• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আর নয় যুদ্ধ, বিশ্ববাসী শান্তি চায়


বিশেষ প্রতিনিধি জানুয়ারি ৯, ২০২০, ০৩:০৭ পিএম
আর নয় যুদ্ধ, বিশ্ববাসী শান্তি চায়

ঢাকা : ইতিহাস সাক্ষী-যুদ্ধ, সংঘাত কখনো কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। যুদ্ধ মানেই রক্তপাত, লোকালয়ের পর লোকালয় জনশূন্য হয়ে যাওয়া। যুদ্ধ-সহিংসতায় জড়িয়ে অনেক জাতি পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে চলছে উত্তেজনা। যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আতঙ্কে আছে বিশ্ববাসী। এ নিয়ে চলছে রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের গবেষণা।

কি হলে কি হতে পারে তা নিয়ে তারা ভরিয়ে ফেলছেন সংবাদপত্রের পাতা। টেলিভিশনে দিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক বক্তব্য। ইরান সোলাইমানি হত্যার কঠোর প্রতিশোধের হুমকি দেওয়ার পর বিশ্ববাজারে বেড়ে গেছে তেল ও স্বর্ণের দাম।

তবে সব উত্তেজনার মধ্যে যেন শান্তির বাণী শোনালেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ। গতকাল বুধবার তিনি বলেন, ইরান আর যুদ্ধ বা উত্তেজনা চায় না।

আমাদের জনগণ ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ওপর যে ঘাঁটি থেকে কাপুরুষোচিত সশস্ত্র হামলা করা হয়েছে, জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদ অনুসারে আত্মরক্ষায় ইরান সেখানে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে এর (ঘটনার) সমাপ্তি টেনেছে। আমরা যুদ্ধ বা উত্তেজনা বাড়াতে চাই না। তবে যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করব।

যদি মার্কিন বাহিনী বিরত থাকে এবং ইরান যদি সোলাইমানি হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে আর কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে ওয়াশিংটন ও তেহরান এ সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার একটি সুযোগ পেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলার পর ইরানের সশস্ত্র বাহিনী প্রধান বলেছেন, তার দেশ সক্ষমতার সামান্যই দেখিয়েছে। একইসঙ্গে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি এর প্রতিশোধ নেয় তাহলে আরো কঠিন ও বিধ্বংসী জবাব দেবে তেহরান। ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাকেরি বলেন, মার্কিন কর্মকর্তাদের ইরানের ক্ষমতা অনুধাবন করা এবং দেশটির সন্ত্রাসী সেনাদের এ অঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার সময় এসেছে।

এর আগে ইরানের সেনাবাহিনী আইআরজিসির টেলিগ্রাম চ্যানেলে সতর্ক করে বলেছে, পাল্টা হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে, তাদের মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই এবং ইসরাইলের হাইফায় হামলা চালাবে তেহরান। তবে আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির অবসান চাই বলে জানিয়েছে। সোলাইমানি হত্যার প্রতিবাদে গতকাল ভোরে ইরাকে দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে তেহরান।

ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনোয়ার গার্গাশ বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক সমাধান প্রত্যাশ্যা করছি। এক টুইট বার্তায় বলেন, উত্তেজনা কমানোই হবে এখন জরুরি ও সঠিক সিদ্ধান্ত। স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথে হাঁটতে হবে আমাদের।

ওয়াশিংটন-তেহরান উত্তেজনা বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাপানও। সংঘাত নিরসনে কূটনৈতিক সমাধানের পথ খোঁজার আহ্বান জানিয়েছে দেশটি।

জাপানের মন্ত্রিসভার মুখ্য সচিব ইয়োশিদি সুগা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন উত্তেজনা কোনোভাবেই কাম্য নয়। জাপান যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র হলেও ইরানের সঙ্গে নিবিড় অর্থনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে তাদের। বলেন, গত মঙ্গলবার দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী তারো কোনো এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোতেগি তোসিমিতসু উপস্থিত ছিলেন। গত বছর ওয়াশিংটন-তেহরান উত্তেজনা শুরুর পর দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব নিরসনের চেষ্টা চালায় টোকিও। গত জুনে তেহরান সফর করেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী। ওই সফরে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ নিলেও তা ব্যর্থ হয়। ডিসেম্বরে জাপান সফর করেন ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ওই সফরে তিনি পারমাণবিক চুক্তি রক্ষায় টোকিওকে পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন।

বিমান হামলা চালিয়ে সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনায় খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন ট্রাম্প সরকার। এ ঘটনার পর দেশটির ৭০টি শহরে একই দিন যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। প্রতিদিনই দেশটির কোনো না কোনো শহরে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তাদের কর্তৃত্ব হারাতে বসেছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে সেখানে বিদেশি সৈন্যের উপস্থিতি মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু সোলাইমানির হত্যাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের সব হিসাব-নিকাশ মুহূর্তেই পাল্টে গেল। ইরাকের পার্লামেন্টে সেদেশে আর কোনো বিদেশি সৈন্য থাকবে না-এমন একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরানের বড় ধরনের বিজয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তবে দেরিতে হলেও ট্রাম্পের হুঁশ হয়েছে। সোলাইমানি হত্যাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে নানা ধরনের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তেহরান সে প্রস্তাবে সায় দেয়নি। তারা প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর ছিল এবং গতকাল সকালে ইরাকে মার্কিন বিমানঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৮০ সৈন্যকে হত্যার মধ্যদিয়ে প্রতিশোধ নিয়ে জানিয়েছে আর যুদ্ধ নয়।

হামলার প্রতিক্রিয়ায় এক টুইটে ট্রাম্প বলেছেন, সব ঠিক আছে! এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, ভালো হয়েছে!। তবে হামলায় হতাহতের বিষয়টি তারা অস্বীকার করেছেন। এর মধ্যদিয়ে হয়তো ট্রাম্প সরকার মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার প্রশমন চান।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) বেসামরিক মার্কিন বিমানগুলোকে ইরাক, ইরান, পারস্য ও ওমান উপসাগরের ওপর চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

বিবৃতিতে বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক কর্মকাণ্ড এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে, যা মার্কিন বেসামরিক বিমান পরিবহনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য দেশের বেশকিছু বিমান পরিবহন সংস্থাও মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাপূর্ণ এলাকাগুলোর আকাশসীমা এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শুধু তাই নয়, মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের ভার সইতে পারবে না। ইরাকে মার্কিন বাহিনীকে লক্ষ্য করে চালানো বোমা হামলার ওপর কড়া নজর রাখছি। আমাদের অবশ্যই মার্কিন সেনাসদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; একইসঙ্গে (ট্রাম্প) প্রশাসনের অপ্রয়োজনীয় উসকানি বন্ধ করাতে হবে। ইরানকে তাদের সহিংসতা থামাতে দাবি তুলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বযুদ্ধের ভার বহন করতে পারবে না।

প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ডেমোক্র্যাটরা পরবর্তী যেকোনো সামরিক পদক্ষেপের আগে ট্রাম্পকে কংগ্রেসের অনুমোদন নিতে বাধ্য করাতেও চাইছে। মার্কিন জনগণ ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না, তেহরানের হামলার পরপরই নিউইয়র্কের এক অনুষ্ঠানে বলেন প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্র্যাট পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী এলিজাবেথ ওয়ারেন।

দলটির আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী জো বাইডেন বলেন, ইরানের হামলা অনুমিতই ছিল। পরিস্থিতি সামলাতে ট্রাম্পের পদক্ষেপকে ত্রুটিপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মার্কিন বাহিনীর ওপর ইরানের হামলার সময় পেলোসির সঙ্গে ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতাদের একই বৈঠকে ছিলেন প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের নেতা স্টেনি হোয়ের। হামলার খবর যখন বৈঠকে এল, সেখানে থাকা কেউই বিস্মিত হননি বলে জানান তিনি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!