• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নবী (সা.) অবমাননার শাস্তি


মুফতি শরীফুল ইসলাম অক্টোবর ২৯, ২০২০, ০১:৫৭ পিএম
নবী (সা.) অবমাননার শাস্তি

ঢাকা : ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী সকল মানুষের হূদয়ে মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম খোদাই করে লেখা। একজন মুসলমান রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজের প্রাণের চেয়ে, সন্তানের চেয়ে, মা-বাবার চেয়ে এবং তার যাবতীয় ধন-সম্পদ থেকেও বেশি ভালোবাসে। এটা ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি কোনো ব্যক্তির এমন ভালোবাসা না থাকে, তাহলে সে প্রকৃত মুসলমানই হতে পারেনি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার পিতা-মাতা এবং তার সন্তান ও সমস্ত মানুষ থেকে আমাকে বেশি ভালো না বাসবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৫)

যে ব্যক্তি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালাগাল দেবে, অপমানিত করবে, তাঁকে অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করবে, তাঁর শানে অসম্মানজনক কথা বলবে বা লিখবে সে মুরতাদ। সে তওবা না করলে তাকে হত্যা করা ইসলামের বিধান। ইরশাদ হচ্ছে, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসুলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি।’ (সুরা আহজাব-৫৭)।

এরপর তাদের শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘অভিশপ্ত অবস্থায় তাদের যেখানেই পাওয়া যাবে, ধরা হবে এবং প্রাণে বধ করা হবে। যারা পূর্বে অতীত হয়ে গেছে, তাদের ব্যাপারে এটাই ছিল আল্লাহর রীতি। আপনি আল্লাহর রীতিতে কখনো পরিবর্তন পাবেন না।’ (সুরা আহজাব-৬১-৬২)। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্য তারা যদি তওবা করে, নামাজ কায়েম করে আর জাকাত আদায় করে, তবে তারা তোমাদের দিনি ভাই। আর আমি বিধানসমূহে জ্ঞানী লোকদের জন্য সর্বস্তরে বর্ণনা করে থাকি। আর যদি প্রতিশ্রুতির পর তারা তাদের শপথ ভঙ্গ করে এবং বিদ্রুপ করে তোমাদের দিন সম্পর্কে, তবে কুফর প্রধানদের সাথে যুদ্ধ কর। কারণ এদের কোনো শপথ নেই যাতে তারা ফিরে আসে। তোমরা কি সেই দলের সাথে যুদ্ধ করবে না; যারা ভঙ্গ করেছে নিজেদের শপথ এবং সংকল্প নিয়েছে রাসুলকে বহিষ্কারের? আর এরাই প্রথম তোমাদের সাথে বিবাদের সূত্রপাত করেছে। তোমরা কি তাদের ভয় কর? অথচ তোমাদের ভয়ের অধিকতর যোগ্য হলেন আল্লাহ, যদি তোমরা মুমিন হও।’ (সুরা তওবা-১১)।

হাদিসেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবমাননার ব্যাপারে অনেক ধমকি উল্লেখ করা হয়েছে। হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত- ‘তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মুসলমান হয়, আর সে সাক্ষ্য দেয় এ কথার যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, এবং এ কথার যে, আমি আল্লাহর রাসুল, তার রক্ত তিনটি অপরাধ ছাড়া বৈধ হবে না। এক. কারো প্রাণ বধ করে (ফলে কেসাস আবশ্যক হবে)। দ্বিতীয়. বিবাহিত হওয়ার পরেও জিনা করে। তৃতীয়. স্বীয় ধর্ম ছেড়ে দেয় এবং জামাত ছেড়ে আলাদা হয়ে যায়।’ অনত্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি নবীকে গালি দেয়, তাকে হত্যা কর। আর যে সাহাবিকে গালি দেয়, তাকে প্রহার কর।’ (জামেউল আহাদিস, হাদিস নং-২২৩৬৬)।

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত- ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কা বিজয়ের বছর মক্কায় প্রবেশ করেন, তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাথায় ছিল শিরস্ত্রাণ। তিনি মাথা থেকে তা খুললেন। সে সময় একজন এসে বললেন যে, ইবনে খাতাল কাবার গিলাফ ধরে বসে আছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাকে হত্যা কর।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৭৪৯)।

ইবনে খাতাল কাবার গিলাফ ধরা অবস্থায়ও কেন তাকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হত্যার নির্দেশ দিলেন? আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে বিস্তারিত ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, লোকটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালাগাল করত। (ফাতহুল বারী-২/২৪৮)।

কোরআন-হাদিস ও আসারে সাহাবার আলোকে সমস্ত ফুকাহায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে যে ব্যক্তি বেয়াদবি করবে, কটু কথা বলবে, নিন্দা করবে, দোষচর্চা করবে, তাহলে সে মুরতাদ হয়। তাকে হত্যা আবশ্যক হয়ে যাবে। আল্লামা কাজী ইয়াজ (রহ.) বলেন, কোরআন-হাদিস ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শানে কী কী হক রয়েছে তা প্রমানিত। তাঁকে কতটুকু সম্মান-ইজ্জত দিতে হবে তাও সুনির্দিষ্ট। এ হিসেবে আল্লাহ পাক কোরআনে কারিমে রাসুলকে কষ্ট দেওয়াকে হারাম করেছেন। আর উম্মত একথার ওপর ইজমা তথা ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে, মুসলমানদের মাঝে যে তাঁর কুৎসা বলবে কিংবা গালি দেবে, তাকে হত্যা করা হবে। তবে সে যদি স্বীয় কুফরি থেকে তওবা করে, স্বীয় ঈমান ও বিবাহ নতুন করে তাহলে ছেড়ে দেওয়া হবে। অন্যথায়, তাকে হত্যা করা আবশ্যক।

আল্লামা ইবনে আবেদিন শামি হানাফি (রহ.) লেখেন, ইমাম সুবকি (রহ.) বলেন, যদিও এ কথাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে যে, গুস্তাখে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তওবা করলে এবং দ্বিতীয়বার ইসলাম গ্রহণ করলে এবং ইসলামী বিধান মানার দৃঢ়তা প্রকাশ করলে তার তওবাকে গ্রহণ করা হবে এবং তাকে হত্যা করা হবে না। কিন্তু এমন ব্যক্তির ব্যাপারে আমার সন্দেহ হয় যে, সে ঈমানের মরতে পারবে কি না? কেননা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বেয়াদবি বহুত মারাত্মক অপরাধ। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের আত্মমর্যাবোধ অনেক কঠোর। এজন্য এ ব্যক্তির মৃত্যুর ব্যাপারে আমার ঘোর সন্দেহ আছে যে, তাকে হেদায়েত থেকে বঞ্চিত করা হতে পারে। তার ঈমানকে বরবাদ করা হতে পারে। হেদায়েত পাওয়ার তৌফিক নাও হতে পারে।

এ বিষয়টা স্পষ্ট যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যারা গালাগাল করে, কুৎসা রটায় তারা মুরতাদ। তওবা না করলে তাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। মক্কার কাফেররা পর্যন্ত নবীজির চরিত্রে বিমোহিত হয়ে আল-আমিন তথা বিশ্বাসভাজন উপাধি দিয়েছে। খ্রিস্টান বাদশা নাজ্জাশির সামনে মক্কার মুশরিকরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মানহানিকর বক্তব্য দেওয়ার উদ্দেশে গিয়েও যেখানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত, সবচেয়ে নীতিবান, সবচেয়ে চরিত্রবান বলে মন্তব্য করেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইজ্জত রক্ষা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। যাঁর নাম আমাদের কালিমার অংশ, আমাদের মুসলমানিত্বের অংশ, যার নাম না বলে কবরে মুক্তি মিলবে না, যাঁর সুপারিশ ছাড়া হাশরের ভয়াবহ হালাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না, যাঁর হাতে হাউসে কাউসারের পানি পান না করলে কলিজা ফাটা কান্নায় কাতরাতে হবে, সেই মহান নবীজিকে গালাগাল করা, নোংরা ভাষায় উপস্থাপন করা মহা অন্যায়। আল্লাহতায়ালা আমাদের সত্যিকার অর্থে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইজ্জত রক্ষা করার এবং তাঁকে পরিপূর্ণ ভালোবেসে তাঁর আদর্শে জীবন পরিচালনা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মুদাররিস, জামিয়া শায়খ আবদুল মোমিন, মোমিনশাহী

 

Wordbridge School
Link copied!