপত্যগুলোর মতো পোড়ামাটির ইট ব্যবহার করা হয়েছে। বন্যা বা বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য চার ফুট ভূমি উঁচু করে ঈদগাহটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এজন্য ধানমন্ডির ঈদগাহটি মাটি থেকে চার ফুট উঁচু একটি সমতল ভূমিতে অবস্থিত। এর দৈর্ঘ্য ২৪৫ ফুট, প্রস্থ ১৩৭ ফুট। পশ্চিমে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর, যেখানে রয়েছে মিহরাব ও মিম্বর। এই অংশটিই মোগল আমলের। বাংলাদেশের প্রত্বতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৮ সালে সংস্কারের সময় অন্য তিন দিকের প্রাচীর নতুন করে তৈরি করেছে। চার কোণে রয়েছে অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ।

পশ্চিম প্রাচীরের মাঝ বরাবর প্রধান মেহরাব। আরো দুটি ছোট আকারের মেহরাব আছে এর দুই পাশে। প্রধান মেহরাবটি অষ্টকোনাকৃতির। ভেতরের দিকে খানিকটা ঢালু খিলান আকৃতির। মেহরাবগুলো দেয়ালের আয়তাকার ফ্রেমের ভেতরে অবস্থিত। এই ঈদগাহে ঈদের নামাজ সকাল ৮টায়।  

জমিয়তুল ফালাহ ঈদগাহ ময়দান, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম মহানগরীর ওয়াসা মোড় এলাকায় রয়েছে জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ। এই মসজিদের সামনে বিশাল মাঠ। এই মাঠেই দুই ঈদের জামাত হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন প্রতিবছর দুই ঈদের সময় চট্টগ্রামজুড়ে কোন মসজিদ বা মাঠে কখন ঈদ জামাত হবে এমন একটি তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকায় জমিয়তুল ফালাহ ঈদগাহ মাঠের সময়সূচি থাকে সবার আগে। কয়েক যুগ ধরে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাত এই মাঠেই হয়ে থাকে।

ঈদের দিন এই ময়দানে চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের মিলনমেলা বসে। চারপাশে সীমানাপ্রাচীর আছে মাঠজুড়ে। এই মাঠটি ২০১৩ সালে ঢালাই করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। বিগত চার-পাঁচ বছর আগেও বিশালাকৃতির এই মাঠজুড়ে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মাঠের অর্ধেকাংশজুড়ে নির্মাণসামগ্রীর স্ত‚প করা হয়েছে। টিন দিয়ে বাকি অর্ধেক মাঠ ঘিরে রাখা হয়েছে। এসবের মধ্যেই এখন ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এই ইদগাহে ঈদের প্রধান জামাত সকাল ৮টায় অনুষ্ঠিত হয়।  

শাহ মখদুম ঈদগাহ ময়দান, রাজশাহী

রাজশাহী শহরের দরগাহপাড়ায় অবস্থিত হজরত শাহ মখদুম (রহ.)-এর মাজার শরিফ থেকে কয়েকশ’ গজ পশ্চিমে গড়ে উঠেছে এই ঈদগাহ ময়দান। দরগাহ এস্টেট কার্যালয়ের তথ্যমতে, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরপরই রাজশাহীর তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল মজিদ সিএসপি, সাব ডেপুটি কালেক্টর আবদুল করিম চৌধুরী, রাজশাহী জেলা পরিষদের প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমান প্রমুখের উদ্যোগে রাজশাহী নগরীর কেন্দ্রস্থল পদ্মার তীর ঘেঁষে রাজশাহী হজরত শাহ মখদুম (রহ.) কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রাথমিকভাবে এই ঈদগাহ ময়দানটি চার ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। পরে এই প্রাচীর ভগ্নপ্রায় হয়ে পড়লে দরগাহ এস্টেট পরিচালনা কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান ও রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো. আবদুস সালাম ১৯৮৫ সালে সেটি ভেঙে ফেলে সাত ফুট উঁচু একটি নতুন বেষ্টনী প্রাচীর তৈরি করেন। ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর উদ্যোগে ঈদগাহ ময়দানের ভূমি উঁচু ও সমতল করা হয়। এরপর আধুনিক স্থাপত্যের পাঁচ ফুট উঁচু বেষ্টনী প্রাচীর নির্মাণ করা হয়, যা আজো বিদ্যমান। ইট, বালু, সিমেন্ট আর রড দিয়ে নান্দনিকভাবে তৈরি ঈদগাহ মাঠের এই বেষ্টনী প্রাচীরে অসংখ্য ছোট পিলার রয়েছে।

ঈদগাহ ময়দানের চারদিকে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ছয়টি প্রবেশপথ। ঈদগাহ ময়দানটির দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারে আধুনিক কারুকার্যে নির্মিত হয়েছে ছোট্ট একটি মসজিদ। পাশেই রয়েছে অজুখানা। ২০১৩ সালে তৎকালীন মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন পদ্মা নদীর শহররক্ষা বাঁধকে সোজা করে এই ঈদগাহ মাঠের আয়তন দ্বিগুণ করেন। এখন এটির আয়তন দৈর্ঘ্যে ৪০০ ফুট এবং প্রস্থে ৪০০ ফুট। ওই বছরই মাঠে নতুন একটি মেহরাব তৈরি করা হয়। সেখানেই বর্তমানে ঈদের জামাত পড়ানো হয়। এই ঈদগাহে ঈদের নামাজ সকাল ৯টায়। একটি জামাত অনুষ্ঠিত হয়।

শাহী ঈদগাহ, সিলেট

সপ্তদশ শতাব্দীতে দিলি­র মসনদে বসেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। তার শাসনামলে (১৬৫৯-১৭০৭) সিলেটে মোগল ফৌজদার হিসেবে নিয়োগ পান ফরহাদ খাঁ। এই ঈদগাহ নির্মাণে তিনি উদ্যোগী হন। সরাসরি তার তত্ত্বাবধানে মোগল স্থাপত্যরীতিতে এই ঈদগাহের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। সিলেট শহরের ব্যস্ততম আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে টিলাগড়মুখী সড়কের মাঝামাঝি এই স্থাপনার অবস্থান। স্থাপনার নামানুসারে পুরো এলাকাই এখন শাহী ঈদগাহ এলাকা নামে পরিচিত। ছোট একটি টিলার ওপর ঈদগাহের মূল অংশের অবস্থান। সবুজে ঘেরা বিশাল ঈদগাহ প্রাঙ্গণের চারদিক সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। অভ্যন্তর প্রবেশের জন্য প্রাচীরের চারদিকে সব মিলিয়ে রয়েছে তিনটি বিশালাকার তোরণ এবং আটটি ছোট প্রবেশ পথ।

ভেতরেই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন শান বাঁধানো পুকুর, নানা জাতের গাছপালা। ঈদগাহের বিশাল ময়দান থেকে মূল অংশে যেতে বিশাল আকারের ২২টি সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করতে হয়। তারপর দেখা মিলবে পশ্চিম প্রাচীরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত কেন্দ্রীয় মেহরাবের। মেহরাবটি অর্ধ গম্বুজের আকৃতিতে নির্মিত। প্রধান মিহরাবকে কেন্দ্র করে দুই পাশে আরো ১৪টি সহকারী মেহরাব রয়েছে। মেহরাবগুলো অষ্টভুজাকৃতির বুরুজের ওপর ছত্রী দ্বারা আচ্ছাদিত। স্থাপনার পুরোটাই নকশাখচিত।

পরবর্তী সময়ে মোগল স্থাপত্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক স্থাপত্যও। ২০০২ সালে ঈদগাহের তিনদিকে তিনটি বিশাল তোরণ নির্মাণ করা হয়। মোগল স্থাপত্যকলাকে ভাবনায় রেখে তোরণগুলোর নকশা করা হয়। এরপর ২০১৩ সালে ঈদগাহের পশ্চিম-উত্তর প্রান্তে সুউচ্চ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০০ ফুট উচ্চতার এই সুদৃশ্য মিনারে মোগল আমল আর চলমান সময়ের স্থাপত্যকলাকে এক সূত্রে গাঁথার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনধাপে তৈরি মিনারটি এক হাজার ৬০ বর্গফুট ভ‚মিজুড়ে অবস্থিত। এই ঈদগাহে ঈদের প্রধান জামাত সকাল ৯টায় অনুষ্ঠিত হবে।   

কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ, সাভার  

প্রতিবছরই সাভারে ঈদের প্রধান জামাত ভাগলপুর এলাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এ ঈদগাহ মাঠে প্রায় কয়েক হাজার মুসলি­ একসঙ্গে ঈদের জামাতে অংশ নিতে পারেন। ঈদগাহ প্রাঙ্গণে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা থাকলে ঈদগাহ মাঠে ত্রিপলের ব্যবস্থা করা হয়। এ বছর পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপনে সাভার কেন্দ্রীয় ঈদ জামাত অনুষ্ঠানের জন্য ঈদগাহ ময়দান প্রস্তুতির কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। জামাত অনুষ্ঠিত হবে সকাল সাড়ে ৮টায়। এই জামাতে পৌর এলাকার প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার মুসলি­ অংশ নিয়ে থাকে। এই ময়দানে ১টি জামাত অনুষ্ঠিত হয়। সাভার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন। এই ঈদগাহ মাঠ ছাড়াও সাভার অধরচন্দ্র স্কুলমাঠ প্রাঙ্গণ ও বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় কয়েক দফায় ঈদের নামাজ আদায় করতে পারবেন মুসলি­রা।

ঢাকার অদূরের এই ঈদগাহটি বৃহত্তর ঈদের জামাত অনুষ্ঠানস্থল হিসেবে ইতিমধ্যে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। গুঠিয়া মসজিদ ঈদগাহ মাঠ, বরিশাল বরিশালের গুঠিয়া মসজিদ ঈদগাহ মাঠে একসঙ্গে প্রায় ২০ হাজার মানুষ ঈদের নামাজ পড়তে পারে। ২০০৬ সালে এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম জামে মসজিদ বাইতুল আমান বা গুঠিয়া মসজিদ প্রাঙ্গণে ঈদগাহের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বরিশাল শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে উজিরপুর থানার গুটিয়া ইউনিয়ানের চাংগুরিয়া গ্রামে এই ঈদগাহ অবস্থিত।

২০০৩ সালে ১৪ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত গুঠিয়া মসজিদের বিশাল একটি অংশে ওই ঈদগাহটি নির্মাণ করা হয়। উজিরপুরের গুঠিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা শিক্ষানুরাগী এস সরফুদ্দিন আহম্মেদ সান্টু চাংগুরিয়ার নিজবাড়ির সামনে ব্যক্তিগতভাবে গুঠিয়া বাইতুল আমান জামে মসজিদ-ঈদগাহ্ কমপ্লেক্সের নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করেন।

মসজিদ কমপ্লেক্সের ভেতরে একটি বৃহৎ মসজিদ-মিনার, ২০ হাজার অধিক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ঈদগাহ ময়দান, এতিমখানা, একটি ডাকবাংলো, গাড়ি পার্কিংব্যবস্থা, লেক-পুকুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের বাগান রয়েছে। কমপ্লেক্সের মূল প্রবেশ পথের ডানে বড় পুকুর। পুকুরের পশ্চিম দিকে মসজিদ, একসঙ্গে প্রায় দেড় হাজার মুসলি­ নামাজ পড়তে পারে। মসজিদ লাগোয়া মিনারটির উচ্চতা ১৯৩ ফুট। ঈদগার প্রবেশ পথের দুই ধারে দুটি ফোয়ারা আছে।  

প্রতিদিন হাজারো দর্শনার্থী গুঠিয়া মসজিদ দেখতে এবং নামাজ পড়তে যান। এখানে জমজম কূপের পানিসহ কাবা শরিফ, আরাফাত ময়দান, জাবালে নূর, জাবালে রহমত, নবীজির জন্মস্থান, মা হাওয়ার কবরস্থান, খলিফাদেররস্থান, মসজিদে রহমতসহ বিখ্যাত মসজিদ এবং বিখ্যাত জায়গাসমূহের মাটি সংরক্ষণ করা আছে। এই ইদগাহে সকাল ৯টায় বৃহত্ত কবর ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।

বড় ঈদগাহ ময়দান, কক্সবাজার

কক্সবাজার জেলার প্রধান ঈদের নামাজের জামাত হবে কক্সবাজার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে। এই ঈদগাহ ময়দানে একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করবে ২০ হাজার মানুষ। প্রতিবছরই এই ঈদগাহ জামাতের আয়োজন করে কক্সবাজার পৌরসভা। ২০ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতা বিবেচনা করে প্রায় ৫৫ হাজার বর্গফুটের এই ময়দানটির পুরো অংশ নামাজের জন্য প্রস্তুত করা হয়। পুরো ময়দানকে শামিয়ানা দিয়ে প্যান্ডেল আকারে ঢেকে দেওয়া হয়। শামিয়ানার কাপড়ের ওপর বৃষ্টি নিরোধক ত্রিপলও টাঙানো হয়। কক্সবাজারবাসীর দীর্ঘদিনের ইচ্ছা আর দাবি ছিল একটি বড় ঈদগাহ ময়দানের। যেখানে হবে পর্যটন জেলার বৃহত্তর ঈদ জামাত। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে ঈদগাহ ময়দানের কাজ শুরু হয়। মেহরাব নির্মাণের মধ্য দিয়ে এই কাজের উদ্বোধন করা হয়।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!