• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বহুমাত্রিক অটিজম শিশু বিতান


আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, পাবনা মে ৮, ২০১৭, ১২:৫৯ পিএম
বহুমাত্রিক অটিজম শিশু বিতান

পাবনা: সন্তান বাবা মায়ের কাছে অনেক আনন্দের এক জায়গা। কিন্তু কোন কোন সময় প্রকৃতির হেয়ালীতে সেই সন্তানও পিতামাতার কাছে সাময়িকভাবে হয়ে পড়ে যন্ত্রণাময়। তবু তাকে জড়িয়ে রাখে বাবা ও মায়ের পরম মমতায়। বুকে কষ্টের পাথর চেঁপে ভেতরে যন্ত্রনার ক্ষরণ নিয়ে পার করে বছরের পর বছর।

পাবনার এমনই এক অটিজম শিশু বিতান। পাবনা শহরের দিলালপুরের পি কে সাহা রোডের বাসিন্দা দোগাছী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিপুলেশ চন্দ্র সরকার ও গৃহিনী শিল্পী রাণী সরকারের ছেলে বিতানের জন্ম ২০০৪ সালের ১০ মার্চ সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার মোহনপুরের মামা বাড়িতে।
শীতের আমেজ তখনও শেষ হয়নি, এমনই এক সময়ে বিতানের জন্ম। জন্মের সময়ে দাইমা তার মাথায় চাপ দিয়ে ভূমিষ্ট করাতে গেলে নরম মাথায় আঙ্গুলের নখ বসে যায়। এরপরে দাইমা তাকে গোসল করায়। এ কারণে ঠান্ডা পানির স্পর্শে শিশুটির নাড়িতে ঠান্ডা লেগে যায় এবং জ্বর হয়। গ্রাম্য চিকিৎসক সর্দি জ্বরের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করতে পারেনি।

পরবর্তীতে পাবনায় এনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দেখানো ও চিকিৎসার পরেও ঠান্ডার প্রবনতা কোনভাবেই পিছু ছাড়েনা শিশু বিতানের। বয়স যখন তিন বছর তিন মাস তখন তাকে হাসপাতালে টিকা দেয়ার পরে বিতানের শরীর সামান্য গরম হলেও, পরে ঠিক হয়ে যায়। এর আগে সাত মাস বয়সের সময়ে টিকা দেয়া হয়, ওই সময়ে শিশুটির শরীর প্রচন্ড গরম হয় এবং অনেক পানি ঢালা সত্বেও তাকে অজ্ঞান অবস্থা থেকে স্বাভাবিক করা যায়নি।

অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে ভর্তি করা হয় পাবনা জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে স্বাভাবিক চিকিৎসা দিয়ে কাজ না হলে, অক্সিজেন দেয়া হয় শিশু বিতানকে, দুই ঘন্টা পরে জ্ঞান ফেরে তার। কয়েকদিন সেখানে থাকার পরে বাড়ি আনার পরে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খাওয়ানো অব্যাহত থাকে।

চিকিৎসকরা বলেন, বিতানের জ্বর হলে তা মাথায় উঠে যায়, শুরু হয় খিচুনি জনিত ফিট লাগা। পাবনার চিকিৎসকদের পরামর্শে অনেক আশা বুক বেঁধে শিশু বিতানকে নেয়া হয় ঢাকার নিউরো বিশেষজ্ঞের কাছে। কিন্তু বাবা মায়ের সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। চিকিৎসা হলেও তেমন কোন উন্নতির দেখা মেলে না আদরের শিশুটির।

কোন কিছুতেই খিচুনিজনিত ফিট লাগা বা জ্ঞান হারানো প্রশমিত হয় না। বড় হওয়ার সাথে সাথে শিশু বিতানের অটিজম রোগের মাত্রাও বাড়তে থাকে। খিঁচুনি বাড়তে বাড়তে তার ব্রেন বা মস্তিষ্কের সেল নিস্তেজ হতে থাকে, কোন কোন সময়ে বিতানের জ্বর নেই, নেই সর্দি কাশি, তবুও সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এমন অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন বাবা মা। শিশু বিতানের শারীরিক অসুবিধা বাবা মা-ও ঠিক মতো বুঝতে পারে না, কারণ সে কথা বলতে পারে না।

অটিজম শিশু বিতানের মাঝে বিদ্যমান অসঙ্গতিগুলো হলো- মৌখিক বা অমৌখিক যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা, সামাজিক আচার আচরণ ভাব বিনিময় ও কল্পনা মুক্ত কাজ কর্মের সীমাবদ্ধতা, একই কাজের পুনরাবৃত্তি, অন্যের তুলনায় কম সংবেদনশীল, খিঁচুনি, চোখে চোখ কম রাখা, অতিরিক্ত চঞ্চলতা বা উত্তেজনা বা অসংগতিপূর্ণ হাসি কান্না, একই রুটিনে চলার প্রবণতা, রাগ ও জেদ অত্যন্ত বেশি।

যখন রাগ বা জেদ বেশি হয় সে হাতের কাছে যা পায়, তা দিয়েই মারধর করে ও ছুঁড়ে মারে। বাবা মা কিছুই বোঝে না জেদ বা রাগ হলে। সে মাথায়, বুকে, পেটে ও কলিজায় আঘাত করে। সম্প্রতি অবুঝ শিশু বিতান তার মায়ের মাথা ফাটিয়ে দেয়, কানের দুল ধরে টেনে মায়ের কান ছিঁড়ে দেয়। জেদ ও রাগ চেক দিতে না পেরে শিশু বিতান নিজেই তিনবার তার নিজের মাথা ফাটায় ফেলে, তাকে বারবার ভর্তি করা হয় হাসপাতালে।

শিশু সন্তানের এমন অবস্থা দেখে তাকে গত তিন মাস ধরে রাখা রয়েছে শহরের স্থানীয় একটি ক্লিনিকে। বাবা বিপুল ও মা শিল্পীর জন্য কতোটা দুর্ভাগ্য ও কষ্ট যে, একই শহরে থেকে তারা শিশু ছেলের জন্য নির্ঘুম রাত কাটান বাড়িতে, আর ছেলেটি রয়েছে ক্লিনিকে। একটি অটিষ্টিক শিশুর জন্য আশ্রয়স্থল হলো একটি উন্নতমানের আবাসিক অটিষ্টিক সেন্টার। তেমন কোন সেন্টার পাবনাতে গড়ে ওঠেনি আজো।

শিশু বিতানের বাবার অবস্থা এমন নয় যে, তাকে বেসরকারী পর্যায়ের কোন ভালো আবাসিক অটিষ্টিক সেন্টারে ছেলেকে রাখবেন। ছেলেকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এক মানসিক যাতনায় জীবনের সাথে যুদ্ধ করছেন বিপুল ও শিল্পী। বছরের পর বছর যন্ত্রনা ও ক্লান্তিতে তারা দু’জনও হয়ে পড়েছেন মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ। তাদের পাশে সরকারের একটু সহানুভূতি পেলে তারা নিশ্চিত হতেন ছেলের সুচিকিৎসাসহ থাকবার মতো একটু বন্দোবস্তের।

শিশু বিতানের বাবা সদালাপী ও বিনয়ী স্কুল শিক্ষক বিপুলেশ চন্দ্র সরকার জানান, গত ১৩ বছর তিনি জীবনের সবটুকু চেষ্টা করেছেন। সবকিছু ঢেলে দিয়েছেন ছেলের জন্য।

কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ‘আর কোন বাবা মায়ের জীবনে যেন এমন কষ্টের ঘটনা না হয়। একটা অটিজম শিশু যার বাড়িতে আছে, একমাত্র সেই বুঝতে পারবেন জীবনটা কতোখানি যন্ত্রনাময়। একজন স্কুল শিক্ষক হয়ে কতো শিশুকে পড়ালেখা করায়, অথচ নিজের সন্তানের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। যখন অন্য শিশুরা স্কুলে আসে, পড়ালেখা করে, তখন বুকের পাঁজরের হাড়গুলো মনে হয় কষ্টে ভেঙে চুড়ে যায়, এমনই কপাল আমার’।

তিনি সরকারের কাছে একটু সহানুভুতির জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, যেন তার বহুমাত্রিক অটিজম ছেলের চিকিৎসাসহ থাকবার মতো ব্যবস্থাটুকু হয়।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!