• ঢাকা
  • রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

৭ কোটি খেয়ে পরিচালক বিদেশে


বিশেষ প্রতিনিধি নভেম্বর ১৩, ২০২৪, ০১:০৪ পিএম
৭ কোটি খেয়ে পরিচালক বিদেশে

ঢাকা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ‘ইলেকট্রনিক ডেটা ট্র্যাকিংসহ জনসংখ্যাভিত্তিক জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার নির্ণয় কর্মসূচি’ প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে প্রকল্পের ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই পরিচালক প্রকল্পে কর্মরত ৬৯ চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ও পরিচালক প্রশাসনে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি প্রকল্পে কর্মরতরা। উল্টো প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনোলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগ থেকে কর্মরতদের চাকরিচ্যুতির হুমকি দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে প্রকল্পে কর্মরতরা গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করে প্রকল্পের অনিয়ম তুলে ধরেন এবং এ ঘটনার বিচার দাবি করেছেন।

প্রকল্পের কাগজপত্র থেকে জানা গেছে, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৮ সালে বিএসএমএমইউ কর্র্তৃপক্ষ এই প্রকল্প চালু করে। প্রকল্পের পরিচালক হন গাইনোলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা।

২০২১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সারা দেশে জরায়ুমুখ ও স্তন ক্যানসার নির্ণয় ও চিকিৎসা দেন। পরে প্রথমে দুই দফা ও সর্বশেষ ২০২৪-২৫ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে ৬০১টি স্ক্রিনিং কেন্দ্র স্থাপন ও ৫০ লক্ষাধিক নারীকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে।

প্রকল্পে ৬৯ জন চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিক, প্রকৌশলীসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী আউটসোর্সিং হিসেবে কাজ করছেন।

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসাকে পাওয়া যায়নি। তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের ব্যাপারে হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার রেজাউর রহমান বলেন, ‘এই ব্যাপারটা আশরাফুন্নেসা ম্যাডাম ও ট্রেজারার অফিস বলতে পারবে। পরিচালক হাসপাতাল অফিসের কোথাও কোনো আর্থিক সংশ্লিষ্টতা নেই। এটার উত্তর আমার কাছে নেই।

তবে আমি মনে করি, তিনি যদি অনিয়ম করেই থাকেন, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্যু। কর্মরতরা যদি মনে করেন, তারা কোনো কারণে আর্থিকভাবে বঞ্চিত হয়েছেন, তাহলে নিশ্চয় তদন্ত কমিটি অনিয়ম বের করে সমাধান করবে।’

প্রকল্পে কর্মরত বায়ো-মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার তাওহিদ-উল-ইসলাম বলেন, ‘জুলাই থেকে বেতন বন্ধ। ২০১৮ সাল থেকে অন্যান্য ভাতা দেননি। সব মিলে ৭ কোটি টাকার বকেয়া। এই বকেয়া দাবি করার পর এখন বলছেন গত জুন থেকে প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। এটা তিনি জানালেন বিদেশ যাওয়ার আগের দিন ১০ নভেম্বর। সেদিন নোটিস ইস্যু করেন জুন থেকে সবার চাকরি বাতিল করা হলো।

শ্রম অধিকার আইন বলে, পেছনের তারিখে কারও চাকরি যায় না। এটা যুক্তিযুক্ত না। এটা এমন সময় বলল, যখন আমরা তার যাবতীয় অনিয়মের তথ্য পেয়েছি, তখন। প্রশাসনের কাছে চিঠি দিয়েছি।’

হঠাৎ প্রকল্প বন্ধ ঘোষণা, বিদেশ পরিচালক : তিন মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না কর্মরতরা। এমন অবস্থায় ১০ নভেম্বর হঠাৎ করেই প্রকল্প পরিচালক প্রকল্পের সবাইকে চাকরিচ্যুতির নোটিস দেন ও পরের দিন বিদেশ চলে যান।

পরে হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার রেজাউর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জানান, মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে গত জুন থেকে প্রকল্প বন্ধ দেখানো হবে এবং সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর আসার প্রয়োজন নেই।

এই নোটিসে বিস্ময় প্রকাশ করে প্রকল্পের কর্মরতরা জানান, অথচ গত ৩ অক্টোবর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুস সালাম খান প্রকল্পের স্টাফদের ফোন করে কাজের খোঁজখবর নিয়েছেন এবং সবাইকে মাঠপর্যায়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কেন্দ্রে এখনো প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। গত পাঁচ মাসে বেশ কিছু স্বাস্থ্য ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। জুলাই মাসে বেশ কিছু জেলা ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে ঢাকা থেকে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অংশ নেন।

এমনকি ন্যায্যপ্রাপ্তির দাবিতে কর্মবিরতিতে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে কর্মরতদের কাজে ফেরার অনুরোধ জানান হাসপাতাল পরিচালক। তখন প্রকল্প পরিচালক স্পষ্ট জানান, আগামী বছরের জুন পর্যন্ত সবার বেতন দিতে পারবেন। তখন প্রকল্প শেষে ইনস্টিটিউট না হলে সবার চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।

এমনকি প্রকল্প পরিচালক আরও জানান, এইচপিভি পরীক্ষা প্রচলনের জন্য আরেকটা প্রকল্প শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে এবং কর্মরতদের সেখানে ফের নিয়োগ দেওয়া সম্ভব।

প্রকল্প শেষ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে হাসপাতাল পরিচালক বলেন, ‘গত ৬ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মিটিং হয়। সেখানে নিশ্চিত করা হয়েছে যেন এই প্রকল্পের কেউ আর আশায় না থাকে।

আমরা শুনেছিলাম, এই প্রকল্প শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। নো কস্ট এক্সটেনশন অর্থাৎ অবকাঠামোগত কিছু কাজ চলবে। কিন্তু জনবলের বেতন-ভাতা বন্ধ। গত ৩০ জুন থেকেই এটা বন্ধ।’

তবে প্রকল্প বন্ধ হওয়া নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও হাসপাতাল প্রশাসন দুই ধরনের কথা বলছেন এমন অভিযোগ করেছেন বায়ো-মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার তাওহিদ-উল-ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের সচিব গণমাধ্যমের এক সাংবাদিককে বলেছেন, আমরা ঠিকমতো কাজ করি না, সেজন্য প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, অনিয়ম পেয়েছেন, সেজন্য বন্ধ করা হয়েছে। একেকজন একেক রকম বলছেন।

আমরা মনে করি, প্রকল্প পরিচালককে বাঁচাতে চাইছেন সবাই। অথচ প্রকল্পে প্রশিক্ষণ এখনো চলছে। ম্যাডামের কিছু ঘনিষ্ঠ চিকিৎসক প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন। তারা চাইছেন আমরা চলে যাই। যাতে তাদের এসব অনিয়ম প্রকাশ না পায়।’

বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে তাওহিদ-উল-ইসলাম বলেন, ‘ডা. আশরাফুন্নেসা এখনো একটি ইউনিটের দায়িত্বে আছেন। আইপিভিএস বা ইন্টারন্যাশনাল প্যাপিলোমা ভাইরাস কনফারেন্সে অংশ নেওয়ার কথা বলে যুক্তরাজ্যে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়েছেন। ১১ নভেম্বর সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে ফ্লাইট ছিল। ২০ নভেম্বর ফেরত আসার কথা। কিন্তু শুনতে পাচ্ছি আর ফিরবেন না। আমাদের মনে হয় প্রকল্পের অনিয়ম থেকে বাঁচতে তিনি দেশত্যাগ করেছেন।’

এই প্রকৌশলী জানান, ডা. আশরাফুন্নেসা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের পারিবারিক চিকিৎসক। সেই প্রভাবে তিনি এই প্রকল্পের পরিচালক হয়েছেন।

হাসপাতাল পরিচালক বলেছেন, ডা. আশরাফুন্নেসা বিদেশে গেছেন। তবে তিনি এখনো প্রকল্পে আছেন।

চুরি ছয় খাতের টাকা : প্রকল্পে কর্মরতরা জানান, প্রকল্পের জনবল নিয়োগের সময় প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. আশরাফুন্নেসা জানান, প্রকল্পের জনবলের জন্য সরকার থেকে বেতন ছাড়া অন্য কোনো ভাতা বা সম্মানী দেওয়া হয় না। প্রকল্প শেষ হলে একটি ইনস্টিটিউট স্থাপন করে কর্মরতদের আত্তীকরণ করা হবে।

কিন্তু গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর প্রকল্প পরিচালক হঠাৎ করেই জানান, বর্তমান প্রশাসন তার অনুকূলে না থাকায় তিনি চাকরি স্থায়ীকরণের ব্যাপারে কিছু করতে পারবেন না। এরপরই উঠে আসে প্রকল্প পরিচালকের আর্থিক দুর্নীতির তথ্য।

প্রকল্প-সংক্রান্ত নথিপত্র থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের মূল বেতন ছাড়াও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্য ক্যাম্পে সম্মানী বাবদ প্রত্যেক প্রশিক্ষক, কো-অর্ডিনেটর, ফ্যাসিলিটেটর ও অংশগ্রহণকারীর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ রয়েছে। গত সাত বছরে এসব খাতে বরাদ্দ ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এর মধ্যে এ বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর বেতন বাবদ রয়েছে ৬৯ লাখ ৫৫ হাজার ২১৮ টাকা ও অন্যান্য ভাতা বাবদ রয়েছে ৬ কোটি ৯৯ লাখ ২২ হাজার ৬৪৮ টাকা। এই অন্যান্য ভাতার মধ্যে রয়েছে প্রশিক্ষণ ব্যাচ, এক দিনের প্রশিক্ষণ, অ্যাডভোকেসি মিটিং ও স্বাস্থ্য ক্যাম্পের ভাতা। এসব কাজের জন্য সরকারি বরাদ্দ থাকলেও তা দেওয়া হয়নি।

টাকা না দিয়ে হুমকি-ধমকি, তদন্তে গড়িমসি : তথ্য প্রকাশের পর এসব বিলের অর্থ চেয়ে গত ৭ অক্টোবর প্রকল্প পরিচালককে চিঠি দেন কর্মরতরা। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক এসব ভাতা দিতে অস্বীকৃতি জানান।

প্রকল্পের চিকিৎসকরা জানান, এত দিন এসব কাজের জন্য কোনো ভাতা নেই বললেও এখন এসব ভাতা প্রকল্প পরিচালনায় নানা হিসাববহির্ভূত ব্যয় হয়েছে বলে জানান। যেমন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ডেস্ক ম্যানেজ করা, অডিট সামলানো, গাড়ি ভাড়া ইত্যাদি।

এমনকি এসব পাওনা আদায়ে দাবি জানালে গাইনোকোলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শিরিন আক্তার বেগম কর্মরতদের দেখে নেওয়া ও চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেন।

এ ব্যাপারে ডা. শিরিন আক্তার বেগমকে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি।

প্রকল্পের কর্মরতরা জানান, বকেয়া বেতন ও ভাতা আদায়ে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমানকে চিঠি দেন এবং দেখা করেন। তিনি একটি তদন্ত কমিটি গঠনের কথা বললেও অদ্যাবধি তা হয়নি।

প্রকল্পের অভিযোগ তদন্তের ব্যাপারে হাসপাতাল পরিচালক বলেন, ‘আমি নীতিনির্ধারকদের কেউ নই। প্রকল্পের যারা মনে করছেন তারা বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের যে ফাইল সেটা নীতিনির্ধারকদের কাছে পাঠানো হয়েছে। কর্র্তৃপক্ষ যখন যেভাবে মনে করেন, তদন্ত করবেন।’ সূত্র : দেশ রূপান্তর

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!