• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

লাখো নারী উদ্যোক্তার অনুপ্রেরণা নাসিমা আক্তার নিশা


আবদুল হাকিম জুলাই ৬, ২০২৩, ০৫:১৮ পিএম
লাখো নারী উদ্যোক্তার অনুপ্রেরণা নাসিমা আক্তার নিশা

ঢাকা: দেশের অর্থনীতিতে নারীদের আর্থিক অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্ম ওমেন অ্যান্ড ই কমার্স ফোরাম (উই)। নতুন নারী উদ্যোক্তা তৈরি ও দেশীয় পণ্য সবার কাছে পৌঁছে দিতে বিভিন্ন পরামর্শ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষ করে তুলতে পথ দেখায় উই। সোনালী নিউজের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠার স্বপ্নের কথা, এই প্লাটফর্মের পেছনে নারীদের জন্য কাজ করার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা-প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা। ছোট পরিসরে গড়ে ওঠা সেই স্বপ্নের কথাগুলো তুলে ধরেছেন সোনালী নিউজের স্টাফ রিপোর্টার আবদুল হাকিম।

সোনালী নিউজ: উই’র শুরুটা কিভাবে হয়েছিল এবং কোনো ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল কিনা?
নাসিমা আক্তার নিশা: আমার প্রথম উদ্যোক্তা জীবন শুরু হয়েছে ২০১০ সালের দিকে। তখন উইমেন ই-কমার্স এর পথ চলা। সেই সময় সফটওয়্যার কোম্পানি দিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। আমার কোম্পানির প্রধান কাজ ছিলো এ্যাপস এবং গেম তৈরি করা। এই কাজটা করতে গিয়ে আমি বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখিন হই। কারণ আমার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। ভালো তথ্য পেতাম না। তখন মনে হলো এমন কোন প্লাটফর্ম যদি পেতাম যেখানে সঠিক গাইডলাইন পাওয়া যায়। দেখা যায় আমরা এক ধরণের পরিকল্পনা করি কিন্তু বাস্তবে তা ভিন্ন। এগুলো বুঝার জন্য জানার জন্য গাইডলাইন পাওয়াটা খুব অনুভব করলাম। এছাড়াও নেটওয়ার্ক একটা বড় সমস্যা। এসব চিন্তা থেকে সুযোগ পেলে কিছু একটা করবো পরিকল্পনা ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় উই’র পথ চলা। প্রথম দিকে কাজটা শুরু করেছিলাম ছোট পরিসরে। যার কারণে বড় কোন ধাক্কা খেতে হয়নি। তবে ধীরে ধীরে যখন প্লাটফর্মটা বড় হতে শুরু করলো তখন কিছুটা সমস্যা তৈরি হয়েছিল। তবে সেটা কোন বড় সমস্যা ছিল না। নয়তো আমরা এতো দুর আসতে পারতাম না। 

সোনালী নিউজ: উই’র সদস্যদের কোন ফান্ড দেওয়া হয় কিনা? দিলে সেটা কিভাবে দেওয়া হয়?
নাসিমা আক্তার নিশা: আমাদের সদস্যদের উই থেকে কোন ফান্ড দেওয়া হয় না। ২০২১-২০২২ সালের দিকে আমাদের নিজেদের অর্থাৎ যারা উই’র বোর্ড সদস্য আছি তারা ১০ হাজার টাকার একটা বাজেট রেডি করতাম। এই ১০ হাজার টাকার বাজেটটা আমরা আমাদের উদ্যোক্তাদের দেওয়ার ব্যবস্থা করতাম। তবে এটা দিতাম উদ্যোক্তার গল্প শুনে এবং তার মোটিভেশন দেখে। সে কতটুকু কাজ করার ইচ্ছা আছে বা কতটুকু কাজ করতে পারবে তার ভিত্তিতে। এটা আমরা প্রতি মাসে দিতাম, বেশ কিছু দিন চলছে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে নিজেদের থেকে এটা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একটা সময় গিয়ে আমাদেরও পকেট খালি হয়ে যায়। এজন্য পরবর্তীতে আমরা এটা বন্ধ করে দিয়েছি। তবে আশার দিক হচ্ছে শুধু উই’র সদস্য না উদ্যোক্তাদের জন্য আমরা আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে একটা ফান্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। এটা শুরু হয়েছিল ২০২০ সালে কোভিডকালিন সময়ে অনলাইনে একটা সামিট করেছিলাম সেখানে মন্ত্রণালয়ের কাছে আমার আবেদন ছিল উদ্যোক্তাদের ছোট পরিসরে ফান্ড দেওয়ার জন্য। তখন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ হাজার টাকা করে এককালীন ফান্ড দেওয়ার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন। এই কাজের প্রক্রিয়া শেষ হয়ে ২০২২ সালে বঙ্গমাতা ফজিলাতুনন্নেছা মুজিব এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে কিছু উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রথমবারের মতো এই ফান্ড বিতরণ করা হয়েছে। 
 
সোনালী নিউজ: দ্রুততম সময়ের মধ্যে উই’র সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ কি ছিল?
নাসিমা আক্তার নিশা: উই’র সদস্য সংখ্যা অতি দ্রুত বাড়ার কারণ পজিটিভিটি। তবে অন্যতম কারণ হচ্ছে কোভিড। এই সময়টা আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছে। কোভিড আসায় সবার মনে একটা ভয় কাজ করছিল। অনেকে আক্রান্ত হচ্ছে, কখন নিজের পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হয়। কখন কে মারা যায় কিছুই বলা যাচ্ছিল না। তখন সবার এক ধরণের নেগিটিভিটি কাজ করছিল। এগুলো নিয়ে গ্রুপে অনেক লেখালেখি হতো। যখন গ্রুপে এসব আলোচনা দেখলাম ভাবলাম এভাবে নেগিটিভিটি চললে মানুষ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আগেই হতাশ হয়ে মারা যাবে। এর পর আমরা রুলস করে দিলাম কেউ গ্রুপে নেগেটিভ কিছু লিখতে পারবে না। সব পজেটিভ লিখতে হবে। এর পর থেকে কিছুটা পরিবর্তন আসা শুরু করেছে। এর মাধ্যমে বুঝতে পারলাম মানুষ পরিবর্তন চাচ্ছে। হতাশা থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছে। ঐ সময়টাতে আমরা ইক্যাব থেকে মধ্যবিত্ত পরিবারকে খাবার পাঠানো কাজ শুরু করেছিলাম। একটা সময় মনে হলো এদের এভাবে খাবার পাঠিয়ে লাভ নেই। এতে করে এ সমস্ত লোকগুলোর অভ্যাস খারাপ হবে এবং একটা সময় গিয়ে আমাদেরও ফান্ড শেষ হয়ে যাবে। ঠিক তখন মাথায় আসলে এদের কোন কাজে নিয়ে আসা যায় কিনা? এর পর আমার সার্কেলে যারা আছে তাদের নিয়ে আমাদের আড্ডা হতো। সেখানে বললাম আপনাদের যাদের যে দক্ষতা আছে সেটা নিয়ে কাজ করেন। যারা খাবার ভালো বানাতে পারেন তারা খাবার তৈরি করেন, প্রয়োজনে আমি খাবার অর্ডার করবো। অথবা আমরা যার যেটা প্রয়োজন আমাদের নিজের মধ্যে বানিয়ে বিক্রি করবো। তখন গিয়ে আমরা একটা পলিসিতে আগাতে শুরু করলাম। 

‘আমাদের শুরুটা হয়েছিল রুটি তৈরির মাধ্যমে। একজন উদ্যোক্তা ভালো রুটি বানাতে পারেন, তাকে বললাম আমি রুটি বানাতে পারি না। আমি আপনার কাছ থেকে রুটি অর্ডার করবো। কেউ দেখা গেছে আচার বানাতে পারে। এজন্য আমরা বললাম আমাদের নিজেদের তৈরি করা খাবার একে অন্যজনেরটা কিনবো। এর পর আমরা খাবারের রিভিউ দেওয়া শুরু করলাম। ঠিক এই সময়টাতে একটা বড় পরিবর্তন আসা শুরু করলো। কারণ কোভিডের আগে মানুষ বাহিরে গিয়ে খেতে পছন্দ করতো। কোভিডের কারণে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। তখন দেখা গেছে বাহিরে গিয়ে খেতে না পারলেও বাহিরে থেকে খাবার এনে ঘরে তো খাওয়া যায়। তখন দেখা গেছে অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হয়ে গেছে। এই সময়ে চলে আসলো রোজা। তখন আমরা সবাইকে বললাম ইফতার এবং সাহরি নিয়ে কাজ করতে। কেউ বুটিকস নিয়ে কাজ করছে আবার টেইলার্স সার্ভিসটাও এর সাথে যুক্ত করা শুরু হলো। এর মাধ্যমে মানুষের চাহিদা মেটাতে বেশ কিছু নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হলো। এসব প্রসেস যখন খুব ভালো সাড়া পেল তখন থেকে উই’র সাথে মানুষের সম্পৃক্ততা বেড়ে গেল। তারি ধারাবাহিকতায় উই আজ এত বড় প্লাটফর্ম হতে পেরেছে’।
 
সোনালী নিউজ: উই নিয়ে সফল হতে কাদের ভূমিকা বেশি ছিল?

নাসিমা আক্তার নিশা: উই’র সফলতায় অনেকের ভুমিকা আছে। বিশেষ করে ইক্যাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং উইর এডভাইজার রাজীব আহমেদের ভূমিকা ছিল অনেক। ২০১৯ সালের পহেলা নভেম্বর আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর আমি ধরেই নিয়েছিলাম কোন কাজ করতে পারবো না। ঠিক ঐ সময়টায় উই’র হাল ধরেছিল রাজীব আহমেদ স্যার। অন্যথায় গ্রুপটা হয়তো বন্ধ হয়ে যেত অথবা এভাবেই থাকতো আর আগাতো না। তখন তিনি বললেন, নিশা তুমি সময় নেও আমি তোমার কাজগুলো করে দিচ্ছি। তখন তিনি গ্রুপের হাল ধরলেন। ধীরে ধীরে গ্রুপে মেম্বার বাড়তে লাগলো। গ্রুপটা বড় হলো। আবার যখন কোভিড আসলো তখন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ভাই হাল ধরলো। আমাদের তিন লক্ষ মেম্বার হওয়ার পর পলক ভাই বললেন আপনাদের কি লাগবে? তখন আমি বলেছিলাম আমাদের উদ্যোগক্তাদের জন্য স্কীল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম লাগবে। তিনি সাথে সাথে আমাদের একটা ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং ফ্রিতে দিয়ে দিলেন। এর পর আমাদের সাজানো একটা ট্রেনিং সেশনও করিয়ে দিয়েছেন। সেখানে আমাদের পছন্দের দেশি বিদেশি ট্রেইনার ছিলেন। এসব ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে আমাদের উদ্যোগক্তারা শিখতে পেরেছে। উদ্যোক্তা হয়ে উঠার পথে এই প্রশিক্ষণগুলো অনেক কাজে লেগেছে। আমাদের উদ্যোক্তাদের পণ্যগুলো বিদেশেও রপ্তানি হয়েছে কোভিডকালীন সময়ে। এর জন্যও অনেকে আমাদের প্রথম থেকে সহযোগিতা করেছেন। উই’র এত দূর আসার পেছনে অনেকের সহযোগিতা আছে। যার কারণে উই আজ এত বড় প্লাটফর্ম।

সোনালী নিউজ: নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে কিনা?
নাসিমা আক্তার নিশা: উই’র সদস্যদের বা নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য আমাদের যে কোর্সগুলো সাজানো আছে তার মধ্যে একটা হলো বেসিক কোর্স। যেটা আমরা নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য সাজিয়েছি। যারা নতুন এবং শিখতে চায় তাদেরকে ১২টি মোডিউলে সাজানো কোর্সটি করানো হয়। এই কোর্সটা করলে অনন্ত সে জানতে পারবে কিভাবে মার্কের্টিং করতে হয়, কিভাবে ফাইনান্স অংশ সামলাতে হয়। এর মাধ্যমে নতুনরা যেমন উৎসাহ পায় অপর দিকে তাদের কাজ শিখে বাস্তবে প্রয়োগের সুযোগও থাকে। এভাবে আমরা নতুন উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষিত এবং উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহযোগিতা করে থাকি।
 
সোনালী নিউজ: উই’কে নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী, অর্থাৎ আগামী ১০ বছর পর কিভাবে দেখতে চান?
নাসিমা আক্তার নিশা: আগামী ১০ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উই’র ব্রাঞ্চ থাকবে। সবাই জানবে মেইড ইন উই, মেইড ইন বাংলাদেশের একটা ব্রান্ড আছে। যেখানে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের পণ্য পাওয়া যায়। শুধু তাই নয় খাটি বাংলাদেশি পণ্য পাওয়া যাবে। কোন রকম বিদেশি কাচামালের সংস্পর্শ ছাড়াই। 

সোনালী নিউজ: উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
নাসিমা আক্তার নিশা: উদ্যোক্তা হিসেবে অনেকে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। অনেকে কাজ করার প্লাটফর্ম খোঁজে। কেউ বা নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়ার আশা করে। অনেকে শুরু করার আগেই হতাশ হয়ে চলে যায়। দিন শেষে আমি বলবো নতুন যারাই উদ্যোক্তা হতে চান হতাশ হওয়া যাবে না। আমরা অনেকে বড় স্বপ্ন নিয়ে উদ্যোক্তা হতে আসি কিন্তু স্বপ্নের ফলটা সাথে সাথেই পেতে চাই। আসলে সাথে সাথে কোন কিছুই হবে না। সব কিছুতেই ধৈর্য্য থাকা জরুরি এজন্য কিছু করতে চাইলে অবশ্যই আপনাকে ধৈর্যসহকারে এগিয়ে যেতে হবে। কোন ভাবেই হতাশ হওয়া যাবে না। তবেই সফল হওয়া বা সফলতা পাওয়া যাবে। জেলা উপজেলার উদ্যোক্তাদের সুবিধার্থে আমরা প্রতিটি জেলায় একজন লিডার এবং চারজন করে সহযোগী করে কোঅডিনেটর গ্রুপ করে দিয়েছি। এখন উপজেলা নিয়ে কাজ করছি। এখন পর্যন্ত রাজশাহী এবং কুমিল্লা জেলায় উপজেলা পর্যন্ত কার্যক্রম করতে গ্রুপ করা হয়েছে। আস্তে আস্তে সবগুলো উপজেলায় কাজ চলছে। এর মাধ্যমে গ্রাম পর্যায়ের উদ্যোক্তারাও আমাদের উই’র সেবা পাবে।

সোনালীনিউজ/এএইচ/আইএ

Wordbridge School
Link copied!