• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভরসা একমাত্র আল্লাহর ওপরেই


রাশেদ নাইব মার্চ ৬, ২০২১, ০১:৩৭ পিএম
ভরসা একমাত্র আল্লাহর ওপরেই

ঢাকা : ‘ভরসা’ মাত্র তিনটি অক্ষর। এর মাঝে লুকিয়ে আছে হাজারো স্বপ্ন, হাজারো কথা। আপনি যখন কোনো শিশুকে শূন্যে ছুঁড়ে খেলা করবেন, সে তখন হাসতে থাকে। কারণ, সে জানে আপনি তাকে আবার ধরে ফেলবেন। এটা তার ভসরা আপনার প্রতি। পরম শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতা আমাদেরকে লালনপালন করছেন। প্রতিনিয়ত আমাদের জন্য অসহ্য কষ্টকে সামান্য ভেবে তা সাধন করে চলছেন। মানুষরূপে গড়ার চেষ্টা করছেন। আমরা বাসায় এলে খাবার প্রস্তুত পাই। কারণ, আমাদের ভরসা আছে বাবা-মায়ের উপর। তারা যে কোনো ভাবেই হোক আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে রাখবে।

‘তাওয়াক্কুল’ অর্থ আল্লাহর ওপর ভরসা করা, নির্ভর করা। তাওয়াক্কুল সম্পর্কে কোরআনের বহু আয়াত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহু হাদিস, তাঁর পবিত্র জীবনের বহু ঘটনা এবং আউলিয়ায়ে কিরামের বহু কাহিনী রয়েছে। তাওয়াক্কুল হচ্ছে আল্লাহরাব্বুল আলামীনের নৈকট্যলাভের অন্যতম উপায়। আত্মা ও মনের প্রশান্তি অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ পন্থা। কোনো লক্ষ্য হাসিলের জন্য চেষ্টা তদবির বর্জন করার নাম তাওয়াক্কুল নয়। সাধ্যানুযায়ী সর্বাত্মক চেষ্টা সাধনা করার পর ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করাই হচ্ছে তাওয়াক্কুল।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহরাব্বুল আলামীন বলেন, ‘যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার পথ করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস থেকে রিজিক দান করবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভর করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক, আয়াত-২, ৩) আল্লাহ আরো ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করো, যদি তোমরা মুমিন হও।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত-২৩) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘ কেহ আল্লাহর ওপর নির্ভর করিলে আল্লাহ অতি পরাক্রমশীল, প্রজ্ঞাময়। (সুরা আনফাল, আয়াত-৪৯) অন্যত্র আরো ইরশাদ হয়েছে ‘আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করলে তোমাদের ওপর জয়ী হবার কেউ থাকবে না। আর তিনি তোমাদেরকে সাহায্য না করলে, তিনি ছাড়া কে আছে, যে তোমাদেরকে সাহায্য করবে? মুমিনগণ আল্লাহর ওপরই তাওয়াক্কুল করুক।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৬০) ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওয়াক্কুলকারী লোকদেরকে ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত -১৫৯) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘আল্লাহ তা’আলার প্রতি যেরূপ তাওয়াক্কুল করা উচিত তোমরা যদি তঁঁর প্রতি সেরূপ তাওয়াক্কুল করতে পার তবে তিনি তোমাদেরকে রিয্ক দান করবেন। পশু পাখিরা সকালে ক্ষুধার্ত অবস্থায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে বেরিয়ে যায় এবং দিন শেষে পূর্ণ উদরে তৃপ্ত হয়ে নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে আসে।’ (তিরমিযি, ইবনে মাজা)

তাওয়াক্কুল একটি আত্মিক ও আধ্যাত্মিক মহৎ গুণ। যার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থা যত উন্নত তাঁর তাওয়াক্কুলের উৎকর্ষ তত অধিক। আল্লাহকে যিনি যত বেশী ভালোবাসতে পারেন, তাঁর সত্তাতে নিজেকে সমর্পণ করতে পারেন, তাঁর খুশি রেজামন্দিকে যত বেশি জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য বানাতে পারেন; তাঁর তাওয়াক্কুলের উৎকর্ষও হয় তত অধিক।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্ব গুণেই সবার সেরা। তাঁর তাওয়াক্কুলও নজিরবিহীন। একদা তিনি নির্জনে একটি গাছের ছায়ায় শুয়ে ঘুমুচ্ছিলেন, এক দুশমন তা দেখে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাঁর গর্দান লক্ষ্য করে শানিত তরবারি উত্তোলন করে হুংকার দিয়ে বলল, ‘মোহাম্মদ! আমার হাত থেকে এখন তোমাকে কে রক্ষা করবে? নবীজি সেই তরবারির নিচ থেকে অকম্পিত নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, আল্লাহ!’ এই শব্দে ঘাতকের দেহ থরথর করে কেঁপে উঠল। হাত থেকে তরবারি খসে পড়ল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই তরবারি ধারণ করে বললেন,  এখন তোমাকে কে রক্ষা করবে? লোকটি বলল, যিনি মুহূর্তের মধ্যে আমার হাতের তরবারি আপনার হাতে তুলে দিলেন, তিনিই। তখন সেই ব্যক্তি কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে ঈমান এনে মুসলমান হয়ে গেলেন।

হিজরতকালীন সময়ের ঘটনা আরো বিস্ময়কর! ঘাতক বাহিনীর চোখ এড়িয়ে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সহচর আবু বকর রা. নৈশ অন্ধকারে আশ্রয় নিলেন এসে তুর পর্বতের গুহায়। ঘাতকরা নবীজিকে বিছানায় না পেয়ে বেরিয়ে পড়ল তাদের সন্ধানে। এক সময় পৌঁছে গেল সেই গুহার মুখে। তাদের পা দেখা যাচ্ছিল গুহার ভেতর থেকে। দারুণভাবে বিচলিত, সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন হজরত আবু বকর (রা.)। এক্ষুণি বুঝি তারা গুহায় ঢুকে হত্যা করবে প্রিয়নবীকে। কী উপায় হবে আমাদের! আমরা যে মাত্র দু’জন। নবীজি প্রশান্ত চিত্তে নিরুদ্বিগ্নভাবে, মৃদু কণ্ঠে বললেন : না, আমরা দুজন নই, তিন জন। ‘লা-তাহ্যান ইন্নাল্লাহা মা’আনা’ তুমি চিন্তিত হয়োনা (হে আবু বকর) আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা তাওবা, অঅয়াত-৪০) আল্লাহর কী লীলা! ঘাতকরা দেখতে পেল একটি মাকড়সা গুহামুখে জাল পেতে বসে আছে। তারা ভাবল, গুহায় নিশ্চই কোনো লোক প্রবেশ করেনি, তাহলে এ জাল অক্ষত থাকত না। তারা চলে গেল। আল্লাহ সূক্ষ্ম সামান্য একটি মাকড়সার জালের ঢাল দিয়ে তাঁর হাবীবকে রক্ষা করলেন। এ হলো আল্লাহর হাবীবের আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলের একটি উদাহরণ। এমন উদাহরণ আছে আরো বহু।

এক আল্লাহওয়ালা লোক হজ্বে যাচ্ছিলেন। দুর্গম পার্বত্য পথ ধরে একাকী অগ্রসর হচ্ছেন তিনি। ক্ষুধা পাওয়ায় বসলেন এক পর্বত ছায়ায়। ঝোলা থেকে বের করলেন কিছু গোশত ও রুটি। একটু ঘাড় ফেরাতেই একটি কাক ছো মেরে তা নিয়ে গেল। লোকটি দেখতে পেলেন, কাকটি তা খেলনা। বরং পরম যত্নে যেন তা নিয়ে উড়াল দিল। লোকটি বিস্ময়বোধ করলেন। ছুটলেন কাকের পেছনে পেছনে। আরেক পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে দেখলেন, একটি লোক কঠিন রজ্জুতে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে। আর কাকটি ছিনিয়ে আনা গোশত-রুটি ঠোঁট দিয়ে সেই লোকটির মুখে তুলে দিচ্ছে। তিনি লোকটির কাছে গিয়ে বসলেন, বাঁধন মুক্ত করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর দুর্দশার কারণ। লোকটি বললেন, আমি হজ্বে যাচ্ছিলাম। এখানে এই পার্বত্য পথে ডাকাতরা আমাকে আক্রমণ করে। আমার সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে বেঁধে রেখে চলে যায়। এভাবে ৭ দিন যাবত এখানে জীবন্মৃত অবস্থায় পড়ে আছি। তবে একটি কাক প্রতিদিন এসে আমাকে গোশত-রুটি খাইয়ে যায়। অসীম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ। মহান প্রতিপালক আল্লাহ। অপার তাঁর করুণা দয়া ও মেহেরবানী। ইরশাদ হয়েছে : ‘আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন?’ (সুরা জুমার,আয়াত-৩৬) অবশ্যই যথেষ্ট। শিশু যখন মাতৃজঠরে ভ্রুণ আকারে, মুখ দিয়ে কিছু খেতে পারেনা, তখন তাকে কে নিয়মিত আহার যুগিয়ে ক্রমান্বয় বর্ধিত করে তোলেন? দুনিয়ায় আসার সাথে সাথে কে তার জন্য মাতৃস্তনে দুনিয়ার সর্বাধিক পুষ্টিকর খাবার প্রস্তুত করে রাখেন? তিনিই মহান পরোয়ারদেগার আল্লাহ।

জটিল কঠিন মামলায় আমরা যদি ঝানু আইনবিশারদ, বাকপটু, সাহসী, সুচতুর, অভিজ্ঞ উকিল নিয়োগ করে নিশ্চিন্ত হতে পারি। সন্তানকে উন্নতমানের বিদ্যালয়ে দক্ষ, অভিজ্ঞ, আদর্শ শিক্ষকের কাছে সঁপে দিয়ে যদি নিশ্চিন্ত হতে পারি, তবে কেন সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, মহাপরাক্রান্ত, পরম দয়ালু ও মেহেরবান আল্লাহর ওপর আমাদের সব কিছুর ভার সঁপে দিয়ে তাওয়াক্কুল করতে পারবো না? তিনিতো বলেই দিয়েছেন ‘যে আমার ওপর তাওয়াক্কুল করে আমি তার জন্য যথেষ্ট’।

যারা আস্তিক, বিশ্বাসী, মুমিনবান্দা-শত বিপদ, মুসিবত, ঝড়-ঝঞ্ঝার মাঝেও, তাদের দুঃখ-দুর্দশা পেশ করার মতো একটা জায়গা আছে। আশ্রয় চাওয়ার মতো একটা ঠাঁই আছে। আর এর মাঝেও আত্মিক প্রশান্তি লাভের মওকা আছে। কিন্তু অবিশ্বাসী নাস্তিকের সেই জায়গাটি নেই। তাই তাদের এরূপ দুরাবস্থায় দেওয়ানা পাগল হওয়া বা আত্মহত্যা ছাড়া উপায় থাকে না। কেউ না দেখুক, কেউ না শুনুক, কেউ পার্শ্বে এসে না দাঁড়াক, আমার আল্লাহ আছেন। আমার এই জীবনই শেষ কথা নয়, পরকাল আছে। এখানে প্রতারণা, বঞ্চনার শিকার হলেও সেখানে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ইনসাফ আছে। পুরস্কার আছে। তাই চারদিকে আঁধার ঘিরে এলেও খাঁটি মুমিন বান্দা অবিচল থাকতে পারে। তাওয়াক্কুল মনে অসীম শক্তি ও সাহস যোগায়। বিপদে আপদে ধৈর্যের সাথে আল্লাহর উপড় তাওয়াক্কুল করতে হবে। সব কঠিনের পর সহজ রয়েছে। আল্লাহরাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, ‘কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি আছে। অবশ্যই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে। অতএব তুমি যখনই অবসর পাও একান্তে ইবাদত করো এবং তোমার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ করো।’ (সুরা আলাম নাশরাহ, আয়াত- ৭, ৮)

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

 

Wordbridge School
Link copied!