• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫, ১৩ চৈত্র ১৪৩০

জামায়াতের কর্মকাণ্ডে আস্থাহীনতা


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫, ০৭:৪৭ পিএম
জামায়াতের কর্মকাণ্ডে আস্থাহীনতা

ঢাকা : জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন চায় না বিএনপি। দলটির এই অবস্থানের কথা অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) তারা ইতিমধ্যে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। স্থানীয় নির্বাচন বিএনপি কেন আগে চাচ্ছে না, এ বিষয়ে শীর্ষ নেতারা বড় দাগে তিনটি কারণের কথা জানিয়েছেন। 

দলটির নেতাদের মতে, এর প্রধান কারণ দলীয় প্রতীকবিহীন স্থানীয় নির্বাচন আগে হলে পতিত ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার জন্য একে বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজে লাগাতে পারে। এতে দেশ জুড়ে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যেটি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এটি সরকারের যে মূল ফোকাস জাতীয় নির্বাচন, সেই প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে পারে। 

বিএনপি নেতারা মনে করেন, পতিত ফ্যাসিবাদের দোসরদের নানামুখী ষড়যন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে অবিলম্বে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই হতে পারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ।

ইতিমধ্যে দলটির শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ এ বিষয়ে তাদের বক্তব্যও রেখেছেন। গত শনিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা খুব পরিষ্কারভাবে বলেছি জাতীয় নির্বাচন আগে; তারপর স্থানীয় সরকার নির্বাচন।’ 

গতকাল স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল মাহমুদ টুকু বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো অন্তর্বর্তী সরকার এসে এই ধরনের নির্বাচন করেনি। আমরাও স্থানীয় নির্বাচন চাই না; আগে জাতীয় নির্বাচন (চাই)।’ দলের জ্যেষ্ঠ মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘শেখ হাসিনা ভয়ংকর পরিকল্পনা নিয়ে ওৎ পেতে আছে। দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দিয়ে সেই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে হবে।’

দ্বিতীয় কারণ হলো জামায়াতের কর্মকাণ্ড। এমনটি দলটির একাধিক নীতিনির্ধারকের ভাষ্য। তাদের মতে, ইতিমধ্যে জাতীয় সংসদের বিভিন্ন আসনে জামায়াত দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করছে। দলটির এমন তৎপরতায় আস্থার অভাব ও সন্দেহ বেড়েছে বিএনপিতে। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে দল দুটি। বিএনপি জাতীয় নির্বাচন আগে চাইলেও জামায়াত আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাচ্ছে।

বিএনপির এক শীর্ষ নেতা জানান, তাদের ধারণা বিএনপি যাতে নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী না হতে পারে সে জন্যই জামায়াত ‘নির্বাচন প্রলম্বিত করতে’ নানা ধরনের তৎপরতা শুরু করেছে। কারণ গত ১৭ বছর নানা কারণে জামায়াতের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল হয়েছে। স্থানীয় নির্বাচন আগে হলে জামায়াত তাদের সংগঠনকে শক্তিশালী করার একটা প্ল্যাটফর্ম পাবে।

তৃতীয় কারণ হিসেবে বিএনপি নেতারা ছাত্রদের নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়াটি সামনে এনেছেন। বিএনপির মধ্যে আলোচনা হচ্ছে ছাত্রদের দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলেও সারা দেশে এখনো তাদের সাংগঠনিক  ভিত্তি নেই। আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে তাদের সাংগঠনিক প্রক্রিয়া খুব একটা ভিত্তি পাবে না। ফলে জাতীয় নির্বাচনে তাদের প্রার্থী থাকলেও প্রস্তুতিতে ঘাটতি থাকবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় নির্বাচন হলে সারা দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে তারা প্রার্থী ঘোষণা করবে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের একটি সাংগঠনিক ভিত্তি দাঁড়িয়ে যাবে। তাদের এই সুযোগ ফ্যাসিবাদীরা, জামায়াতসহ সবাই নেওয়ার সুযোগ খুঁজবে।

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানানো হয়েছিল। তবে সম্প্রতি রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় নির্বাচন আগে না স্থানীয় নির্বাচন আগে হবে সেটি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে।

গত ১ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’-এর প্রতিবেদনেও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। নির্বাচন কমিশনও এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় রয়েছে। 

গত সপ্তাহে ইউএনডিপিসহ উন্নয়ন সহযোগী ১৮টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ‘দুটো নির্বাচন একসঙ্গে করা যায় কি না, এতে কেমন সময় লাগতে পারে, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। 

অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সবকটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন ধাপে ধাপে করতে গেলে এক বছর সময় লেগে যায়। পুরোপুরি এভাবে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করতে হলে জাতীয় নির্বাচনের সময় পিছিয়ে যাবে। জাতীয় নির্বাচন এখন নির্বাচন কমিশনের অগ্রাধিকার। নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচন নিয়েই এ মুহূর্তে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের, সেটা সেভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা সরকারের সিদ্ধান্ত।’

বিএনপি শুরু থেকেই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিরোধিতা করে আসছে। দলটির নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন করা। তাছাড়া এ ধরনের সরকারের অধীনে অতীতে কোনো স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার নজিরও নেই। আর ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এর আরও বেশি যৌক্তিকতা নেই। 

কারণ, স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে সরকারের মূল যে লক্ষ্য, সেখান থেকে বিচ্যুত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ইউনিয়ন থেকে শুরু করে পৌরসভা, উপজেলা, জেলা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন এগুলো দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। 

বিএনপির আরও শঙ্কা রয়েছে, এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে সেটা ‘পতিত’ আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনেরও একটা মাধ্যম হতে পারে। কেননা, এই নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেক্ষেত্রে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের লোকজন প্রার্থী হলে তাদের যেমন ঠেকানো যাবে না, তেমনি তৃণমূলে ব্যাপক হাঙ্গামা-সংঘর্ষও হতে পারে। যেটা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তখন পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে যাবে। যার প্রভাব পড়বে জাতীয় নির্বাচনেও। সুতরাং সরকার এ ধরনের নির্বাচনের উদ্যোগ নিলে তাদের মূল উদ্দেশ্যই ভেস্তে যেতে পারে।

বিএনপি গত মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে তাদের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত হচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই আসে না। কারণ, এখন পুরো দেশ ও জাতির ফোকাসটা হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে। 

স্থানীয় সরকার নির্বাচন না চাওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে দলটি তখন বলেছিল, সংকটটা ওই জায়গাতে, দেশে গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। মানুষ সেজন্য একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ পাড়ি দিতে চায়। তাছাড়া স্থানীয় সরকার দেশ চালায় না। দেশ চালায় জাতীয় সংসদ, আইন প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদ। 

ফলে গণতন্ত্রের মূল বিষয়টি হচ্ছে জাতীয় সংসদ, এটা কার্যকর হলে গণতন্ত্র সচল হয়। বিএনপি তখন এও জানিয়েছিল, স্থানীয় সরকারের তৃণমূল স্তর হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। সেই ইউনিয়ন পরিষদই তো সরকার এখনো বাতিল করেনি। সেটা যদি বাতিল না করে, সেখানে কীভাবে লোকাল গভর্নমেন্ট নির্বাচন হবে?

সপ্তাহ দুই আগে যমুনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে নিজেদের আপত্তির কথা পুনরায় জানিয়েছে বিএনপি। গত শনিবারও যমুনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিটির সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন নয়।’ গত সপ্তাহে ইসির সঙ্গে বৈঠকেও এমন মনোভাবের কথা জানিয়েছে বিএনপি।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘তারা গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, যেটি সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে স্থানীয় নির্বাচনের কথা মাথায় আনা যাবে না। কারণ, পতিত আওয়ামী লীগ গর্তের ভেতর মাথা লুকিয়ে রেখেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে তারা গর্ত থেকে মাথা বের করবে, আবারও মাথাচাড়া দেবে। তাই আওয়ামী লীগকে সেই সুযোগ দেওয়া যাবে না।’

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদও এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন না চাওয়ার বিষয়টি আমাদের দলীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত। আইনি এবং সাংবিধানিক বিষয়াবলি বিবেচনায় নিয়ে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা যদি অগ্রাধিকার ঠিক না করি, দেশে একটি ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। তা ছাড়া দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। দেশে এই ধরনের সরকারের অধীনে অতীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নজির নেই।

সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটির নেতাদের নিয়ে গতকাল দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষে ইকবাল মাহমুদ টুকু আরও বলেন, ‘বিএনপি একটি নির্বাচনী দল। আমরা বলেছি, জুন-জুলাই মাসে নির্বাচন করার জন্য। সরকার বলছে, ডিসেম্বরে নির্বাচন করবে। দেখি কী হয়।’

এ সময় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুস সালাম, রুহুল কবির রিজভী, সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিরুল ইসলাম খান আলীম, সদস্য আব্দুল মান্নান, সিমকী ইমাম, মজিবর রহমান, মকবুল হোসেন চৌধুরী, আজিজুর রহমান দুলাল, নাজমুল হাসান রানা, অমর কৃষ্ণ দাস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সূত্র : দেশ রূপান্তর

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!