• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হাজারো বেকারের স্বপ্নভঙ্গ


নিজস্ব প্রতিবেদক নভেম্বর ২৪, ২০২০, ১২:৫৫ পিএম
হাজারো বেকারের স্বপ্নভঙ্গ

ঢাকা : তরিকুল ইসলাম একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মাস্টার্স শেষ করেছেন ২০১৯ সালে। সারা জীবনের স্বপ্ন একটা সরকারি চাকরি। পড়াশোনাও করছেন বেশ জোরেশোরে। কিন্তু বিসিএসসহ সব চাকরির নিয়োগ এখন থেমে আছে করোনার কারণে। তাই তিনিও এখন পুরোপুরি বেকার।

তরিকুলের ন্যায় আদনান মোহাম্মদ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছর আগে অনার্স শেষ করেছেন। এখনো কোনো চাকরি পাননি। লকডাউনের মধ্যে তাই অনলাইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবসা শুরু করেন। শুরুটা বেশ ভালোই ছিল। তবে লকডাউন উঠে গেলেই বদলে যায় সে চিত্র। তাই বাধ্য হয়েই ব্যবসা গুটিয়ে নেন। এখন তিনিও পুরোপুরি বেকার।

শুধু কি তরিকুল-আদান? করোনায় চাকরির স্বপ্নভঙ্গ হাজারো শিক্ষিত বেকার যুবকের। এর বাইরে যেসব শিক্ষার্থী বা গ্র্যাজুয়েটরা টিউশনি করে চলতেন তারাও লকডাউনের মধ্যে প্রায় পুরোপুরি বেকার।

সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষণায় (২০১৯ সাল) উঠে আসে, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত।

বিআইডিএসের জরিপ অনুযায়ী, শিক্ষা শেষে এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত বেকার ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ, দুই বছরের চেয়ে বেশি সময় ধরে বেকার ১৮ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত বেকার ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। করোনাকালে এই চিত্র আরো ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, লকডাউনের সময় বেকারের হার দশ গুণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘কোভিড-১৯ বাংলাদেশ : জীবিকার ওপর অভিঘাত ধারণা জরিপ-২০২০’-এর প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সে হিসাবে সদ্য পড়ালেখা শেষ করা যুবকদের প্রায় সবাই করোনাকালে বেকার হয়ে পড়েছিল।

সবাই উদ্যোক্তা হতে চায় : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাকরি না পাওয়ার হতাশা এবং পরিস্থিতি কত দিনে স্বাভাবিক হবে সেই অনিশ্চয়তার কারণে তরুণ-তরুণীদের বিরাট অংশ ব্যবসায় উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং করছেন। এই উদ্যোগগুলোর প্রায় সবই অনলাইননির্ভর। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, ফেসবুকনির্ভর। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা না থাকার কারণে উদ্যোগগুলোর প্রায় সবই মুখ থুবড়ে পড়ছে। ফেসবুকে এখন নামে-বেনামে হাজার হাজার গ্রুপ তৈরি হয়েছে ব্যবসা করার জন্য। এমনই একটি গ্রুপ ‘মি’।

‘মি’-এর প্রতিষ্ঠাতা গার্মেন্টস ব্যবসায়ী রুবেল হোসেন বলছিলেন, ‘আমাদের গ্রুপটি শুরু করার দুই মাসের মাথায় এর সদস্যসংখ্যা ১০ হাজারে পৌঁছে। সবাই বিভিন্ন দেশিপণ্য নিয়ে উদ্যোক্তা হতে চায়। কিন্তু সমস্যা হলো কারোরই ব্যবসা করার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, পরিকল্পনায়ও ঘাটতি আছে। এ কারণে শুরুর পরই মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যবসা। গ্রুপটি প্রায় এক বছর আগে খোলা হয়। এই ১০ হাজার সদস্যের মধ্যে ১০ জনও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারেননি।

দেশে অনলাইনে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রারম্ভিক পর্যায়ে লাইসেন্স নেওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই করোনাকালে মোট কতজন নতুন করে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করেছেন, তার হিসাব পাওয়া যায় না। তবে এই সংখ্যাটা যে বিশাল, তা বোঝা যায় অন্য একটি পরিসংখ্যানে।

ফেসবুকে একটি জনপ্রিয় ব্যবসায়ী গ্রুপ ‘উই’। গ্রুপটির সদস্যদের সবাই উদ্যোক্তা। বর্তমানে সদস্যসংখ্যা ১১ লাখ! এই গ্রুপের মাধ্যমে অনেকেই ব্যবসায় সাফল্য পেয়েছেন। এনিয়ে অনেক সাফল্যের গল্পও গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। তবে এর অন্য একটি দিক বলছিলেন শামিয়া আক্তার মিম।

গ্রুপটির এই প্রবীণ সদস্য বলছিলেন, ‘গ্রুপে সদস্যসংখ্যা ১১ লাখ। কিন্তু ১১০০ জনও ব্যবসায় সাফল্য পেয়েছে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আমার পরিচিত অন্তত ৫০ জন এই গ্রুপের মাধ্যমে ব্যবসা করতে এসেছিলেন। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা আর ব্যবসায়িক আইডিয়া না থাকায় তারা ঝরে পড়েছেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘মূল উই’-র সদস্যসংখ্যা ১১ লাখ। কিন্তু নকল উই-র সংখ্যাও দশের বেশি। এর প্রতিটিতেই সদস্যসংখ্যা ৫০ হাজারের ওপরে। এগুলো আমাদের দেশেরই উদ্যোক্তা হতে চাওয়া তরুণদের সৃষ্টি।’

বিরাট সংখ্যক এখন বোঝা : অনার্সপড়ুয়া বা শেষ করে চাকরি না পাওয়া যুবকদের একটি বিরাট সংখ্যা টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করত। এরা স্বনির্ভর হয়ে নিজের জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত। কিন্তু করোনার কারণে এদের প্রায় সবাই পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় তারা পরিবারের বোঝা হয়ে জীবনযাপন করছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আমান তারেক বলছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় ছাড়া তিন বছরে পরিবার থেকে আর কোনো টাকা নিইনি। টিউশনি করে, কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে চলতাম। কিন্তু গত ৯ মাস বাসায় বসে রয়েছি। কোনো আয়-রোজগার করতে পারছি না। নিজেকে নিজের কাছে বোঝা মনে হচ্ছে।’

সবকিছুই অনিশ্চিত : করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে সবখানেই অনিশ্চয়তা রয়েছে। কবে নাগাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হতে পারে বা আবারো লকডাউন শুরু হতে পারে কি-না, তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।

সরকার প্রাথমিক স্তরে সাড়ে ৩২ হাজার শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মার্চ মাসের মধ্যেই এই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির ওপর বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম।

এর বাইরে ৩৯তম থেকে ৪১তম পর্যন্ত তিনটি বিসিএস আটকে আছে। ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষাই নেওয়া সম্ভব হয়নি। এর মধ্যেই আবার আগামী মাসে ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

 

Wordbridge School
Link copied!