• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেনমোহর : মুসলিম নারীর একচ্ছত্র অধিকার


মুফতি এহসান বিন মুজাহির নভেম্বর ৩০, ২০২০, ০৯:৫৮ এএম
দেনমোহর : মুসলিম নারীর একচ্ছত্র অধিকার

ঢাকা : ইসলাম নারীকে যেসব অধিকার দিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো দেনমোহর। এটি নারীর অগ্রিম অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। সংকটকালে এর মাধ্যমে সম্মানজনক জীবনযাপনের একটি সুন্দর ও অর্থবহ ব্যবস্থা। দেনমোহর মুসলিম বিবাহিত নারীর একচ্ছত্র অধিকার। মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর তথা মোহরানা নির্ধারণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মোহরানা হলো ইসলামী রীতিতে বিয়ের বৈধ সনদ। ইসলামী আইন অনুযায়ী দেনমোহর হলো বিয়ের অন্যতম শর্ত। এই শর্ত অনুযায়ী বিয়ের সময় মর্যাদার প্রতীক হিসেবে স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রী যে অর্থ-সম্পদ পেয়ে থাকেন বা পাওয়ার অধিকার রাখেন, সেটিই দেনমোহর। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সম্মান প্রদর্শনপূর্বক স্বামীকে তার স্ত্রীর মর্যাদার মূল্যায়ন হিসেবে দেনমোহরের দায়িত্ব অর্পণ করেছে। দেনমোহরের মাধ্যমেই দাম্পত্যজীবনে ভালোবাসার প্রথম বীজ বপন করা হয়। মোহরপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা স্ত্রীর মাঝে এই আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রশান্তি তৈরি করে যে, দুদিনের ভোগের জন্যই কেবল স্বামী তাকে বিয়ে করেননি। দেহের স্বাদ ফুরিয়ে গেলেই তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে অন্য নারীর সন্ধানে তিনি হন্যে হয়ে ঘুরবেন না। ইসলামের রীতি অনুযায়ী বিয়ের শুরুতেই মোহরানা পরিশোধ করতে হয়। তবে স্ত্রী যদি মোহরানা মাফ করে দেন তা আলাদা বিষয়।

মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ অনুসারে চাহিবামাত্র স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদানের কথা বলা হয়েছে। স্ত্রীকে স্পর্শ করার আগে স্বামীর মৃত্যু হলে কিংবা তালাক হলেও মোহরানা পরিশোধ করতে হবে। যদি মৃত্যু হয় তাহলে সম্পূর্ণ আর তালাকের ক্ষেত্রে অর্ধেক মোহরানা প্রদানের বিধান রয়েছে। ইসলামের বিধি অনুযায়ী বিয়ের শুরুতেই মোহরানা পরিশোধের কথা উল্লেখ আছে। স্ত্রী যখন মোহরানা দাবি করেন, তখনই স্বামী তা প্রদানে বাধ্য থাকবেন। দেনমোহর আদায় করতে স্ত্রী চাইলে স্বামীর সম্পত্তি বিক্রি করতে পারেন, এমনকি যতক্ষণ পর্যন্ত তা প্রদান করা না হয়, স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত স্বামী দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করার অধিকার রাখেন না। সামর্থ্য অনুযায়ী মোহর নির্ধারণ এবং পরিশোধ করার জন্য ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে, যাতে স্ত্রীকে তা যথাযথভাবে প্রদানে স্বামী অপারগ না হয়।

দেনমোহরের প্রচলন নতুন নয়। বরং প্রাক-ইসলামী যুগেও এর রেওয়াজ ছিল। জাহেলি যুগে বিয়েতে মেয়েপক্ষকে সদকা দেওয়ার রীতি ছিল। সদকার মালিক হতেন মেয়ের পিতা-মাতা। পরে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সদকা প্রথায় কিছুটা সংশোধন করে এটাকে দেনমোহরের সঙ্গে একত্র করে দেন এবং দেনমোহরকে স্ত্রীর একক প্রাপ্য বলে ঘোষণা করেন। ইসলামী আইনে দেনমোহর স্ত্রীর বিশেষ অধিকার। কোরআন মজিদে স্ত্রীকে তার এ অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বারবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমনকি বলা হয়েছে, স্ত্রী ক্রীতদাসী হলেও তাকে মোহর প্রদান করতে হবে। হ্যাঁ, স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় তা গ্রহণ করতে না চান বা আংশিক গ্রহণ করতে চান, তাহলে তা ভিন্ন কথা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, ‘হে নবী! আমি আপনার স্ত্রীগণকে আপনার জন্য বৈধ করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেছেন’ (সুরা নিসা : ৩৩)। কোরআনুল কারিমে আরো এরশাদ হয়েছে, যদি তাদেরকে মোহরানা প্রদান করে থাকো, তবে তাদেরকে বিয়ে করায় তোমাদের কোনো অপরাধ নেই (সুরা নাস : ৬০)। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আরো এরশাদ করেন, ‘তোমাদের স্ত্রীদের মোহরানা তাদেরকে সদকাস্বরূপ দাও, অবশ্য যদি তারা এর কিছু অংশ ক্ষমা করে দেয় তবে তা সন্তুষ্টিচিত্তে ভোগ করতে পার’ (সুরা নিসা : ৪)।

বিশুদ্ধ হাদিস গ্রন্থেও মোহরের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। হজরত আবু সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি হজরত আয়েশাকে (রা.) জিজ্ঞেস করলাম, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়েতে মোহরের পরিমাণ কত ছিল? তিনি বললেন, তাঁর বিয়ের মোহর ছিল ‘বারো উকিয়া’ ও ‘এক নাশ্ব’, যার পরিমাণ ছিল ‘পাঁচশ দিরহাম’ (মুসলিম : ২৯৪৭)। হজরত ওমর (রা.) বলেছেন, সাবধান! তোমরা স্ত্রীদের মোহর বেশি ধার্য করবে না, কেননা তা যদি দুনিয়ায় সম্মানের এবং আখিরাতে আল্লাহর কাছে তাকওয়ার বিষয় হতো, তবে সে ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিক উপযোগী ছিলেন। কিন্তু রাসুলুল্ল­াহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারো উকিয়ার বেশি দিয়ে তাঁর কোনো স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন, তাঁর কোনো কন্যাকে বিয়ে দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই (তিরমিজি : ২৬৯১)। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুলুল্লা­াহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘শেগার’ নিষেধ করেছেন। শেগার বলতে বোঝায়, কোনো ব্যক্তি তার কন্যাকে এই শর্তে বিবাহ দেয় না যে, তার কন্যাকে তার কাছে বিনিময়ে বিয়ে দেবে এবং কোনো মোহরানা তাদের মধ্যে থাকবে না’ (বুখারি : ২৭৩৬)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো নারীকে কম বা বেশি মোহর ধার্য করে বিয়ে করল অথচ তার অন্তরে মোহরের সেই হক আদায়ের আদৌ কোনো ইচ্ছাই নেই, সে ব্যক্তি কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে ব্যভিচারী হিসেবে উপস্থিত হবে (তাবারানি)। তিরমিজি শরিফেও বর্ণিত আছে- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো নারীকে মোহর দানের শর্তে বিয়ে করেছে অথচ মোহর আদায়ের নিয়ত তার নেই তবে সে ব্যভিচারী  (তিরমিজি : ২৪৬১ )।

হজরত আমির বিন রাবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- বনু ফাজারা সম্প্রদায়ের কোনো স্ত্রীলোককে এক জোড়া জুতার বিনিময়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি তোমার দেহ এবং সম্পদের পরিবর্তে এক জোড়া জুতা পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছ? স্ত্রীলোকটি বলল, হ্যাঁ। তারপর তাকে তিনি অনুমতি দিলেন (তিরমিজি : ১৯৭৪)। হজরত ওকবাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বিয়েতে যে শর্ত সর্বপ্রথম পূরণীয় তা হলো ওই জিনিস (মোহর) যা দ্বারা গুপ্তাঙ্গ বৈধ করা হয়েছে (বুখারি : ২৭৪১)। মুসলিম আইন অনুসারে একটি বিয়ে বৈধ বা শুদ্ধ হতে হলে পাঁচটি শর্ত পূরণ করতে হয়। মোহর প্রদান পাঁচটি শর্তের অন্যতম একটি শর্ত। মোহর ছাড়া বিয়ে পুরোপুরি বাতিল না হলেও এ ধরনের বিয়ে ফাসিদ বা ত্রুটিযুক্ত। যে কোনো সময় মোহর নির্ধারণ বা পরিশোধ করা হলে ফাসিদ বিয়েটি বৈধ হয়ে যাবে। মোহর বিয়ের আগে বা বিয়ের সময় নির্ধারণ করা যায়। বিয়ের সময় যদি মোহর নির্ধারণ না হয়ে থাকে, এমনকি স্ত্রী কোনো মোহর দাবি করবেন না শর্তে বিয়ে সম্পাদিত হয় তাহলেও স্ত্রীকে মোহর দিতে হবে। স্বামী কোনো অজুহাত দেখিয়েই স্ত্রীকে মোহর দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারবেন না। মোহরানার ব্যাপারটি যতক্ষণ পর্যন্ত ফয়সালা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো বিয়ে পূর্ণাঙ্গ হবে না।

বিয়ের সময় দেনমোহর পুরোটা নগদ পরিশোধ করা যায়। আবার খরচাপাতি (গহনা, অলংকার) করেও পরিশোধ করা যায়। আবার সংসার জীবনে ধীরে ধীরে পরিশোধও করতে পারবেন স্বামী। তবে যখনই স্ত্রী স্বামীকে দেনমোহর দেওয়ার কথা বলবেন তখনই স্বামীকে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। আর যদি স্ত্রী স্বামীকে দেনমোহরের ব্যাপারে কিছু না বলেন, তাহলে স্বামীর ওপর দায়িত্ব হলো স্বেচ্ছায় স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করা। যে পরিমাণ অর্থ উল্লেখ থাকবে, সেই পরিমাণ অর্থই দিতে হবে। এর সামান্য পরিমাণ কম দিলেও মোহর আদায় হবে না। তবে স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় স্বামীর ওপর অনুগ্রহ করে মোহর কমিয়ে দেন, তখন কম দিলে অসুবিধা নেই। মোহরানার মালিকানা স্বত্ব একমাত্র স্ত্রীরই। স্ত্রী ইচ্ছা করলে স্বামীকে পুরো মোহরও মাফ করে দিতে পারেন। কিন্তু স্বামী কর্তৃক চাপে বাধ্য করে মোহরানা কমানো বা মাফ করানো যাবে না। স্ত্রী  মোহরানা মাফ না করলে কখনো স্বামী এ দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পাবেন না। লোক দেখানো মাত্রা অতিরিক্ত মোহর ধার্য না করে যার যতটুকু সামর্থ্য আছে, সে পরিমাণ মোহর নির্ধারণ করা এবং পরিপূর্ণ আদায় করা ইসলামের নির্দেশ। কোনো অবস্থায় মোহর খুব বেশি হওয়া উচিত নয়, যা স্বামীর পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব নয়। আবার খুব কম হওয়াও উচিত নয়, যা স্ত্রীর আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারে না।

লেখক : প্রিন্সিপাল, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলভীবাজার
[email protected]

 

Wordbridge School
Link copied!